Sylhet Today 24 PRINT

অগ্রাধিকার নয়, হোক নারী-পুরুষের সমান অধিকার

শাহ শরীফ উদ্দিন |  ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯

একটা সময় আমাদের মধ্যে একটা আক্ষেপ ছিল আমাদের দেশে নারী অধিকার নিয়ে। কিন্তু সে আক্ষেপ এখন আর নেই। ক্ষেত্র বিশেষে নারীরা অধিকার বঞ্চিত হলেও অধিকাংশ জায়গায় এখন নারীরা পাচ্ছে অগ্রাধিকার। গর্বের ব্যাপার হলো আমাদের দেশের মানুষ এখন নারীদের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সচেতন। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমরা নারীদের সমান অধিকার দিতে গিয়ে অগ্রাধিকারই দিচ্ছি সম্ভবত। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে কিছু স্বার্থান্বেষী নারী নোংরামিতে লিপ্ত হচ্ছে। যার উদাহরণ যদি আমরা ধরি মিতু বা নাম না জানা আরো অনেকেই যা খুব বেশি একটা প্রচারণায় আসেনি।

যাই হোক আসি মূল আলোচনায়। অধিকার বলতে আমরা কি বুঝি? অধিকার হচ্ছে একজন মানুষকে তার যৌক্তিক প্রয়োজনে প্রাপ্যটুকু দেয়া। আর সমান অধিকার বলতে দুজন মানুষকেই সমান ভাবে প্রাপ্যটুকু দেয়া। আর অগ্রাধিকার বলতে যখন দুজন মানুষ একই সময় একই জিনিশের দাবীদার তখন এই একটি জিনিশ যার ভাগ্যে পড়লো সে অগ্রাধিকারভোগী। সে অনুযায়ী আমি বলবো নারীরা কেবল অধিকারই পাচ্ছে না বরং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারই পাচ্ছে। যার কারণেই আজকাল নারীরা ক্ষেত্র বিশেষে উগ্র হয়ে যাচ্ছে। আধুনিকতার নামে অতি-আধুনিক হয়ে যাচ্ছে, অধিকারের কথা বলে পুরুষের হাতে শিকল পরাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে পুরুষ তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ভেতরে ভেতরে নির্যাতিত হয়েও কেবল একটি দীর্ঘশ্বাস কিংবা ডা.আকাশের মতো আত্মহত্যা নামক বোকামির পথ বেছে নিচ্ছে।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে নারী কি ভাবে অগ্রাধিকার পাচ্ছে? পুরুষ কি ভাবে অধিকার বঞ্চিত হচ্ছে? ইত্যাদি। তাহলে আসি আইনের ক্ষেত্রে নারীর অগ্রাধিকারের আলোচনায়। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রের সকল নাগরিক আইনের চোখে সমান। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী এ সমতা খর্ব করা হয়েছে। হতে পারে সেটি। কারণ সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে সমতার বিষয় বলা হলেও অন্য অনুচ্ছেদে কোন পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী বা নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর জন্য সরকার কোন বিশেষ আইন প্রয়োগেরও ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী বাংলাদেশের নারীরা যখন নির্যাতিত হচ্ছেন বা নারীদের ক্ষেত্রে নির্যাতনের মাত্রা দিন দিন বেড়ে চলেছে তখন নারী ও শিশু আইন-২০০২, পরবর্তীতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০১৩ প্রণয়ন ও এর বাস্তবায়নের জন্য করা হলো নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ ট্রাইব্যুনাল এবং যৌতুক নিরোধ আইন প্রণয়নও করা হলো। এতেকরে আমাদের নারীদের উপর নির্যাতন কতটা কমলো? কতটা কমলো নাকি বাড়ল তার হিসেব কষতে গিয়ে দেখা গেলো দিনে দিনে পুরুষ নির্যাতনই বেড়ে গেলো। কি ভাবে বাড়ল তার ব্যাখ্যাটিও দিচ্ছি।

