Sylhet Today 24 PRINT

শারদীয় দুর্গাপূজা: জগতের আনন্দযজ্ঞ

অজয় রায়  |  ০৬ অক্টোবর, ২০১৯

মা যেমন সন্তানের জীবনের সবচেয়ে প্রিয় শব্দ, তেমনি মা ও সন্তানের মিলনোৎসব শারদীয় দুর্গাপূজাও বাঙালি সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জীবনের সবচেয়ে বড় ও প্রিয় উৎসব। বাঙালি শব্দটা এখানে আলাদাভাবে উল্লেখ করার কারণ হলো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রূপে দুর্গাপূজা উদযাপিত হলেও এই বঙ্গদেশে দুর্গাপূজা ধর্মীয় গন্ডী পেরিয়ে বাঙালির আবহমান কালের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সত্তায় পরিগণিত হয়েছে। এ উৎসবের আয়োজন, ব্যপ্তি, আঙ্গিক, পদ্ধতি, উপাচারই এর মূল কারণ।

পুরোহিত থেকে শুরু করে কুমার, নট্ট,মালাকার,মালী ধোপা,নাপিত সকল শ্রেণির মানুষেরই প্রয়োজন এ পূজাতে। তাই দুর্গোৎসব একটি মহামিলনের ক্ষেত্র, বিশ্ব ভাতৃত্বের মিলনভূমি ও প্রেরণার উৎস। দেবীভক্তগণ এ পূজাকে বলেন কলির অশ্বমেধ। অর্থাৎ  ত্রেতা ও দ্বাপরযুগে নৃপতিগণ অশ্বমেধ যজ্ঞ করে যে পুণ্য সঞ্চয় করতেন,কলিকালে দুর্গাপূজায় অনুরূপ পুণ্য সঞ্চিত হয়।

এই পূজা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন-
“চিত্রগুপ্ত ডেকে বলে ,বড় শক্ত বুঝা
যাকে বলে ভালবাসা তাকেই বলে পূজা”

অর্থাৎ ভালবাসা নিয়ে, হৃদয়ের সমস্ত শুভাঞ্জলি নিয়ে নিজেকে সমর্পণ করাই পূজা। সহজভাবে বললে পূজা অর্থ আরাধনা বা উপাসনা,আর দুর্গা অর্থে দুর্গতিনাশিনী দেবীকে বোঝায়। অর্থাৎ যিনি দুর্দশা বা দুরবস্থা থেকে পরিত্রাণ করেন। তাহলে দুর্গাপূজা হচ্ছে দুর্গতিনাশিনী দেবীর আরাধনা।

শুধু ভালবাসা নয় দুর্গাপূজার একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে এর আগমনী কল্পনা ও পরিকল্পনা তথা প্রস্তুতিপর্ব। শরৎকাল কাশবন, নির্মল আকাশ, শিউলিফুলের গন্ধ এবং শিশু কিশোরদের প্রাণচঞ্চল আলাপচারিতার বার্তা যেন আগে থেকেই দুর্গা দেবীর আগমনীর শুভসূচনা করে। দেবী দুর্গার এ মর্ত্যে আগমনকে বাঙালি পিতা মাতারা তাদের বিবাহিতা ঘরের মেয়ের ঘরে আসার সাথে সমার্থক করে দেখে থাকে। আবার দুর্গাপূজার চালচিত্র বা কাঠামো যৌথ পারিবারিক মিলনমেলার চিত্রই বহন করে। যা বাঙালি সংস্কৃতি এক অনবদ্য নির্যাস। এভাবেই দেবী দুর্গা মায়ের পূজার আবেদন সাধারণ মানুষের কাছে চিরকালীন হয়ে আছে এবং থাকবে।

ইতিহাসের সাক্ষ্য অনুযায়ী বছরে দুবার দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। শরতে শারদীয়া দুর্গাপূজা ও বসন্তে বাসন্তীপূজা। মেধামুনির আশ্রমে রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য কর্তৃক প্রথম প্রতিমায় পূজাই বাসন্তীপূজা নামে পরিচিতি লাভ করে। আবার শ্রীরামচন্দ্র কর্তৃক রাবণ বধ করে সীতা উদ্ধারের জন্য দক্ষিণায়নে (দেবতাদের শয়নকালে) অর্থাৎ শরৎকালে একশত আটটি নীলপদ্মে পূজিতা হন দেবী। তাই আমাদের শারদোৎসব বা শারদীয় দুর্গোৎসব। রামচন্দ্র দেবতাদের শয়নকালে দেবীকে নিদ্রা থেকে জাগ্রত করে পূজা করেছিলেন বলে এটি অকালবোধন নামেও পরিচিত।

