Sylhet Today 24 PRINT

স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে কারা বোঝাবেন আইসোলেশন আর কোয়ারাইন্টাইনের পার্থক্য?

ডা. জাহিদুর রহমান |  ১৫ মার্চ, ২০২০

ফেসবুকে অনেকেই ইতালি ফেরত প্রবাসীদের একতরফাভাবে দোষারোপ করছেন। এতে যেমন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্তদের অযোগ্যতা, অবহেলাগুলো আলোচনার বাইরে চলে যাচ্ছে, তেমনি ভবিষ্যতের জন্যও তাদের এক ধরণের দায়মুক্তি দিয়ে দেয়া হচ্ছে। হোম কোয়ারাইন্টাইনে থাকা অবস্থায় কোন ব্যক্তির শরীর থেকে অন্য কারো শরীরে করোনাভাইরাস সংক্রমণ হলে দেখা যাবে আমরা সব দোষ শুধুমাত্র কোয়ারাইন্টাইনে থাকা ব্যক্তিকেই দিচ্ছি। অথচ হোম কোয়ারাইন্টাইন একটি জটিল প্রক্রিয়া এবং এটি সফল করতে শুধুমাত্র কোয়ারাইন্টাইন করা ব্যক্তি বা তার পরিবার না, স্থানীয় প্রশাসনেরও একটি বড় ভূমিকা আছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সেটির অবস্থা শোচনীয় বলেই আমরা বারবার হোম কোয়ারাইন্টাইন না করে ইন্সটিটিউশনাল কোয়ারাইন্টাইনের করার দাবি জানিয়ে যাচ্ছি।

গতকাল রাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আশকোনা হজ্ব ক্যাম্পের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন চ্যানেলে দেয়া সাক্ষাৎকারে অকপটে নিজেদের সব ব্যর্থতা স্বীকার করে নিয়েছেন। তারপরও একতরফাভাবে কয়েকজন মানুষের আচরণ নিয়ে এত গবেষণার মানে কি?

ইতালি ফেরত যাত্রীদের প্রথম থেকেই ভুল বা মিথ্যা তথ্য দেয়া হয়েছে। প্রথমে তাদের বলা হয়েছে আশকোনা হজ্ব ক্যাম্পে নেয়া হবে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য। সেখানে পৌঁছানোর পর দেখা গেল ডাক্তার, স্টাফ, কারো কোন চিহ্ন নাই। চারদিকে ময়লা পরিবেশ, নোংরা টয়লেট, বসার জায়গা পর্যন্ত নাই। খাওয়া দাওয়ার কোন ব্যবস্থা নাই আবার বাইরেও বের হতে দেয়া হচ্ছে না। যাত্রীরা জানতেন, বিজনেস ক্লাসের ২৫ জন কোন পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়াই এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে বাড়ি চলে গেছেন। তাহলে পরীক্ষা কি শুধু ইকোনমি ক্লাসের যাত্রীদের জন্য?

যাত্রীদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন যারা ইতোমধ্যে ইতালিতে কোয়ারাইন্টাইন অবস্থায় ১৪ দিন কাটিয়ে এসেছেন। তাদের যখন অন্যান্য যাত্রীদের সাথে একত্রে রাখা হয়, তখন তাদের মেজাজ খারাপ হবে না? তাদের নিজেদের আক্রান্ত হওয়ার ভয় নাই? ইতালিতে কোয়ারাইন্টাইন থাকলেও একই বিমানে আসার কারণে যে তাদের আবারও কোয়ারাইন্টাইন করার দরকার আছে, এই কথাটা তাদের কে বুঝিয়ে বলবে? পুলিশ নাকি ডাক্তার? দুপুর তিনটা পর্যন্ত খালি পেট। সেই মুহূর্তে হুট করে জানানো হল ১৪ দিন এখানেই থাকা লাগবে। কয়েকজন যাত্রীর সাথে ছোটবাচ্চা এবং মহিলা ছিলেন। এখন উনাদের কারো জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে দেখুন।