আমরা যদি দেখি দণ্ডবিধি ৩৭৫ অনুযায়ী ধর্ষণ কি তাহলে এখানে ধর্ষণকে পাঁচ ভাবে সংজ্ঞায়ন করা হয়েছে ১. স্ত্রীলোকের ইচ্ছার বিরুদ্ধে শারীরিক সম্পর্ক, ২. স্ত্রীলোকের সম্মতি ছাড়া, ৩. সম্মতি নিয়ে কিন্তু মৃত্যু কিংবা আঘাতের ভয় দেখিয়ে, ৪. পুরুষ জানে সে ওই স্ত্রীলোকের আইনগত বৈধ স্বামী নয় কিন্তু স্ত্রীলোকের কাছে নিজেকে আইনগত বৈধ স্বামী উপস্থাপন করা এবং স্ত্রীলোকটি ওই পুরুষকে স্বামী হিসেবে বিশ্বাস করে শারীরিক সম্পর্ক করা, ৫. সম্মতি নিয়ে বা সম্মতি ছাড়া, কিন্তু ওই স্ত্রীলোকের বয়স ১৪ বছরের কম। এ ক্ষেত্রে দণ্ডবিধি ৩৭৬ অনুযায়ী এর শাস্তি যাবজ্জীবন বা ১০ বছর এবং অর্থদণ্ড। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনুযায়ীও ধর্ষণের শাস্তি এবং ধর্ষণের সংজ্ঞা একই। কিন্তু বর্তমান সময়ে আইনে উল্লেখিত ধর্ষণ আমরা কয়টা দেখি? পত্রিকা খোললেই 'বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ, প্ররোচিত করে ধর্ষণ ইত্যাদি খবর পাই। খুব কম সময়ই ধর্ষণ, ধর্ষণের চেষ্টার খবর পাই। এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে 'বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ' এই শব্দটার আবিষ্কার হলো কোথা থেকে? বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ মানে একটা মেয়ে আর একটা ছেলে বিয়ের পূর্বে দুজনের সম্মতিতে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলো। কিন্তু এখন তাদের সম্পর্ক বিচ্ছেদ হয়েছে।

এ ক্ষেত্রে এটি ধর্ষণে পড়ে কি করে? যাই হোক তবুও আমাদের ন্যাচারাল জাস্টিস বলে বিচারকরা ইনহেরিটেন্স পাওয়ার ব্যবহার করে অভিযুক্ত ছেলের সাথে মেয়ের শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন হয়েছে প্রমাণিত হলে শাস্তি দিয়ে থাকেন। অথচ একটা ছেলে এই অধিকারটুকু স্বাভাবিক ভাবেই রাখতে পারে যে ৩ বছর আগের ভালবাসা ৩ বছর পর এসে বাদ দিয়ে দেয়া। কিন্তু না সে বাদ দিবে কেন! শারীরিক সম্পর্ক করার আগে ভেবে করেনি? সুতরাং এ অধিকার তার নাই। কিন্তু এক বার কেন ১ শত বার শারীরিক সম্পর্ক হলেও মেয়ে চাইলে সে ক্ষেত্রে সম্পর্ক বাদ দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে ছেলে বেচারা কেবল মজনু হয়ে ঘুরা ছাড়া আর কিছু করার নাই। তাহলে মেয়ে কি সমান অধিকার পাচ্ছে নাকি অগ্রাধিকার? কেবল তাই না ছেলে বিয়ের আগেই অন্য কাউকে ভালবেসে সম্পর্ক বিচ্ছেদ করতে গিয়ে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড়ালেও মেয়ে বিয়ের পরও মুহূর্তেই স্বামীকে তালাক দিতে পারে। কিছু কথিত যুক্তিবাদীদের যুক্তি, হোকনা সেটা পরকীয়ার টানে স্বামীকে ত্যাগ করা। তবুও এটা অধিকার। কারণ কিছু দিন পর তার স্বামীকে ভালো নাও লাগতে পারে।

