Sylhet Today 24 PRINT

ভূমিকম্প সম্ভাবনা এবং সম্ভাব্য ধ্বংসলীলা

মোহাম্মদ কামরুল আনাম চৌধুরী |  ২১ মার্চ, ২০১৯

কিছুদিন পর পর সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়ে ওঠে ভূমিকম্পের খবর। গত ২৬ ডিসেম্বর ২০০৪ সালে ভূমিকম্প জলোচ্ছ্বাসে তছনছ হয়েছে এশিয়া। এ পর্যন্ত প্রায় মৃতের সংখ্যা প্রায় দুই লাখ ছাড়িয়ে গেছে। দাফনের অপেক্ষায় হাজার হাজার লাশ, দুর্গন্ধে বাতাস ভারি এমন খবর বেরিয়েছিল সংবাদ মাধ্যম গুলোতে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল ভয়াবহ ভূমিকম্প ও এর ফলে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। শ্রীলঙ্কা, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ ও মিয়ানমারে প্রায় ১ লক্ষাধিক লোক নিহত হয়। ভূমিকম্পের কেন্দ্র ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপে। এর মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৮ দশমিক ৯। বাংলাদেশে ৭ দশমিক ৩৬ মাত্রায় ভূমিকম্প হলেও তেমন কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তবে বাংলাদেশে ভূমিকম্প হলেও তা দৃশ্যমান ছিল পানিকম্প বা জলকম্প হিসেবে আর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শ্রীলঙ্কা। ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রার কাছে ভারত মহাসাগরের তলদেশে স্থানীয় সময় সকাল ৭ টা ৫৯ মিনিটে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়। এ ভূমিকম্পের ফলে ৩৩ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস সৃষ্টি হয়, যার প্রভাব পড়ে কয়েক হাজার মাইল দূর পর্যন্ত। তবে বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ধ্বংসলীলা থেকে যে কারণে বেচে যায়, তাহলো প্রায় ২ শত কিলোমিটার দীর্ঘ মহীসোপানের কারণে। সুদীর্ঘ এবং অগভীর মহীসোপানের কারণেই বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ সংলগ্ন অংশে সুনামি বা জলকম্প তীব্র রূপ নেয়নি। এই অগভীর মহীসোপান অনেকটা প্রাকৃতিক বাধা হয়ে বাংলাদেশকে বাঁচিয়েছে। কিন্তু তার পরও কথা থেকে যায়। আর সে কথাটি হচ্ছে বাংলাদেশ ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে, কিন্তু এ প্রেক্ষাপটে আমাদের প্রস্তুতি কতটুকু রয়েছে তা আলোচনার দাবি রাখে।

ভূমিকম্প বলতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ধ্বংস স্তূপ, বিধ্বস্ত দালান কোঠা, হাজার হাজার, লাখ লাখ মানুষের মৃতদেহ। লাশের উৎকট গন্ধ, আহতদের আর্তনাদ, ধ্বংস প্রাপ্ত ঘরবাড়ি, বিধ্বস্ত জনপদ এসবই হচ্ছে প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পের পরবর্তী চিত্র। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যার মত ভূমিকম্পও এক প্রাকৃতিক বিপর্যয়। তাই ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ থাকলেও প্রাকৃতিক যে কারণে ভূমিকম্প হয়- তাকে পরিহার করা সম্ভব নয়। ভূমিকম্প সম্পর্কে আবহাওয়ার মত আগাম খবর জানতে উন্নত দেশ সমূহ বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। তবে এ ধরণের আগাম খবরের নির্ভরযোগ্যতা বিজ্ঞানীদের সংশয় দূর করতে পারেনি। ভূমিকম্প প্রবণ দেশ জাপান, চীন ও আমেরিকায় ভূমিকম্পের আগাম সতর্কবাণী পাওয়ার যন্ত্র বসানো রয়েছে। এই যন্ত্র ভূমিকম্প শুরুর কমপক্ষে তিনঘণ্টা আগে ভূ-কম্পনের আগাম সংকেত দেয়। সংকেত পাওয়া মাত্র সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষ এলাকার জনসাধারণকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়। এসব ক্ষেত্রে ভূমিকম্পের আগেই স্থির করা সম্ভব হয় যে, ত্রাণ ও উদ্ধার অভিযান কিভাবে পরিচালিত হবে।

ভূমিকম্প একটি আকস্মিক ঘটনা। ভূমণ্ডলীয় প্লেটসমূহ অব্যাহত ভাবে খুবই ধীর গতিতে নড়ে চলছে এবং একে অপরের সংস্পর্শে চাপের সৃষ্টি করছে। ভূ-আলোড়নজনিত প্রতিক্রিয়া এবং এই চাপের ফলে সঞ্চারিত শক্তি, শিলার ফাটল বা বিচ্যুতি অংশের মাধ্যমে হঠাৎ নিরসনের ফলে যে কম্পন সৃষ্টি হয় তাই ভূমিকম্প। ভূমিকম্পের কারণ সম্পর্কে নানা ধরণের মত বিদ্যমান। তবে এক্ষেত্রে ডঃ রিখটারের তত্ত্ব আধুনিক ও গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছে। ডঃ রিখটারের মতে, ভূ-পৃষ্ঠের নীচে রয়েছে শিলাস্তর এবং প্রতিটি স্তর পাশাপাশি অবস্থিত। কোন কারণে শিলাস্তরে চাপ পড়লে আলগা হয়ে যায় শিলা। স্তর থেকে খসে ভূ-পৃষ্ঠের আরও নীচে চলে যায়। এর ফলে পার্শ্ববর্তী স্তরের তুলনায় এ অংশের অবস্থান পরিবর্তন ঘটে, অর্থাৎ পার্শ্ববর্তী শিলাস্তর নড়ে ওঠে। এই নড়ে ওঠা থেকে ভূপৃষ্ঠে ভূকম্পনের সৃষ্টি হয়, এটি হলো ভূমিকম্প। শিলার স্তরে এ চাপ পড়ে প্রাকৃতিক এবং মানুষের নিজেদের সৃষ্টকারণে পৃথিবীর অভ্যন্তরস্থ উষ্ণ অর্ধ তরল পদার্থের নানা পরিবর্তনের ফলে শিলার স্তরে যে চাপের সৃষ্টি হয় তা প্রাকৃতিক। কিন্তু ভূপৃষ্ঠে তৈরি নানা ষ্ট্রাকচার এবং তার নানা আনুষঙ্গিক অংশ যে চাপ দেয় সেটি মানুষের সৃষ্টি। ১৯৬৭ সালে কয়লা বাধে যে ভূমিকম্প হয়েছিল তা মনুষ্য সৃষ্ট ভূমিকম্পের এক বড় নিদর্শন। বাঁধের স্ট্রাকচারের ভার এবং বাধে সংগৃহীত জল এদু’য়ে মিলে অল্প জায়গায় অস্বাভাবিক চাপের সৃষ্টি করেছিল। শিলাস্তর নাড়িয়ে দিয়ে ছিল একেবারে। এরকম আরও উদাহরণ রয়েছে। তাহলে আমরা ভূমিকম্পের কারণকে দুটি ভাগে ভাগ করতে পারি। ১) প্রাকৃতিক কারণ ও ২) মনুষ্য সৃষ্ট ভূমিকম্প।