দুর্গা প্রতিমার কল্পনা কতদিনের তা সঠিকভাবে জানা না গেলেও প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন সময়ে মাতৃপূজা তথা শক্তিপূজার প্রচলন এদেশে ছিল। সিন্ধু উপত্যকায় আবিষ্কৃত প্রাগৈতিহাসিক যুগের অসংখ্য পোড়ামাটির স্ত্রী মূর্তিগুলো মাতৃমূর্তির সুদূর অতীতকালের নিদর্শন। বাংলায় দুর্গাপূজার তথ্যানুসন্ধানে জানা যায় যে, মোঘল সম্রাট আকবরের সুবাদার রাজা কংস নারায়ণ রায় বাংলার দেওয়ান ছিলেন। তিনি পণ্ডিত রমেশ শাস্ত্রীর পরামর্শে মহাযজ্ঞ না করে দুর্গাপূজা করেছিলেন। ব্যক্তিগত পূজায় যখন সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার সীমিত হয়ে পড়ে তখনই প্রয়োজন দেখা দেয় সকলের অংশগ্রহণে সার্বজনীন পূজার। সার্বজনীন দুর্গোৎসবের শুরুটা হয়েছিল ১৭৯০ সালে হুগলী জেলার গুপ্তি পাড়া গ্রামের বারো জন বন্ধুর সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। বারো জন বন্ধু বা ইয়ার মিলে পূজার আয়োজন করেছিল বলেই পূজার নাম হয়েছিল বারোয়ারি পূজা যা আজকে সার্বজনীন পূজা রূপে পরিগণিত।

অপরদিকে শোষণ, শাসন এবং আধিপত্য বাদ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সম্মিলিত মানুষের শক্তির পুঞ্জীভূত প্রতীক হিসেবেও  দুর্গাপূজার আবির্ভাব ঘটে। উদাহরণ স্বরূপ ইংরেজ শাসকের নাগপাশ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেনের দুর্গাপূজা,শিখ ধর্মগুরু ভগত সিং এর দুর্গাপূজা ইত্যাদি। দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করার জন্য স্বদেশী বিপ্লবীদের কালীপূজোয় শপথবাক্য পাঠ আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

এখানে দুর্গামাতাকে দেশমাতা হিসেবে দেখায় অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। দুর্গাপূজার উপকরণ,পদ্ধতি সর্বোপরি ভাবার্থ আমাদেরকে বিশ্বজোড়া মানবজাতির ঐকতানের মেলবন্ধনের শিক্ষা দেয়। শিক্ষা দেয় ধনী , মধ্যবিত্ত, দরিদ্রকে এক সুতোয় গাথার। সৃষ্টির প্রতীক, সমৃদ্ধির প্রতীক নারীকে দুর্গা, লক্ষ্মী,কালী, জগদ্ধাত্রী, অন্নপূর্ণা, সরস্বতী, বাসন্তীরূপে বন্দনা করার সূত্রপাতও ঘটে এ পূজা থেকেই।

এমনি করেই দেবী দুর্গার আগমনে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র তথা জগত হয়ে উঠে আনন্দযজ্ঞের এক মূলবেদী। কাজেই দুর্গাপূজা কেবলই এক ধর্মীয় উৎসব নয়, এর সামাজিক তাৎপর্যও অপরিসীম। পরিশেষে অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবি কাজী নজরুলের সুরেই মাকে আহবান করি-

দশভূজে দশপ্রহরণ ধরি,আয় মা দশদিক আলো করি
দশ হাতে আন কল্যাণ ভরি, নিশীথ শেষে ঊষা গো।
জাগো যোগমায় জাগো,মৃন্ময়ী চিন্ময়ী রূপে জাগো...

  • লেখক: অজয় রায়, আবৃত্তিশিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মী।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.