Sylhet Today 24 PRINT

মেয়র, আপনাকে বলছি, আপনাকেই বলছি!

অপূর্ব শর্মা |  ২৬ মার্চ, ২০২০

‘আমি এই নগরবাসীকে আমার জন্য কাঁদতে দেখেছি, রোদে পুড়তে দেখেছি, সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে খালি হাতে লড়তে দেখেছি, আমার আর এই জীবনে পাওয়ার কিছু নেই’ -এই বক্তব্যটি সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর। বক্তব্যটি তাঁর ফেসবুক পেজের কাভার ফটোতে সংযুক্ত করে রাখা। বক্তব্যটি পড়লে যে কেউ আপ্লুত হবেন! তাঁর শেষ সাতটি শব্দ আমার মনে ধরেছে। ‘আমার আর এই জীবনে পাওয়ার কিছু নেই।’ অর্থাৎ এখন থেকে জনগণের জন্য তিনি কাজ করবেন। অবশ্যই ভালো কথা। আমার এই লেখাটি জনগণের প্রতি মেয়রের দায়বদ্ধতা নিয়েই।

একজন মেয়র অবশ্যই, অবশ্যই দায়বদ্ধ তার নাগরিকদের কাছে। নগরবাসীর ভালো মন্দ দেখার দায়িত্ব মেয়রেরই। কিন্তু আজ জাতির এই সংকটকালে নগরবাসীর জন্য, তাঁকে তেমন কোনও উদ্যোগ নিতে না দেখে অবাক হয়েছি। কয়েকদিন অপেক্ষায় ছিলাম, আজ হয়তো শুনবো তিনি মানুষের জীবন বাঁচাতে সংকট মোকাবেলায় উদ্যোগী হয়েছেন। মিডিয়াকর্মীরা তাঁর সেই উদ্যোগের কথা ফলাও করে প্রচার করবে গণমাধ্যমে। কিন্তু না, কোনও উদ্যোগ নেয়ার খবর আমার কাছে পৌঁছল না। সেই আগ্রহ থেকেই তাঁর ফেসবুক পেজে যেখানে মেয়রের কর্মপ্রবাহের নানা সংবাদ শেয়ার হয়ে থাকে, সেখানে বার কয়েক চোখ বোলালাম। দেখলাম, করোনা মোকাবেলায় সচেতনতামূলক একটি ভিডিও বার্তা আপলোড করা রয়েছে সেখানে। পাশাপাশি একাধিক অনলাইনে প্রচারিত ‘নগরীর কয়েকটি সড়কে জীবাণুনাশক স্প্রে দিয়েছে সিসিক’ আপলোড করে রাখা। সেইসাথে করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় ‘নগরীর মার্কেট বন্ধ রাখতে মেয়র আরিফের আহ্বান।’ এ পর্যন্তই।

আশ্চর্য হলাম। জনতার ভোটে নির্বাচিত একজন জনপ্রিয় মেয়রের নীরবতায়। তিনিতো নীরব থাকেন না। সব সময় সরব থাকতে পছন্দ করেন। আলোচনায় থাকার যত পন্থা, এর সবগুলোতেই রয়েছে তাঁর অবাধ যাতায়াত। একজন রাজনীতিক হিসেবে প্রচারের আলোয় থাকতে চাইবেন এটাই স্বাভাবিক। নগরজুড়ে ভাঙার যে মহোৎসব, তার রূপকার তিনি। সাংস্কৃতিক পৃষ্ঠপোষকতায়ও তিনি পিছিয়ে নেই। মঞ্চে যারা অনুষ্ঠান করেন তাদের ক্ষেত্রেও উদার তিনি। এদেরকে লাখ লাখ টাকা বরাদ্দ দেন হাসিমুখে। অবশ্যই এসব উদ্যোগ প্রশংসনীয়। তিনি সব সময়ই বলে থাকেন, নগরীর উন্নয়নই তাঁর কাছে মুখ্য। কিন্তু আজ মহাবিপর্যয়ের সময়ে শুধুমাত্র নগরজুড়ে শুধু জীবাণুনাশক ছিটানোর বিষয়টি একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমাকে আহত করেছে। মশা উপদ্রুত নগরীতে যেখানে মানুষ মশার জ্বালায় অতিষ্ঠ, ভাঙা রাস্তাঘাটের কারণে যেখানে ব্যাহত হয়েছে স্বাভাবিকতা, সেখানে মানুষ ঘরবন্দি হয়ে যাওয়ার প্রাক্কালে জীবাণুনাশক ছিটানোর বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারিনি আমি। যারা দিন আনে দিন খায়, যারা দরিদ্র, গরিব, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকা যাদের জন্য এই মুহূর্তে খুবই কঠিন-কেন তাঁদের পাশে নেই তিনি, ভাবতে অবাক লাগে। জনসচেতনতামূলক ভিডিও বার্তা এবং সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন প্রচার দেখে মনে হয়েছে, এর মাধ্যমে নিজেকেই প্রচার করেছেন তিনি। তাঁর নেতৃত্বে যেটা করার কথা ছিলো সিলেট সিটি করপোরেশনের সেটাই করে দেখালেন সিলেটের সংস্কৃতিকর্মীরা। সিলেটের নাট্যকর্মীরা যেটা পারলেন, তাঁর নেতৃত্বে কেন সেটা সিটি করপোরেশন করতে পারলো না, সেই প্রশ্নটি স্বাভাবিকভাবেই ঘুরপাক খাচ্ছে মনে।