পৃথিবীতে প্রায় নব্বই ভাগ ভূমিকম্প হয় মূলত টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষের কারণে। এছাড়াও প্রাকৃতিক কারণগুলি হচ্ছে ১) ভূ-আলোড়নের ফলে ভূ-ত্বকের কোন শিলা ধ্বসে পড়লে বা কোন অংশ নিচে বসে গেলে বা উপরে উঠতে থাকলে চ্যুতির ফলে ঘর্ষণের সৃষ্টি হয়। এই ঘর্ষণের ফলে ভূমিকম্প হয়। ২) তাপ বিকিরণের ফলে ভূ-গর্ভ ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হয়। সংকোচনের ফলে ভূমিকম্প হয়। ৩) ভূ-গর্ভে কোন কারণে বাষ্পের চাপ বৃদ্ধি পেলে ভূ-ত্বকের নি¤œ ভাগে প্রবলভাবে ধাক্কা দেয়। ফলে ভূমিকম্প হয়। ৪) আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের ফলে উর্ধ্বমুখী উত্তপ্ত বাষ্প, লাভা প্রভৃতির চাপে নিকটবর্তী স্থানে ভূমিকম্প হয়। ৫) পাহাড়ের ঢালু অংশে প্রচুর বৃষ্টিপাতের ফলে ভূমিধ্বস হয়, যার কারণে মাঝে মাঝে ভূমিকম্প হয়। মনুষ্য সৃষ্টি ভূমিকম্পের কারণ হলো- ১) পানি ও বিদ্যুৎ জলধারা সৃষ্টির কারণে। ২) ভূ-গর্ভ থেকে খনিজ দ্রব্য উত্তোলনের ফলে এবং ৩) রাসায়নিক ও পারমানবিক বিস্ফোরণের কারণে।

ভূমিকম্পের ফলাফল: ১) কখনও কখনও উপকূলীয় অঞ্চলে বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি করে। ২) কখনও কখনও উচ্চ ভূমিসমূহ পানিতে নিমজ্জিত হয় এবং সমতল ভূমি বসে গিয়ে হ্রদের সৃষ্টি করে। ৩) ভূ-ত্বকে অসংখ্য ফাটল ও চ্যুতির সৃষ্টি করে এবং ভূমি ধ্বস হয়। ফলে বড় বড় অবকাঠামো যেমন- দালান, ব্রিজ, কালভার্ট নিমিষেই ধ্বংস হয়ে যায়। ৪) ভূমি ধ্বংস হয়ে মাটি, বালু ইত্যাদি জমা হয়ে নদীপথ পরিবর্তন বা বন্ধ হয়ে যায়। ৫) সমুদ্রতল উঁচু হয়ে জলের উপর জেগে উঠে এবং শুষ্ক স্থলভাগ গঠন করে। আবার স্থল ভাগের অনেক স্থান সমুদ্রে নিমজ্জিত হয়। তাছাড়া নিম্নলিখিত প্রভাবও পরিলক্ষিত হয়। যথা ঃ ১) বহু মানুষ, গবাদি পশু মৃত্যু হয়। ২) বসতি, নলকূপ, জলধারা ধ্বংস হয় ৩) খাদ্য জলের অভাব দেখা দেয় ৪) বিদ্যুৎ, গ্যাস লাইন ধ্বংস ৫) রাস্তা, বাড়িঘর, দালান ও অবকাঠামো ধ্বংস হয়, ৬) যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয় ৭) আগুন লাগা, বিষক্রিয়া ছড়িয়ে পড়া ৮) আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ৯) শরণার্থী সমস্যা সৃষ্টি ১০) নিরাপত্তাহীনতা ১১) মানসিক অসুস্থতা ১২) রোগবালাই বৃদ্ধি ১৩) দেশের আর্থিক অবস্থার অবনতি ১৪) হঠাৎ বন্যা ১৫) ফসল ধ্বংস ও মাটির উর্বরতা শক্তি হ্রাস এবং ১৬) পরিবেশ ধ্বংস। ভূ-কম্পন মাপার জন্য একটি স্কেল রয়েছে যা নাম রিখটার স্কেল। বিজ্ঞানী রিখটারের নামে এটির নামকরণ করা হয়েছে। রিখটার স্কেল যদি ৫ নির্দেশ করে তবে বুঝতে হবে মৃদু ভূ-কম্পন। পাঁচের উপরে যতই রিখটার স্কেলের পাঠ উপরে যেতে থাকবে ততই বুঝতে হবে ভূ-কম্পনের মাত্রা বাড়ছে। ১৯৮৭ সালে আসামে যে ভূমিকম্প হয়েছিল তার পরিমাণ ছিল ৮ দশমিক ৭ অর্থাৎ রিখটার স্কেলে ৫ থাকলে যে ভূমিকম্প হবে এটি তার ৩০০০ গুণ বেশি। আর গত ২৬ ডিসেম্বর ২০০৪ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ভয়াবহ যে ভূমিকম্প হয়ে গেল তার মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৮ দশমিক ৯। ভূ-কম্পন এবং তীব্রতা নিরূপণের জন্য সাধারণত সিসমোগ্রাফ এবং রিখটার স্কেল ব্যবহৃত হয়।