যাই হোক এ ক্ষেত্রেও বেচারা স্বামী পাই পাই করে গুনতে হয় মোহরানায় বড় অংকের টাকা। কারণ বেচারি কখনো নিজেকে পরকীয়ায় আসক্ত বলতে নারাজ। কিন্তু একটা ছেলে চাইলেই তার স্ত্রীকে ত্যাগ করতে পারবেন না। কারণ উনি যে শিকলে বাধা তা ছিন্ন করা কঠিন। উনার আবার ইচ্ছা, অনিচ্ছা, ভালবাসা, ভালোলাগা কি? এতই যখন শখ তাহলে গুনে দাও কাবিনের টাকা। কারণ আইন যে মেয়ের অধিকার দিয়েছে আর মেয়েরা এর সুযোগ কাজে লাগিয়ে অগ্রাধিকার নিচ্ছে। কিন্তু আমরা ভুলে যাই ন্যাচারাল জাস্টিস নামের একটি বিষয় যে আছে। সে অনুযায়ী পরকীয়া অপরাধ। সে হোক ছেলে বা মেয়ে। সে অনুযায়ী হতে পারতো মেয়ে পরকীয়ায় আসক্ত হয়ে স্বামীকে তালাক দিতে চাইলে আর পরকীয়া প্রমাণিত হলে কাবিনের টাকা পাবেন না বরং ক্ষতিপূরণ বাবদ জরিমানা দিতে হবে। আর স্বামী হলে নিয়ম অনুযায়ী মোহরানা, ইদ্দতকালীন সময় ভরণপোষণ। কিন্তু না, তা হচ্ছে না। বরং বিচারকরা এ ক্ষেত্রে নারীদের অগ্রাধিকার দিতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ইনহেরিটেন্স পাওয়ার না খাটিয়ে স্বাভাবিক আইনে বিচার করেন। এতে দণ্ডবিধি ৪৯৭ অনুযায়ী বিচার করে পরকীয়ায় অভিযুক্ত পুরুষ ব্যক্তিকে ব্যভিচারী হিসেবে ৫ বছরের দণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয়বিধ দণ্ড দেয়া হবে এবং নারী দুষ্কর্মে সহযোগিতাকারিনী হিসেবে দণ্ডিত হবে না। এ ধারায়ও অপরাধ করেও নারী নিরপরাধ। এখানেও নারীর অগ্রাধিকার। এতে করে নারীর যা ইচ্ছা তা করার ক্ষমতা পাচ্ছে।

দেখুন আমরা কত এগিয়ে। এইতো সেদিন আমরা নারীর সমান অধিকারের জন্য আন্দোলনে নেমেছিলাম। আর আজ অগ্রাধিকার হয়ে গেলো!

এখন কথা হচ্ছে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা হোক এটি যে কোন সভ্য জাতির প্রাণের চাওয়া। কিন্তু নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পুরুষের হাতে শিকল পরানো হোক এটা নিশ্চয় কারোরই চাওয়া নয়। কিন্তু বর্তমানে কি হচ্ছে অধিকার না অগ্রাধিকার? এতে সমাজের উন্নতি হচ্ছে নাকি মূল্যবোধের অবক্ষয় হচ্ছে? একবার ভেবে দেখবেন।

