Sylhet Today 24 PRINT

একজন সৈয়দ মহসীন আলী : অন্তিম যাত্রাপথে

ঝুমুর রায় |  ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

'বনে যদি ফুটল কুসুম নেই কেন সেই পাখি কোন সুদূরের আকাশ হতে আনব তারে ডাকি...'

না, আর কোন ডাক কোনদিন ফিরাবে না তাকে! এ যে অসীমের পানে ছুটে চলা, এ যে অন্তিম যাত্রা! ওই অমৃতলোকের ডাক এলে সাধ্যি কী ধরে রাখার! যেতে দিতেই হয়, কিন্তু এভাবে যাওয়া বড় করুণ হয়ে বাজে বুকের গহীনে, কাঁদায় নিরন্তর!

সৈয়দ মহসিন আলী, আমার প্রিয় শহরের প্রিয় এক নাম। প্রায় প্রতিটি ঘরে যার পদচারণা, প্রতি পরিবারে যার স্নেহের ছোঁয়া, পরম বন্ধু, প্রিয়জন। মন্ত্রী বটে, কিন্তু কবে থেকেই যে শহরবাসীর চাচা, মামা, ভাই, বন্ধু হয়ে আছেন, এ বন্ধন না ছিন্ন করতে চান তিনি, না শহরের কেউ! তাই এই পরমাত্মীয়ের দরজা খোলা সবার জন্য।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য উদাহরণ এই মৌলভীবাজার। 'মায়া মমতায় জড়াজড়ি করি' - কবিতার মতই এখানকার যাপিত জীবন! আমাদের যে অগ্রজদের সদিচ্ছা আর ভালবাসায় এই শহরে এমন দৃঢ় বন্ধন, তাদের প্রধান একজন সৈয়দ মহসিন আলী। তাই তার প্রস্থান আমাদের ভাবায়, আশংকা জাগায় আগামী নিয়ে! সৈয়দ মহসিন আলীরা শহরের স্তম্ভ! আফসোস, একই সাথে খুব দু:খজনক কতিপয় সাংবাদিকের কারণে জীবনের শেষ ধাপে এসে কিছু কষ্ট পেলেন মানুষটি, একজন ভাল মানুষের চেহারার উল্টো রূপ দেখল সবাই!

সৈয়দ মহসিন আলী কে ছিলেন, কেমন ছিলেন, গত দু'দিনে অনেকটা জেনে গেছেন সবাই ফেসবুকের কল্যাণে! এমন একজন মানুষ তিনি, যিনি মানুষে মানুষে ভেদাভেদ করেন নি কখনো, ভালবেসেছেন প্রাণ ভরে! 'মানুষ মানুষের জন্য' গানটা প্রায়ই যেমন গাইতেন, ধারণ করতেন কথাগুলো অন্তরে! সাংবাদিকেরা তার সিগারেট খাওয়া দেখেছেন, দেখেন নি তার দেশপ্রেম, দেখেন নি মানবপ্রেম! এই মানুষটির দ্বারা কত লোকের কত রোগের চিকিৎসা হচ্ছে, কত দরিদ্রের অন্নসংস্থান হচ্ছে, কত ঝগড়ার মীমাংসা হচ্ছে, এসব কেবল মুখে আর মনেই রয়ে গেল, 'খবর' হল না, 'প্রচার' হল না!

হয়ত আমরাও কিছুটা দায়ী। আসলে সময়টা এমন হয়ে গেল যে মন্ত্রী যা বলেন সবই নেতিবাচক খবর হয়ে যায়! এবার কেউ তার পক্ষে বললে সে তৈলমর্দনকারী, নয়ত দেখ যায় অন্যদের কটু মন্তব্যে এমন বিব্রতকর পরিস্থিতি হয় যে চুপ থাকাই তখন শ্রেয় মনে হত। অন্যায় হয়েছে, একজন মানুষের চরিত্রে এত ইতিবাচক দিক থাকা স্বত্তেও ছোটখাটো ত্রুটি নিয়ে এত বাড়াবাড়ি সত্যি অন্যায়!

হুম, সৈয়দ মহসিন আলী গালি দিতেন, এর আড়ালেও ভালবাসা থাকত বলে লোকে গালি শুনেও ছুটে আসত! আজ তার না থাকাটা কত পরিবারকে নি:স্ব করেছে, যাদের ভরন-পোষণের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি! কত ভাল কাজ যে মাঝপথে আটকে গেল, সে খবর বা ক'জন রাখে!

মন্ত্রীর মৃত্যুর পরে আমরা অনেকের লেখাতেই ক্ষমা প্রকাশ করতে দেখছি। না বোঝে অনেক সময় অনেক নেতিবাচক কথা তাকে নিয়ে লিখেছেন বলে ক্ষমা চাচ্ছেন অনেকে, কার কাছে চাইছেন ক্ষমা! মানুষটা যে নেই! এই ক্ষমা তো নিজের কাছে একটা স্বান্তনা মাত্র! বেঁচে থাকতে বুঝি না, আমরা, হারানোর পরে বুঝি, এটাই নিয়ম, তবু মনে হয় এখানে জিতে গেলেন সৈয়দ মহসিন আলী, বুঝিয়ে গেলেন তিনি ঠিক ছিলেন, আমরা অনেকই ছিলাম ভুল!

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় সমাজকল্যাণ মন্ত্রী, মঞ্চে বসে ঘুমানোর স্বভাব তার, কত রসিকতা এই ঘুম নিয়ে, আর আজ এমন ঘুমে তিনি আচ্ছন্ন যে কোনদিনই এ ঘুম ভাঙবে না! শহরবাসী বিদায় জানাতে প্রস্তুত! প্রিয় শহরের বুকে, প্রিয় বাংলার মাটিতে অন্তিম শয়ান হবে তার। ভুলবে না, শহরবাসী ভুলবে না এই প্রিয় মানুষটিকে। গান গাওয়ার স্বভাব ছিল, কোন জায়গায় কোন গান গাইতে হবে ঠিক বুঝতেন!

আপনাকে হারিয়ে আজ সবার হৃদয়ে যে করুণ সুর বাজছে, শুনতে পাচ্ছেন চাচা? আপনার প্রিয়জনেরা কাঁদছে, কাঁদছে প্রিয় শহর, এত দূর থেকে এই কান্না স্পর্শ করে আপনাকে? ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি আমাদের অপারগতার জন্য। আপনার অন্তিম যাত্রাপথে রইল আমাদের অশ্রুধারা, আমাদের হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা, আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি...বিদায়..।

লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.