সিসমোগ্রাফের সাহায্যে ভূ-ত্বকের অনুলিপি প্রস্তুত করা সম্ভব। অপরদিকে ভূ-ত্বকের মাত্রা নিরূপণ করা যায়। World vision Bangladesh তার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সহায়িকা গ্রন্থে রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের যে মাত্রা দেয়া হয়েছে তা নি¤েœ দেয়া হলো- ৮ বা এর চেয়ে বেশি হলে প্রবল, ৭ থেকে ৭ দশমিক ৯ হলে ভয়াবহ, ৬ থেকে ৬ দশমিক ৯ হলে শক্তিশালী, ৫ থেকে ৫ দশমিক ৯ হলে মধ্যম, ৪ থেকে ৪ দশমিক ৯ হলে হালকা, ৩ থেকে ৩ দশমিক ৯ হলে মৃদু এবং ৩ এর কম হলে খুবই মৃদু ভূমিকম্প বলা হয়।

লেভেলিং যন্ত্রের সাহায্যে পৃথিবীর উপরিভাগের অবস্থানের রেকর্ড রাখা হয় এবং কোনো অংশ সামান্যতম বেকে গেল কিনা তাও এ যন্ত্রের সাহায্যে মাপা হয়। তা ছাড়া কুয়োর জলের লেভেল পরিবর্তনের রেকর্ড রেখেও ভূমিকম্পের আগে কোনো পূর্বকম্পন মৃদুভাবেও অনুভূত করা যাচ্ছে এবং তার মাপ কতখানি প্রভৃতি বিষয় নিয়েও অনুসন্ধানের কাজ চলছে। তবে এসব পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে সম্ভাব্য ভূমিকম্প সম্বন্ধে কিছুটা আচ করা গেলেও বিজ্ঞানীদের মতে মাত্র ২০ শতাংশ হয় সঠিক। বিজ্ঞানীরা এজন্য খুব চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত দেন। সম্ভাব্য ভূমিকম্প সম্বন্ধে আগাম খবর পাওয়ার জন্য বিজ্ঞানীদের তীক্ষ্ম দৃষ্টি থাকে ভূ-পৃষ্ঠের প্রাকৃতিক গঠনের দিকে। এর জন্য তারা নিরন্তর চালান জরিপ।

গবেষকরা আরও জানিয়েছেন যে, বাড়ির বিভিন্ন অংশ যত বেশি নমনীয় হবে, ততবেশি ভূ-কম্পন থেকে বাড়িকে রক্ষা করা যাবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এমন বাড়ি তৈরি করতে হবে যার পিলার ভেঙ্গে পড়ার আগে ভিম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অর্থাৎ ভিমটি ভেঙ্গে পড়লেও বাড়ির আকৃতি তখনও থাকবে দাড়িয়ে। কাঠের বাড়ি এ ধারণার জন্য সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত। এছাড়া ভূ-কম্পন প্রবণ এলাকায় পনের তলার ওপর কোন বাড়ি তৈরি করতে হলে রি-ইনফোর্সড কংক্রিটের খাঁচার ওপর নির্ভর না করে লোহার ফ্রেমের ওপর তা তৈরি করা প্রয়োজন। কারণ লোহা নমনীয় ধাতু। ফলে পিলার এবং ভিমে খুঁজে পাওয়া যায় নমনীয়তা। একই সাথে এমন ভাবে পিলার এবং ভিমের ডিজাইন করতে হবে, যাতে পিলার এবং ভিম ভেঙ্গে পড়ার আগে কিছুক্ষণ বেকে থাকে। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, জাপানে বর্তমানে বাড়িগুলো এমন ভাবে তৈরি করা হচ্ছে, যাতে ১০ রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা পৌঁছালেও বাড়িগুলো ভেঙ্গে পড়বে না। উপরন্তু এসব বাড়ির বাসিন্দারা ভূ-পৃষ্ঠের প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতেও বাইরে বেরিয়ে আসবেন না। কারণ বাড়ির ভিতর যতটা নিরাপদ থাকবে বাইরেরটা ততোটা নয়। ভূমিকম্পে এ বাড়ি ভেঙ্গে পড়বে না, শুধু এদিক ওদিক দুলবে। এরকম ভাবে দোলার কারণ বাড়ির ভিত্তিতে থাকবে বিয়ারিং। বিয়ারিং বাড়ির মূলভাব এর ভিত্তি থেকে বিচ্ছিন্ন করে বাড়িটাকে হেলাবে দোলাবে।

