ডা. মো. রিজওয়ানুল করিম শামীম | ০৬ এপ্রিল, ২০২০
অনেকে অনেক কিছু দেবেন, দিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন। এপারেলস, স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ইলেকট্রনিক্স থেকে শুরু করে ফোন কোম্পানি। আপনাদের মহানুভবতায় আমরা আপ্লুত এবং কৃতজ্ঞ। কিন্তু পরিতাপ হলো কে কবে কোথায় কী দিলেন, কে কী পেলেন কোনো হদিস মিলছে না, যাও সামান্য মিলছে তার কোন ইনভেন্টরি নেই, উপরন্তু রয়েছে আদর্শমান যাচাইজনিত সমস্যা।
কেউ হয়ত সরকারের দায়িত্বশীল কারো সাথে দেখা করে বললেন, এই বিপদে উনি ৫০০০০ পিপিই দিবেন, দশ লাখ! কেউ পনের কোটি টাকার পিপিই! কেউ হাজার হাজার কিট! একখানা নমুনা সাথে করে নিয়েও এলেন। তো সরকার বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তাকে তার আশ্বাসের উপর ভর করেই ধন্যবাদ দেয়া হলো। ধন্যবাদ না দিয়েও উপায় নেই, দান করতে চাচ্ছে নিতে তো হবেই নয়তো কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।
অতঃপর তিনি ওই একখানা দানের পিপিই এর নমুনা হাতে, পিছনে সংগঠনের ব্যানার টানিয়ে বত্রিশ পাটি দাঁত বার করে ছবি তুলে চলে গেলেন এবং অনলাইন-অফলাইনে ব্যাপক প্রচার করলেন। এটা হলো বিকৃত একটা মানসিকতা। মানুষের বিপদে সহানুভূতি, মানবিকতার অভিনয়। যারা করছেন, খুব খুব অন্যায় করছেন। একদিন সব জানবে সবাই।
আর একদল আরও চতুরতার আশ্রয় নিয়েছেন বলে যাচ্ছেন একলাখ পিপিই পাঠাচ্ছেন, বাস্তবে দেয়া হলো সুতি বা গেঞ্জি কাপড়ের মাস্ক, এটাও তো পিপিই। সাংবাদিক ভাইবোনেরা, বা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা যদি দয়া করে বিষয়টা একটু ভেতরে ঢুকে ভাল করে যাচাই করতেন বড় উপকার হতো, মুখোশটা খুলতো কারো কারো।
এমন একজন দাতা প্রতিনিধিকে হতাশ গলায় বললাম নিউজ করে দিলেন ভাই কিছু না দিয়েই। তখন উল্টো হেসে জিজ্ঞেস করলো- কী দিতে পারি, স্পেসিফিকেশন যদি পাঠাতেন। যা হোক পাঠিয়েছি স্পেসিফিকেশন, দেখা যাক কবে নাগাদ কী জিনিস কতটা পাওয়া যায়। মনেপ্রাণে চাই ওনারাই মহৎ থাকুন সত্য থাকুন, আমার কনফিউশন, ভ্রান্তি অমূলক হোক। আসলে ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পেতেই পারে। তাতে গরুর দোষ নাই। আমি বরং নিরীহ গরু হয়ে নিরাপদ থাকি।
আদর্শমান যাচাই (technical specification) বা মেডিকেল ইউজের উপযোগিতা'র (ডিজিডিএ বা বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদিত) কথা আর বলার রুচি নাই। বাজারের ব্যাগ, পলিথিন, ওয়াল ক্লথ, রেইনকোট, রাবারশিট, পিভিসি, ত্রিপল, প্যারাসুটের কাপড়, তাঁবুর কাপড় কিছুই বাদ যায় নাই। তাদের কেলানো যুক্তি এটা ওয়াটার প্রুফ। আরে ভাই করোনা ভাইরাস কি বৈশাখী বৃষ্টি? আপনি বলেন ডিসপোজেবল কিনা, লাইটওয়েট, ব্রেথেবল কিনা, মাইক্রোবিয়াল বা ক্যামিকেল রেসিস্ট্যান্স কি না, স্পিলপ্রুফ কি না। এটা পরে ৮-১০ ঘণ্টা আপনাকে সিলড অবস্থায় ডিউটি করতে হবে।