তিনি নিজেওতো উদ্যোগী হতে পারতেন। গঠন করতে পারতেন সহায়তা তহবিল। নগরীর ধনাঢ্যদের প্রতি আহ্বান জানাতে পারতেন, সেইসব মানুষ যাদের কাজ ছাড়া, বাইরে বের হওয়া ছাড়া অন্ন জুটেনা সংকটকালে তাদের জন্য কিছু করার জন্য। এবং সেটা হতে পারতো তাঁর নেতৃত্বে। রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক অঙনের নেতৃস্থানীয়দের নিয়ে একটি সম্মিলিত প্লাটফর্ম তৈরি করতে পারতেন, যার মাধ্যমে পাশে দাঁড়ানো যেতো মানুষের, সেটাও করলেন না। এইযে না-এর একটি দীর্ঘ তালিকা নিজের নামের সাথে যুক্ত করলেন তিনি, সেটির জন্য অবশ্যই আগামীতে কৈফিয়ত দিতে হবে তাঁকে। নগরের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে, এসব প্রশ্নের উত্তর যেমন দিতে হবে তাঁকে, তেমনই এর দায়ও এড়ানোর সুযোগ নেই তাঁর।

সংবাদ মাধ্যমের বদৌলতে জানতে পারলাম, ‘অবরুদ্ধ অবস্থার মধ্যে কয়েক হাজার হতদরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য বিনামূল্যে খাবারের ব্যবস্থা করেছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম।

শুরুতে তিন হাজার মানুষের কাছে খাবার পৌঁছে দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে এবং পর্যায়ক্রমে ১০ হাজার মানুষকে খাবার সরবরাহের লক্ষ্য রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। ব্যক্তিগত উদ্যোগে নেওয়া এ কর্মসূচি রোববার থেকে বাস্তবায়ন করা হবে। এই উদ্যোগের আওতায় তিন হাজার হতদরিদ্র প্রতিটি পরিবারের জন্য থাকছে পাঁচ কেজি চাল, এক কেজি ডাল, এক লিটার তেল, এক কেজি আলু, একটি সাবান ও মাস্ক।’ (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ২৬ মার্চ ২০২০)।

পাশাপাশি সিনিয়র সাংবাদিক, সমকালের ব্যুরো প্রধান চয়ন চৌধুরীর ফেসবুক পোস্ট থেকে অবগত হলাম, ‘গাজীপুর মেয়র চীন থেকে আনলেন ২০ হাজার কিট, ৯ লাখ মাস্ক।’ এই দুটি খবর দেখে বিষণ্ণতায় আচ্ছাদিত হয়ে যাওয়া মনে এলো স্বস্তির নিঃশ্বাস। প্রশ্ন জেগেছে মনে, তারা যদি উদ্যোগী হতে পারেন, তাহলে কেন পারবেন না আরিফুল হক? অবশ্যই পারবেন। আমি মনে করি, তাদের দেখানো পথেই অগ্রসর হতে হবে আমাদের মেয়রকে। আমার বিশ্বাস, নগরীর অভিভাবক প্রতিষ্ঠান সিটি করপোরেশন তাঁর নেতৃত্বে উদ্যোগী হবে মানুষের সংকট মোকাবেলায়। কর্মহীন হয়ে পড়ার কারণে যারা দু’বেলা দুমুটো ভাতের জন্য পড়বে সংকটে, আহাজারি করবে তাদের মুখে আহার তুলে দিতে করপোরেশন গ্রহণ করবে যথাযথ উদ্যোগ। কারণ, শ্রমজীবী এসব মানুষদের সিটি করপোরেশন ভালো করেই চেনে। তাদের কাছে ঠিক যতোটা দ্রুত পৌছুতে পারবে করপোরেশন অন্যকোনও সংস্থার পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। বড় বড় কথা নয়, ফাঁকা বুলি নয়, প্রচারের আলোয় থাকার জন্য উদ্যোগ নয়, মানুষের মহাসঙ্কটকালে মানবিকতার গান গাইতে হবে। দাঁড়াতে হবে অসহায় মানুষদের পাশে। মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য, এই কথাটিকে যথার্থ প্রমাণ করতে হবে।

আমার এই লেখনি, শ্রমজীবী, অসহায়, গরিব এবং দরিদ্র ঘরবন্দি মানুষের জন্য কল্যাণমুখী উদ্যোগ নিতে সিটি করপোরেশনের প্রতি আহ্বান। আশাকরি মেয়র মহোদয় উদ্যোগী হবেন। যাদের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন, পাশে দাঁড়াবেন তাদের। কারণ নগরীর অভিভাবক হিসেবে এটা তাঁর দায়িত্ব এবং কর্তব্যও বটে।

  • অপূর্ব শর্মা: লেখক, সাংবাদিক।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.