একশত বছরে বিশ্বে ভয়াবহ কয়েকটি ভূমিকম্প হতে দেখা যায়- ১) ২২ মে ১৯৬০ সালে চিলিতে রিখটার স্কেলে ৯ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প এবং এর ফলে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে ও আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতে ৫ হাজার লোক নিহত হয়। ২) ২৮ মার্চ ১৯৬৪ সালে আলাস্কা ও ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় ৯ দশমিক ২ মাত্রার ভূমিকম্পে ১২৫ জন নিহত হন। ক্ষতির পরিমাণ ৩১ কোটি ১০ লাখ ডলার। ৩) ৯ মার্চ ১৯৫৭ সালে আলাস্কায় ৯ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্পে ১৫ মিটার উঁচু জলোচ্ছ্বাস হলেও কেউ মারা যায়নি। এছাড়া রাশিয়ায় ১৯৫২ সালের ৪ নভেম্বর ৯ দশমিক শূন্য মাত্রার ভূমিকম্প হয়। তবে প্রাণহানি ঘটেনি। ৪) ২৬ ডিসেম্বর ২০০৪ ইন্দোনেশিয়া থেকে শ্রীলঙ্কা পর্যন্ত ৮ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্পে নিহত হয় প্রায় ২ লক্ষ ৫) ৩১ জানুয়ারি ১৯০৬ সালে ইকুয়েডর ও কলম্বিয়া উপকূলে ভূমিকম্প ও এর ফলে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে ১ হাজার লোকের মৃত্যু হয়। ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৮ দশমিক ৮। ৬) ৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৫ সালে আলাস্কায় ৮ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প ও ১০ দশমিক ৭ মিটার উঁচু জলোচ্ছ্বাস ৭) ১৫ আগস্ট ১৯৫০ সালে উত্তর পূর্ব ভারতে ভূমিকম্পে কমপক্ষে দেড় হাজার লোক নিহত হয়। ধ্বংস হয় দুই হাজার ঘরবাড়ি, মসজিদ ও মন্দির। ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৮ দশমিক ৬। ৮) ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯২৩ সালে রাশিয়ায় হয় ৮ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প। ৯) ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৮ সালে ইন্দোনেশিয়ায় ৮ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।

বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ভূমিকম্পের নির্দিষ্ট বলয় থাকলে, সীমাবদ্ধ থাকলেও পৃথিবীর এমন কোন জায়গা নেই, যা ভূমিকম্প থেকে সুরক্ষিত। সুতরাং এর থেকে বাচার ও সম্ভাব্য বিপর্যয় এড়াতে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্তরে প্রশমন কার্যক্রম নিতে হবে। উন্নত বিশ্বে এই প্রশমন কার্যক্রম নিয়ে নানা গবেষণা চলছে এবং নানা কর্মশালাও অধ্যয়নের মাধ্যমে ভূমিকম্পের মোকাবেলায় করণীয় এবং গণসচেতনতা ও নিরাপদ আবাসভূমির জন্য নানা কর্মসূচী নেয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশ বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের দেশ হিসাবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করলেও এদেশের কিছু অংশ খুবই ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা। বিগত দুই শতাব্দীতে বাংলাদেশ কিছু মাঝারি থেকে প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পের সম্মুখীন হয়েছে। প্রায় প্রতি বছরই ২৪ থেকে ৩৬ টি ভূমিকম্প হচ্ছে। বাংলাদেশে বিগত ৬ বছরে ১৬৭ বার ভূমিকম্প হয়েছে বলে জানা যায়। ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের মতে বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ৪০টি ভূমিকম্প হয়। এসব ভূমিকম্পের বেশ কয়েকটির উৎপত্তি স্থল বাংলাদেশের ভিতরে।

ভূমিকম্পের সম্ভাব্যতা এবং তীব্রতা অনুযায়ী বিভক্ত বাংলাদেশের তিনটি বলয়ের মধ্যে প্রথম বলয়ে সিলেটের অবস্থান। বিশেষজ্ঞরা একে প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্প বলয় বলে চিহ্নিত করেছেন। এ দুর্ভাবনা আরও প্রকট হয়েছে বিগত ২০০১ সালের জানুয়ারিতে ভারতের গুজরাটে সংঘটিত ধ্বংসলীলার পর। বিশেষজ্ঞদের মতে আসাম বেল্ট হলো খুবই ভূমিকম্প প্রবণ। সম্প্রতি ভারতের ভূ-বিজ্ঞানী ড. নেন্সি বলেন- আসাম, ত্রিপুরা, মিজোরাম, শিলং, মেঘালয়, কলকাতা ও বাংলাদেশের সিলেট ও চট্টগ্রাম জেলায় একটা ভয়াবহ ভূমিকম্পের সম্ভাবনা রয়েছে। তাছাড়া ভূ-তাত্ত্বিকগণ জানান, ইন্ডিয়ান প্লেট ও মায়ানমার সাব প্লেট পরস্পরের দিকে প্রতি বছর ১১ থেকে ১৬ মিলিমিটার অগ্রসর হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা আরও জানান আসাম থেকে শুরু করে ঢাকার পাগলা পর্যন্ত রয়েছে লিনিয়াসেন্ট। এই লিনিয়াসেন্ট পূর্ব আসাম ডাউকি ডেঞ্জার ফল্টের সাথে সংযুক্ত। এই ডেঞ্জার ফল্ট লাইনে অবস্থান করছে সিলেট। তাছাড়া ১৮৬৫ সাল থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ৭৬৫টি ভূমিকম্প হয়েছে বাংলাদেশে যাদের ইপিসেন্টারের দূরত্ব সিলেট শহর থেকে ৩০০ কি.মি. এর বেশি নয়। এদের মধ্যে ১৮৬৯ সালের কাছার ভূমিকম্প (মাত্রা ৭.০, দূরত্ব ২৩৫ কি: মিঃ) ১৮৯৭ সালের গ্রেট ইন্ডিয়ান ভূমিকম্প (মাত্রা ৮.৭, দূরত্ব ১৫০ কি: মিঃ) ১৯১৮ সালের শ্রীমঙ্গল ভূমিকম্প (মাত্রা ৭.৬, দূরত্ব ৭০ কি: মিঃ) ১৯৩০ সালের ডুবরী ভূমিকম্প (মাত্রা ৭.৫, দূরত্ব ৪০০ কি: মিঃ) এর প্রত্যেকটিতে সিলেট জেলার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ভূমিকম্পের সেই ইতিহাস ভবিষ্যতের ভয়াবহ ভূমিকম্প সম্ভাবনাকে ইঙ্গিত করে।