অথচ বাস থেকে নেমেই যদি প্রবাসীরা একটি পরিষ্কার রুম, টয়লেট, বসার ব্যবস্থা, নাস্তা পেত। ডাক্তার, নার্সসহ কর্মকর্তা কর্মচারীদের উপস্থিত পেত, বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর পেত, তাহলে হয়ত তারা এরকম হট্টগোলও করতেন না আর মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রীকেও আতঙ্কিত হয়ে তাদের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়ার মত আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিতে হত না। প্রবাসীদেরকে বুঝিয়ে শুনিয়ে আশকোনা হজ্ব ক্যাম্পেই রাখা যেত। সেই সাথে তাদেরকে দেখিয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে হোম কোয়ারাইন্টাইন অবস্থায় থাকা ব্যক্তিদেরও আশকোনা হজ্ব ক্যাম্পে নিয়ে আসার চেষ্টা করা যেত।

করোনাভাইরাস ঠেকাতে ইতিমধ্যে সরকার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। তারপরও দেড়শ মানুষকে এক বেলা খাওয়ানোর জন্য অন্য মন্ত্রণালয়ের উপর নির্ভর করা লাগে?

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মহোদয় বললেন, ইতালি থেকে এতজন যাত্রী আসার কথা উনারা প্রথম জানতে পেরেছেন ফেসবুক থেকে এবং জানার সাথে সাথেই ব্যবস্থা নিয়েছেন। উনার এরকম সহজ সরল স্বীকারোক্তিতে একই সাথে কৃতজ্ঞ এবং হতভম্ব হয়ে গেলাম। স্যার, ফেসবুকে আমরা লেখালেখি করি তো আপনাদের জানানোর জন্য না। আপনারা জানার পরও যাতে না জানার ভান করে কোন বিষয় এড়িয়ে যেতে না পারেন, সেজন্যই এত লেখালেখি। একটা প্যানডেমিক চলা অবস্থায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মহোদয় গণমাধ্যমের সামনে ব্রিফিং করছেন যে, তিনি ইনকামিং ফ্লাইটের যাত্রী তালিকা পেয়েছেন ফেসবুক থেকে! সত্যিই স্যার, এরকম দৃশ্য প্রত্যক্ষ করার সুযোগ এই জীবনে আর আসে নাই।

বোঝা গেল, করোনাভাইরাস প্যানডেমিক মোকাবেলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান চলাচল এবং পর্যটন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে বিন্দু পরিমাণ সমন্বয় নেই। সাংবাদিকরা যখন উনাকে ১৪২ জনের মধ্যে ২৫ জন বিমানবন্দর থেকেই বাড়ি চলে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলেন, তখন কোন সদুত্তর কিন্তু পাওয়া যায়নি।

সবচে করুণ দৃশ্যের অবতারণা হল ব্রিফিংয়ের শেষ প্রান্তে। মহাপরিচালক স্যার কয়েক মিনিট আগেই বললেন, "নতুন করে আসা ইতালি ফেরত যাত্রীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য আশকোনা হজ্ব ক্যাম্পে আনা হবে না, গাজীপুরের একটি সরকারি স্থাপনায় নেওয়া হবে। ঠিক সেই মুহূর্তে ইতালি ফেরত যাত্রীদের বিমানবন্দর থেকে বহন করে নিয়ে আসা দুই বাস হর্ন দিতে দিতে গেটের সামনে হাজির হল! এই হল করোনাভাইরাস নিয়ে আমাদের দীর্ঘ আড়াই মাসের প্রস্তুতি।

ওদিকে কিন্তু সরকারি হাসপাতালের ডাক্তাররা এখনও যথেষ্ট পরিমাণ ফেসমাস্ক পান নাই। মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে নিয়মিত আপডেটেড রাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গেরই যদি এই করুণ দশা হয়, তাহলে বাকিদের অবস্থা কী?

স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে কারা তাহলে আইসোলেশন এবং কোয়ারাইন্টাইনের পার্থক্য বোঝাবেন? আমাদের সেই দায়িত্ব দিয়ে দেখবেন নাকি একবার?

  • ডা. জাহিদুর রহমান: ভাইরোলজিস্ট, সহকারী অধ্যাপক, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.