রেইনকোট টাইপ বা পিভিসি বা এয়ার ওয়াটার প্রুফ কিছু এভাবে পরিয়ে দিলে ডাক্তার-নার্স একদম মারা যাবে। দান করবেন বলে চালের বদলে কাঁকড় দেবেন? লাগবে না ভাই অফ যান।
কেউ আবার দুই বোতল স্যানিটাইজার একটা স্ট্যান্ডে বসিয়েছেন ডিজি অফিসের গেটে, সেটার ছবি তুলে বলে যাচ্ছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অনুমোদিত।
অন্যদিকে দেশশুদ্ধ মানুষ জানলো লাখ লাখ কোটি কোটি টাকার দান সামগ্রী সব আমরা বাড়িতে নিয়ে গেছি বা বিক্রি করে দিয়েছি।
কেউ সকাল বিকাল রাস্তায় গাড়ির চাকায় ডিসইনফেক্টেন্ট স্প্রে করে চাঁদা তুলছেন। কেউ মানবিক ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে দশ পনেরটা বিকাশ নগদ নম্বর দিয়ে রেখেছেন। বিভিন্ন অফিসে ঢুকে হঠাত করে ডিসইনফেকটেন্ট স্প্রে করা শুরু করছেন। তারা তো এর পাশাপাশি এই স্প্রে ড্রেন বা অন্য কোথাও মারতে পারতেন, মশাও মারতে পারতেন, ওতেও কম উপকার হতো না।
মান্যবর দানবীরদের উদ্দেশে বলি, আপনি নমস্য, স্বর্গের দূত, খোদার ফেরেশতা, অধমের প্রতি আপনার এই দয়াটা যেন লোক দেখানো না হয়।
যা দেবেন, যেখানে দেবেন, আইটেম উল্লেখ করে দানগ্রহীতার স্বাক্ষর নিয়ে কোন আইটেম কয়টা কী দিলেন উল্লেখ করে রিসিভ করায় নিবেন। সেটা হুবহু প্রকাশ করেন অথবা আশ্বাসটুকুই অন্তত অফিসের প্যাডে স্বাক্ষর করে আমাদের হাতে দেন, যাতে পরে আপনাদের দেখাতে পারি কর্তৃপক্ষকে দেখাতে পারি (জবাবদিহি করার ক্ষমতা তো নাই আমাদের অন্তত নিজে চোর এই অপবাদ থেকে বাঁচতে পারি)। প্রহসন এর সময় বা বিষয় এটা নয়। আপনাদের আশ্বাসে ভরসা করে আমাদের নিজেদের প্রস্তুতিটাও খারাপ হয়, এটা মনে রাখবেন।
একটা গল্প দিয়ে শেষ করি। ঠিক গল্প না ছোটবেলার একটা অভিজ্ঞতা এটা। তিন ভাইবোন পিঠাপিঠি ছিলাম আমরা। বাড়িতে ছোটখাটো একটা গাভী আধ-সের পরিমাণ দুধ দিতো। তাতে ছোট ভাইবোন দুজনের কোনরকম চলতো। আমি কান্না জুড়ে দিতাম যখন দাদী বলতেন আসো তোমাকে বলদের দুধ বানায় দিই। ওনি পান্তা ভাতের সাথে জাম আলুর ভর্তা ভালো করে কচলায়ে দুধের মতো মিহি করে ফেলতেন। সুরেলা গীত গেয়ে চামচ দিয়ে দুধের মতো করে খাওয়াতেন। তখন অবুঝ আমি এটা খেয়ে দারুণ খুশি। এই বলদের দুধ খেয়েছি দুতিন বছর। এখন ওনার বিরুদ্ধে অভিযোগ আমার নাই তার মানে এই না গরুর দুধ আর বলদের দুধ একই জিনিস।
বিপদে অনেকের অনেক চরিত্র প্রকাশ পায় একদিনে যা যা দেখছি তা দিয়ে পাঁচশ পাতার ভণ্ডামির গল্প লেখা যাবে। আপনাদের আশ্বাস যেন সত্য হয়, বাস্তবসম্মত ও দৃশ্যমান হয় এটা যেন আমাদেরকে False sense of satisfaction এ না ভোগায়।
আপনার ক্রেডিট নিতে ইচ্ছা করছে? আপনার বীর হওয়ার খায়েশ? আপনার ব্যবসার খ্যাতি বাড়াতে চান? প্লিজ, করোনাটা অন্তত ছেড়ে দিন। অসহ্য অসভ্য অমানবিক প্রতারণা থেকে দেশ জাতিকে মুক্তি দিন।