ভূমিকম্পকে মোকাবেলা করার একমাত্র বিষয় হচ্ছে ব্যবস্থাপনা বা পূর্ব প্রস্তুতি। কিন্তু আমাদের যথেষ্ট পূর্ব প্রস্তুতি নেই। সিলেট অঞ্চল ভূমিকম্পের ডেঞ্জার জোন হিসাবে ব্রিটিশ আমলেও পরিচিত ছিল। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পের পর বৃহত্তর সিলেটে বহুতল ভবন নির্মাণ হ্রাস পায়। কিন্তু বর্তমানে সিলেট মহানগরে জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাপ, আর্থিক সচ্ছলতা, ব্যবসায়িক মনমানসিকতার কারণে বহুতল ভবন নির্মাণের প্রবণতা ও প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাছাড়া এখানকার রাস্তাঘাট, গলিসমূহ খুবই অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। সিলেটের প্রায় সর্বত্রই গ্যাস লাইন, পানি লাইন, বিদ্যুৎ লাইন, টেলিফোন লাইন, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা সব কিছুই মান্ধাতার আমলের। রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট কোন কিছুই অক্ষত থাকার কথা নয়। বড়মাত্রার ভূমিকম্প হলে সিলেট মহানগর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে পারে। সিলেট যেহেতু ভূমিকম্পের প্রথম বলয়ে অবস্থিত সেহেতু সিলেটের জনগণ ভূমিকম্প ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কতটুকু অবগত এবং ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত তা আমাদের জানা নেই। ফলে বড় ধরণের ভূমিকম্প হলে উদ্ধার কর্মটি সার্বিকভাবে কাজ সম্পাদন না করা হলে, ২২ নভেম্বর ১৯৯৭ সালের চট্টগ্রাম ভূমিকম্পে ধ্বসে পড়া বহুতল ভবনে আটকে পড়া মেয়েটির মতো মারাত্মক অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। ভূমিকম্পের যেহেতু কোন পূর্বাভাস এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি, তাই এর জন্য প্রস্তুতি জোরদার করা প্রয়োজন যাতে করে জানমালের ক্ষতি কমানো যায়। জনসাধারণ যাতে তাৎক্ষণিক একটা ঘটনায় হতভম্ভ হয়ে ছোটাছুটি না করে, যথাসময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সেজন্য তাদের সচেতন করা প্রয়োজন। মিডিয়ার মাধ্যমে ব্যবস্থাপনা বিষয়ক কিছু তথ্য জনগণকে জানালে তারা উপকৃত হবেন।

বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম ভূমিকম্প প্রবণ বলয়ে অবস্থিত। বিগত কয়েক বছরে আমরা কয়েকটি ভয়াবহ ভূমিকম্পের ধ্বংসলীলার সম্মুখীন হয়েছি। প্রতি বছর গড়ে হাল্কা ও মাঝারি প্রায় ২৪-৩৬টি ভূমিকম্প অনুভূত হয়। বাংলাদেশে বিগত ৬ বছরে ১৬৭ বার ভূমিকম্প হয়েছে বলে জানা যায়। ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ৪০টি ভূমিকম্প হয়। তবে এ পরিসংখ্যানে অমিল রয়েছে কারণ বাংলাদেশে একটিমাত্র ভূমিকম্প মাপার যন্ত্র দ্বারা সঠিক উপাত্ত পাওয়া কঠিন। তাছাড়া এটি প্রায় সময়ই বিকল থাকে। সিলেটে ১২১ বছর পূর্বে ১৮৯৭ সালের ১২ই জুন যে ভূমিকম্প হয় তা ছিল স্মরণকালের উল্লেখযোগ্য ভূমিকম্প। এর মাত্রা ছিল রিক্টার স্কেলে ৮.৭। তাতে জান মালের ব্যাপক ক্ষতি হয়। বর্তমানে যদি এ ধরনের ভূমিকম্প আবার হয় তবে তার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কি হবে তা অকল্পনীয়। কারণ ১২১ বছর পূর্বে সিলেট নগর সভ্যতা ও আজকের নগর সভ্যতার মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। ১৯৯৭ সালের ৮ই মে যে ভূমিকম্প হয় তার মাত্রা ছিল রিক্টার স্কেলে ৫.৬। এর ফলে সিলেট বিমান বন্দরের বিল্ডিং, জৈন্তিয়াপুর কলেজ, বড়লেখার গ্রামীণ ব্যাংকের অফিস ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

সিলেট মহানগরে বর্তমান লোক সংখ্যা ৩ লক্ষের বেশি। বিভিন্ন কারণে দেশের অন্যান্য স্থান থেকে এখানে এসে বসতি স্থাপনের ফলে এ সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। ফলে গড়ে উঠেছে নতুন বসতি। জনগণের একাংশের হাতে প্রচুর অর্থ থাকার কারণে নির্মিত হচ্ছে বহুতল ভবন, যার অধিকাংশই গড়ে উঠছে অপরিকল্পিতভাবে, অব্যবস্থাপনায়। ছোট ছোট গলির দু পাশে বহুতল ভবন সিলেটকে একটি ঘিঞ্জি শহরে পরিণত করছে। অনেকের মতে বর্তমানে যে পরিমাণ হাইরাইজিং বিল্ডিং তৈরি হচ্ছে এতে রিক্টার স্কেলে ৬ এর অধিক মাত্রায় ভূমিকম্প হলে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে, ভেঙ্গে দিতে পারে বিদ্যমান সকল অবস্থানিক কাঠামোকে। তাই ভূমিকম্প মোকাবেলা, জনগণের সচেতনতা সৃষ্টি, জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কমানো, বিভিন্ন তথ্য আদান প্রদান বিষয়ক গবেষণার যৌক্তিকতা রয়েছে।