এখন আসি অন্য বিষয়ে। বর্তমানে আমাদের দেশে পরকীয়া নিয়ে যে হারে চিল্লাচিল্লি শুরু হয়েছে এর সুফল মোটেও ভালো হবে না। কারণ ভুলে গেলে চলবে না, প্রচারেই প্রসার। আর পরকীয়ার ক্ষেত্রে নারীর ভালো লাগা মন্দ লাগার পক্ষেই বেশি যুক্তি দেখানো হচ্ছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে পরকীয়া কি শুধু নারীরাই করে? আর পুরুষরা কি দুধে ধুয়া তুলসীপাতা? তাহলে আপনারা কেনইবা নারীর পক্ষে সাফাই গাইবেন! আর তাই যদি করেন তাহলে কিছু প্রশ্ন রেখে যাই উত্তর নিজে নিজে মিলিয়ে নিয়েন। যেসকল মেয়ে বা ছেলে পরকীয়া করে তারা কি সবাই মা বাবার পছন্দে বিবাহিত? নিজেদের পছন্দে, প্রেম করে বিয়ে করেও এখন পরকীয়া করছে না? আর যদি মা বাবার পছন্দেই বিবাহিত হয়ে থাকে তাহলে এখানে একজন স্বামীর কি দুষ? এখানে অপরাধ মামা-বাবার হলে সে কেন শাস্তি পাবে? আপনার কনে পছন্দ না হলে আগেই কেন বলেননি? এখন পরকীয়া করে স্ত্রীকে কেন কষ্ট দিবেন? পরকীয়ার পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে নারীদের অগ্রাধিকার দিচ্ছেন?

আপনারা যারা পরকীয়ার পক্ষে ভালোলাগা না লাগার যুক্তি দিচ্ছেন তাদের জ্ঞ্যাতার্থে বলি, মনরোগ বিশেষজ্ঞরা এটাকে একটা রোগ হিসেবেই বিবেচনা করছেন। কিছুদিন আগে সিলেটে আত্মহত্যা প্রবণতা বেড়ে যাওয়া নিয়ে একটা প্রতিবেদন করেছিলাম। তখন আত্মহত্যার অনেক কারণের মধ্যে পরকীয়াও একটি কারণ উল্লেখ করে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের সাইকাট্রি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডা. আরকে রয়েল বলেছিলেন পরকীয়া এক ধরণের রোগ। তাহলে আপনারা কেন এর চিকিৎসার জন্য পরামর্শ না দিয়ে ভালোলাগা আর ভালবাসার যুক্তি দিয়ে হালাল করার চেষ্টা করছেন? তবে কি 'হালুয়া রুটির ভাগ চান? নাকি পরকীয়ার নামে বিবাহবহির্ভূত যৌনাচার চান? লজ্জাও কি তবে খুন করেছেন? নাকি এখানেও নারীর অগ্রাধিকার চান? একবার প্রশ্ন করুন পরকীয়ায় আসক্ত কয়জন জীবনে সুখে আছেন? দিন শেষে একা হচ্ছেন নাতো? ব্যক্তিত্বহীন হচ্ছেন নাতো?

আসি অন্য বিষয়ে। বিয়ে, সংসার, সামাজিক আচার অনুষ্ঠান, এমনকি ধর্মীও আচারানুষ্ঠানেও দায় কেবল পুরুষের। বিয়ে করে খাওয়াবে কি? ছেলে ভালো চাকরি করে কি না? পরিবারের বড় ছেলে/ বড় মেয়ের জামাই তাই দায় তোমারই বেশি ইত্যাদি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কয়জন মেয়ে বলেছেন বিয়ে করে খাওয়াবো কি? আপনার উপার্জনের টাকা আপনার নিজের নাকি আপনাদের ভাবছেন? অথচ একজন ছেলের উপার্জনের টাকা সকলের। আর সংসার সেটাতো দায় দুজনেরই সমন। কেউ বাইরে আর কেউ ঘরে কাজ করে। অথবা দুজন বাইরে কাজ করলে ঘরে এসে একজন রান্না করলে অন্যজন সবজি কাটে নাহয় বাচ্চা সামলায় অথবা কাপড় কাঁচে সুতরাং আর অধিকারের নামে অগ্রাধিকার দেয়ার চেষ্টা করে হালুয়া রুটির ভাগ  চাইবেন না।

অতএব অগ্রাধিকার নয়, হোক নারী-পুরুষের সমান অধিকার।

  • শাহ শরীফ উদ্দিন: নাট্যকর্মী, সাংবাদিক।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.