আধুনিক নগর সভ্যতার বিরূপ প্রভাব সিলেট মহানগরেও পড়ছে। অপরিকল্পিত নগরায়ন, ছোট ছোট গলি, মূল রাস্তা থেকে দূরত্বহীন বহুতল ভবন, ভবন নির্মাণে নির্মাণ আইন লঙ্ঘন ইত্যাদি কারণে সিলেট সিটি কর্পোরেশন একটি গিঞ্জি শহরে পরিণত হচ্ছে।

সিলেট প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্প বলয়ে অবস্থিত হওয়ায় সিলেটের জনমানসে ভূমিকম্প সম্পর্কে একটি ভীতি ছড়িয়ে পড়ছে। আর তা অমূলকও নয়। ভারতের গুজরাটের ধ্বংসলীলার পর তাদের ভীতি আরও প্রকট হয়েছে। আর অতি সাম্প্রতিক সুনামি নামক ভূমিকম্প জলোচ্ছ্বাস আমাদের এ ভীতিকে আরও বেশি প্রকটতর করেছে। সিলেট শহরে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে কি পরিমাণ ধ্বংস যজ্ঞ হবে তা অকল্পনীয়। ভূমিকম্পকে আমরা প্রতিরোধ করতে পারব না, শুধু এ থেকে ব্যাপক প্রাণহানি ও সম্পদ ধ্বংস হ্রাস করতে পারি। এর জন্য দরকার সুসমন্বিত ভূমিকম্প ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলার ব্যবস্থাপনা। ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় উন্নত ও কার্যকর ব্যবস্থাপনার জন্য পূর্ব প্রস্তুতির বিকল্প নেই। পূর্ব প্রস্তুতির মাধ্যমে ভূমিকম্পের মত আকস্মিক দুর্ঘটনায় ব্যাপক প্রাণহানি ও সম্পদ ধ্বংস কমিয়ে আনতে পারে। জনগণকে ভবন নির্মাণ আইন সম্পর্কে সচেতন করে তোলা, ভবন নির্মাণে প্রকৌশলীর পরামর্শ নেয়া, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের করণীয়, তাদের পরামর্শ ভূমিকম্প মোকাবেলার ক্ষেত্রে জোরালো ভূমিকা রাখবে।

সিলেট মহানগরে বহুতল ভবন নির্মাণে ভূমিকম্প মোকাবেলা: একটি সমীক্ষা গবেষণায় সিভিল সোসাইটির নীতি নির্ধারকদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় আমাদের কোন প্রস্তুতি নেই। তারা অভিমত ব্যক্ত করেন যে, আমাদের ভূমিকম্পের পূর্বাভাস কেন্দ্র নাই, প্রশিক্ষিত কর্মী নাই, উদ্ধার কাজের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নাই, আশ্রয়কেন্দ্র নাই, এমনকি জনগণকে সচেতন করার জন্য সরকারি ও বেসরকারিভাবে কোন উদ্যোগ নাই। এর কারণ হিসাবে যে বিষয়গুলো উল্লেখ করেছেন তা হলো দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বহীনতা, যেহেতু স্মরণকালের মধ্যে দেশে কোন বড় ভূমিকম্প হয়নি সেহেতু বড় ভূমিকম্প হলে এর ক্ষয়ক্ষতি কি পরিমাণ হবে তার পরিষ্কার ধারণা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নেই, জনগণের সচেতনতা ও মিডিয়ার দায়বদ্ধতার অভাব রয়েছে। বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ার ও ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মদের মধ্যে ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়। তারা মাটি পরীক্ষায় গুরুত্ব দেন না, গণহারে সব জায়গা পাইলিং করতে বলেন। এতে যে জায়গায় পাইলিং করা দরকার সে জায়গায় পাইলিং হচ্ছে না এবং যে জায়গায় পাইলিং করার দরকার নাই সে জায়গায় পাইলিং হচ্ছে। ফার্মগুলোতে বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীর অভাব, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার দ্বারা ফার্ম পরিচালনা এবং তাদের ব্যবসায়িক মনমানসিকতার কারণে ভূমিকম্প সহনশীল বহুতল ভবন নির্মাণ হচ্ছে না।

ভূমিকম্পে করণীয়: ১) ভবন, সেতু ও অন্যান্য অবকাঠামোর নকশা প্রণয়ন এবং নির্মাণে ভূমিকম্প প্রতিরোধ ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা। সে জন্য বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীর পরামর্শ নেয়া এবং বিল্ডিং কোড মেনে চলা। ২) শক্ত মাটিতে বাড়ি তৈরি, পাকা ভবনে শক্ত ভিত দেয়া এবং বাড়ি নির্মাণে প্রকৌশলীর পরামর্শ নেয়া ৩) ঘর থেকে বের হওয়ার জন্য অধিক দরজা ও বহির্গমন সিঁড়ি রাখা ৪) নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে ভবন তৈরি করা। ৫) নিরাপদ বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির লাইন সংযুক্ত। ৬) গ্যাসের চুলা ব্যবহারের পর নিভিয়ে ফেলা। ৭) অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রপাতি চালনা/ব্যবহার সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা। ৮) বাড়ি তৈরির আগে ঐ অঞ্চলের ভূ-তাত্ত্বিক অবস্থা, একটিভ ফল্ট ভূমির গঠন ইত্যাদি ব্যাপারে খোজ নেয়া। ৯) ভারি জিনিস উপরে তুলে না রেখে মেঝের কাছাকাছি রাখা। ১০) ঘরে হেলমেট রাখা, শক্ত টেবিল, খাট, ডেস্ক ইত্যাদি তৈরি করা। ১১) দালান, কোঠা ভাড়া নেয়ার আগে তা যথাযথ ভাবে নির্মিত হয়েছে কি না তা জেনে নেয়া। ১২) ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় সকলের ব্লাড গ্রুপ জেনে রাখা। ১৩) মাইক্রোজোনিং এর মাধ্যমে এক একটা এলাকাকে নিয়ে রিস্ক এসেসমেন্ট’ করা। ১৪) বিভিন্ন অঞ্চলে আলোচনা সভা ও মিডিয়ার মাধ্যমে ভূমিকম্প মোকাবেলা সংক্রান্ত তথ্য প্রচার করা। ১৫) ভূমিকম্প ব্যবস্থাপনাকে স্কুল-কলেজে অবস্থান অনুযায়ী ছাত্র ছাত্রীদের পাঠ্যসূচীর অংশ করা ১৬) উদ্ধার কাজ সমাপ্ত/ পরিচালনা করার জন্য পর্যাপ্ত জনবল ও যন্ত্রপাতি নিশ্চিত করা।

ভূমিকম্প চলাকালীন প্রস্তুতি: ১) যথা সম্ভব মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ করা এবং যত দ্রুত সম্ভব বৈদ্যুতিক ও গ্যাস মেইন সুইচ বন্ধ করা। ২) দ্রুত ঘর থেকে বের হওয়া ও খোলা জায়গায় আশ্রয় নেয়া। বহুতল দালান হলে এবং উপর তলায় অবস্থান করলে কম্পন ও ঝাঁকুনি থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করা এবং ঝাঁকুনি থামার সাথে সাথে সিঁড়ি দিয়ে ঘরের বাইরে যাওয়া ৩) বের হওয়া সম্ভব না হলে দরজার চৌকাঠ, শক্ত টেবিল বা ডেস্কের নীচে আশ্রয় নেয়া এবং মাথা যথাসম্ভব বাঁচানোর চেষ্টা করা ৪) কলাম দেয়া পাকা ঘর হলে ঘরের কলামের গোড়ায় এবং ইটের গাঁথুনির পাকা ঘর হলে ঘরের কোণে আশ্রয় নেয়া ৫) ভারী ফার্নিচার, আলমারি, বুকশেলফ ও জানালা থেকে দূরে থাকা। রাস্তায় চলন্ত অবস্থায় রিক্সা, ট্রেন, বাস বা অন্যান্য যানবাহনে থাকলে তৎক্ষণাৎ তা যথাস্থানে দাড় করিয়ে রেখে এর ভিতরেই অবস্থান করা।

ভূমিকম্পের পরবর্তী ব্যবস্থা: ১) ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রথমেই বাড়ির গ্যাসের চাবি ও বিদ্যুতের মেইন সুইচ বন্ধ করা ২) আগুন লাগলে নেভাতে চেষ্টা করা এবং দ্রুত ফায়ার ব্রিগেড ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগে খবর পাঠানো, যাতে তারা এসে দ্রুত উদ্ধার কাজ শুরু করতে পারে। ৩) উদ্ধার কাজে সহায়তা করা ৪) আহতদের দ্রুত হাসপাতাল, ক্লিনিকে ভর্তি করা এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করা ৫) উদ্ধারকৃত লোকদের পুনর্বাসন করা, তাদের প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য, পানীয় জলের ব্যবস্থা করা ৬) বাড়ীর ভাঙ্গা, ফাটল, ফাটা দেয়াল ইত্যাদির ব্যাপারে খোজ নেওয়া ৭) স্বজনহারা, আহত ব্যক্তিদের Emotional Support করা। ৮) সতর্কতার সাথে উদ্ধার কাজ সম্পাদন করা ৯) বাড়িতে পুনঃ প্রবেশের আগে অফিসিয়াল চেকিং করা।

এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী বাংলো টাইপের টিনশেড ঘর সিলেট শহরে তেমন একটা আর দেখা যায় না। বর্তমানে যেদিকে দু’চোখ যায় শুধু বহুতল ভবন। এখানে নগর সভ্যতা গড়ে উঠছে দ্রুত, অপরিকল্পিত ভাবে। ছোট ছোট গলি, সংযুক্ত ভবন সিলেট শহরকে ঘিঞ্জি শহরে পরিণত করেছে। সিলেট শহরে ব্যাঙের ছাতার মতো ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম গড়ে উঠছে, এই সকল ফার্মের অধিকাংশ পরিচালক ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার। তারাই বহুতল ভবনের প্লান করছেন, ডিজাইন করছেন। এসব ফার্মে বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীর উপস্থিতি নেই বললেই চলে। সিলেট শহরে সয়েল টেস্ট করার যে সকল প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাদের অনেকেরই নিজস্ব ল্যাবরেটরি নেই। তারা অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে সয়েল টেস্ট করান। অথচ অনুমোদন নিয়ে বসে আছেন। অধিকাংশ বিল্ডিংয়ে জাতীয় বিল্ডিং কোড অনুসরণ করে করা হয় না। যে গুলি করা হয় তাতে কতটুকু অনুসরণ করা হয় তা ভাবার বিষয়। সিটি কর্পোরেশন বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ভবন নির্মাণে অনুমোদনের ক্ষেত্রে যথাযথ নিয়ম পালন করছেন কি না তাতেও সন্দেহ থেকে যায়। বাংলাদেশে বর্তমানে আটটি সিটি কর্পোরেশন রয়েছে। তাদের মধ্যে অন্যতম সিটি কর্পোরেশন হচ্ছে সিলেট সিটি কর্পোরেশন। দেশের অন্যান্য সিটি কর্পোরেশনের মত সিলেট সিটি কর্পোরেশন উন্নত নাগরিক জীবনের সুবিধার্থে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাস্তাঘাট নির্মাণ, মেরামত, বাসস্থান, কর্মসংস্থানের সুযোগ, গৃহ নির্মাণ কার্য নিয়ন্ত্রণ, বিশুদ্ধ পানীয় সরবরাহ, পয়নিষ্কাশন সুবিধা, নগর পরিকল্পনা, নাগরিক সচেতনতাসহ যাবতীয় কার্যাবলী সম্পাদন করে থাকে। যেহেতু সিলেট ভূমিকম্পের প্রথম জোনে অবস্থিত এবং আজ থেকে একশ একুশ বছর পূর্বে একটা প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্প সিলেট শহরে আঘাত হেনেছিল, সেহেতু যে কোন সময় সিলেট শহরে বড় মাত্রার ভূমিকম্পের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না।

একথা সত্য যে সিটি কর্পোরেশন এলাকায় কোন ভবন নির্মাণ করতে হলে অবশ্যই সিটি কর্পোরেশনের অনুমোদন নিতে হয়। সিটি কর্পোরেশন ১৯৭৭ সালের অধ্যাদেশের আওতাধীন ম্যানুয়াল অনুসরণ করে ভবন নির্মাণের অনুমোদন দিয়ে থাকেন। কিন্তু উক্ত ম্যানুয়ালে ভবন নির্মাণ সংক্রান্ত কোন স্ট্যান্ডার্ড গাইড লাইন নেই। এমনকি এতে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় নিরাপদ ভবন নির্মাণের কোন দিক নির্দেশনা নেই। তাই এই ম্যানুয়াল অনুসরণ করে ভবন নির্মাণে অনুমোদন দিলে ভূমিকম্প সহনশীল ভবন নির্মাণ আশা করনা যায় না। প্রকৌশলীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, সিলেট শহরে ৩০ হাজারের অধিক ভবন রয়েছে, এদের মধ্যে ৮০-৯০% ভবনের অনুমোদন কর্তৃপক্ষ দিয়েছে। সিলেট সিটি কর্পোরেশন যে সকল বিল্ডিং নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছেন সে সকল বিল্ডিং অনুমোদন অনুসারে নির্মাণ হচ্ছে কি না তা তদারকি করার দায়িত্ব সিটি কর্তৃপক্ষের। সিটি কর্পোরেশনের নিয়ম অনুযায়ী মূল রাস্তা থেকে ভবনের দূরত্ব ৩ মিটার, গলি থেকে রাস্তার দূরত্ব ১.২৫ মিটার। কিন্তু প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, অর্ধেকের চেয়ে বেশী ভবন মালিক এ নিয়ম মানছেন না। না মানার কারণ হিসাবে জানা যায়, প্লটে জমির পরিমাণ কম। ভবন মালিকদের অনিচ্ছা, অসচেতনতা প্রভৃতি এর পেছনে কাজ করে। উক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সিটি কর্পোরেশন বহুতল ভবন নির্মাণে অনুমোদন দান ও মনিটরিং, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে জোরালো ভূমিকা পালন করছে না। তাই সিটি কর্পোরেশনকে বহুতল ভবন নির্মাণের অনুমোদন দান, মনিটরিং ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ১৯৯৩ সালের জাতীয় বিল্ডিং কোডকে আইনে পরিণতকরণ সহ সিটি কর্পোরেশনের নিজস্ব ম্যাজিস্ট্রেটের ব্যবস্থা করতে হবে। ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে যে সকল প্রকৌশলী ও ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম রয়েছে তাদের তালিকাভুক্ত করণ ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। অনুমোদিত বিল্ডিং গুলোর মনিটরিংয়ের জন্য পর্যাপ্ত জনবল রাখতে হবে। সরকারের সকল বিভাগের মধ্যে সমন্বয় সাধন এবং জনগণকে সচেতন করার উদ্যোগও গ্রহণ করতে হবে। একটি গবেষণার ফলাফলের প্রেক্ষিতে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়, ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় সিলেট মহানগরীর নাগরিকবৃন্দের তথা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথেষ্ট প্রস্তুতি নেই। সিলেট যেহেতু একটি ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চল তাই বড় মাত্রার কোন ভূমিকম্প হলে শহরের অবস্থা কি ভয়াবহ হবে তা এখনও অচিন্তনীয়। তাই ভূমিকম্প ব্যবস্থাপনাকে অবশ্যই জোরদার করতে হবে। এক্ষেত্রে পূর্ব প্রস্তুতি হলো সহজ সমাধান। পূর্ব প্রস্তুতির প্রথম পর্যায়টি হলো গণ সচেতনতা। সরকারি ও বেসরকারিভাবে গণসচেতনতার জন্য পদক্ষেপ ভূমিকম্পের প্রাণহাণী ও সম্পদ ধ্বংস প্রশমনে ভূমিকা রাখবে।

সিলেটে ভূমিকম্পের সমূহ সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও ভূমিকম্পের উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। অথচ দ্রুত উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। উদ্ধার কার্যের জন্য দরকার যথেষ্ট জনবল, প্রশিক্ষণ, পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি। গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে অধিকাংশ ভবন মালিক সিটি কর্পোরেশনের নির্দিষ্ট নিয়ম ভবন নির্মাণে মানছেন না। তাই সিটি কর্পোরেশনকে এ ব্যাপারে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। তবে এ কথা সত্য যে, সরকার, জনগণ ও একই সাথে ব্যক্তিমালিকাধীন সেক্টরে চিন্তায়, মননে ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না আনা পর্যন্ত একক ভাবে কেবলমাত্র নির্মাণ ক্ষেত্রে আইন প্রণয়ন ও বিল্ডিং কোডের প্রয়োগ ভূমিকম্পের হাত থেকে প্রাণহানি ও সম্পদ ধ্বংস প্রশমন সম্ভব নয়। তাই ভূমিকম্প ব্যবস্থাপনাকে একটি সামাজিক আন্দোলনের রূপ দিতে হবে।।

  • মোহাম্মদ কামরুল আনাম চৌধুরী: সেক্রেটারি, কলেজ শিক্ষক পরিষদ, সিলেট। ইমেইল: [email protected]

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.