Sylhet Today 24 PRINT

লকডাউনে ❛আনলকড❜ চা শ্রমিকেরা

মিখা পিরেগু |  ১৪ এপ্রিল, ২০২০

দেড় শতাধিক চা বাগান খোলা রেখে সিলেট বিভাগের সকল জেলা স্ব স্ব প্রশাসনের নির্দেশে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। এসকল চা বাগানে স্থায়ী ও অস্থায়ী প্রায় দেড় লক্ষাধিক শ্রমিক রয়েছে। আর পরিবারের সদস্যসহ প্রায় ১২ লাখের বেশি চা জনগোষ্ঠী বাগানগুলোতে বসবাস করে।

গত ৩১ মার্চ গণভবন থেকে জেলা প্রশাসকসহ মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও চা বাগানের কাজ চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে মত দেন। ভিডিও কনফারেন্সে সিলেট জেলার ডেপুটি কমিশনার এম কাজী এমদাদুল ইসলাম সিলেটে কয়েকটি চা বাগানে শ্রমিকদের কর্মবিরতি ও দুটি বাগানে শ্রমিকরা কাজে যোগ দিচ্ছেন না বলে প্রধানমন্ত্রীকে জানান।এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, উৎপাদনমুখী, রপ্তানিমুখী খাত চালু রাখতে হবে। আর চা শ্রমিকরা যখন পাতা তোলে তখন তারা বিক্ষিপ্তভাবে দূরে দূরে তোলে। চা শ্রমিকরা এমনিতেই প্রকৃতির সাথে থাকে আর চা বাগানে যেহেতু সংক্রমণও নাই, সুতরাং ভয় পাওয়ারও কিছু নাই। শুধুমাত্র পাতা যখন জমা করবে তখন লাইন ধরে দূরত্ব বজায় রেখে দেবে।

রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকদের কাছ থেকে এমন অবিবেচনাপ্রসূত বক্তব্যের মাধ্যমে বোঝা যায় চা বাগান ও চা শ্রমিক বিষয়ে এই সরকারের কোনো ধারণা নাই। ঠিক কী ধরনের পরিবেশে দেশের চা শ্রমিকদের কাজ করতে হয়, তা নিয়ে একটি গবেষণা পরিচালনা করেছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)। ‘আ স্টাডি রিপোর্ট অন ওয়ার্কিং কন্ডিশনস অব টি প্লান্টেশন ওয়ার্কার্স ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের চা শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার বিষয়টি চরমভাবে উপেক্ষিত। চা শ্রমিকদের ৬৩ শতাংশই রয়েছেন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। দেশের ১০টি চা বাগানের ২৯৭ জন শ্রমিকের তথ্যের ভিত্তিতে গবেষণাটি করা হয়েছে। এছাড়া ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশন করা হয়েছে ছয়টি। সেখানে ছিলেন পঞ্চায়েত, শ্রমিক, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি, চা বাগানের ব্যবস্থাপক ও সরকারের প্রতিনিধিরাও। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করলেও ঝড়-বৃষ্টিতে আশ্রয় নেয়ার মতো ব্যবস্থা নেই কর্মক্ষেত্রের পাশে। বিশ্রামও সেভাবে পান না শ্রমিক।
অভাব রয়েছে নিরাপত্তা কিটস, টয়লেট সুবিধার। কর্মক্ষেত্রে হয়রানি ছাড়াও পুষ্টিকর খাদ্য না পাওয়ার কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে চা শ্রমিকদের মধ্যে। স্বাস্থ্যের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব টের পান ৭৫ শতাংশের বেশি চা শ্রমিক। ৮৪ শতাংশ চা শ্রমিক ভোগেন মাথাব্যথায়। মাংসপেশির ব্যথা নিয়েও কাজ করেন ৭৪ শতাংশ শ্রমিক। আর পিঠের ব্যথায় আক্রান্ত চা শ্রমিকদের ৭২ শতাংশ ও ৬৫ শতাংশের বেশি শ্রমিকের চর্মরোগ রয়েছে। বিষাক্ত পোকামাকড় ও কীটনাশক থেকে বাচার জন্য কর্মক্ষেত্রে কোন ধরনের সুরক্ষা ব্যবস্থা যেমন বুট, সুরক্ষা কবজ, মাস্ক, গ্লাভসের ব্যবহার নেই। তেমনই অরক্ষিত কর্ম এলাকা বা চা কারখানার শ্রমিকদের রয়েছে অমানবিক পরিশ্রমের ফলে সৃষ্ট মানষিক চাপ। শ্রম আইনে বাধ্যতামূলক ভাবে কর্মক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের জন্য পৃথক শৌচাগার নির্মাণের কথা বলা থাকলেও চা শ্রমিকদের ক্ষেত্রে এ ধরণের কোন ব্যবস্থা নেই। চা শ্রমিকদের মাঝে মাত্র ১৩ শতাংশ কর্মক্ষেত্রে ছায়াযুক্ত স্থানে অর্থাৎ গাছের ছায়ায় বিশ্রাম ও আহারের সুযোগ পায়। বাকিদের তীব্র দাবদাহ অথবা ঝড় বৃষ্টিতেই বিশ্রাম নিতে হয়। গবেষণাতে বলা হয়েছে বছরের সব মৌসুমে বিশুদ্ধ পানির সুবিধা পায় এমন চা বাগানের সংখ্যা খুবই কম। চা বাগানের স্বাস্থ্যকেন্দ্র গুলোতে একজন কম্পাউডারের নেতৃত্বে গুটি কয়েক স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছে যারা বিভিন্ন অসুখে প্রায় একই রকমের ঔষধ সরবরাহ করে থাকে। আর এ সকল ঔষধের নিম্নমানের ব্যাপারে প্রায় সকল শ্রমিকের অভিযোগ রয়েছে। চা শ্রমিকদের চিকিৎসা সুবিধায় ৬৮ শতাংশ শ্রমিকই অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন বলে গবেষণায় আরও উল্লেখ করা হয়।

বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে যারা তুলনামূলক দুর্বল, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম কিংবা পূর্বেই বিভিন্ন শারীরিক ব্যাধিতে আক্রান্ত তাদের মৃত্যু ঝুঁকি বেশি। কাজেই বাংলাদেশে প্রেক্ষাপটে করোনা ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি চা জনগোষ্ঠীর। এমন পরিস্থিতিতে চা বাগানগুলো খোলা রেখে প্রশাসনিকভাবে লকডাউন ঘোষণা একটি অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত হতে যাচ্ছে এতে কোনো সন্দেহ নেই।

২০১৯ সালে দীর্ঘ ১৬৬ বছরের দেশের চা শিল্পের ইতিহাসে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ চা উৎপাদনের নতুন রেকর্ড গড়ে বাংলাদেশ। চা শ্রমিকদের অমানবিক পরিশ্রমের উপর টিকে থাকা দেশের চা শিল্প এখন জাতীয় জিডিপিতে প্রায় ১% অবদান রাখছে। পুরো বিশ্বকে স্তম্ভিত করা এই অতিমারীর সময়েও চা শ্রমিকেরা উচ্চ ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে যেখানে বিভিন্ন রপ্তানিযোগ্য শিল্পখাতের শ্রমিকদেরও স-মজুরিতে ছুটি দেয়া হয়েছে। লকডাউনের সময়কালে চা বাগানের এই কর্মযজ্ঞ দেখে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে চা শ্রমিকদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে বাগান মালিকেরা ও সরকার এ বছর নতুন রেকর্ডের স্বপ্নে বিভোর।

সরকার-বাগান মালিকদের তোষামোদি ও লেজুড়বৃত্তির চর্চায় নিয়োজিত চা শ্রমিক ইউনিয়নও চা শ্রমিকদের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের সময় চা বাগানে ঐতিহাসিক 'সোলেমান হটাও' আন্দোলনের প্রেক্ষাপট সম্ভবত তাদের মনে নেই। ব্রিটিশ শাসকদের তাবেদার হয়ে স্ব-ঘোষিত চা শ্রমিক নেতা সোলেমান খান বিভিন্ন সময় শ্রমিকদের দাবি দাওয়া, অসন্তুষ্টি কিংবা বিদ্রোহ দমনের কাজেই নিয়োজিত ছিলো। ফলে বিক্ষুব্ধ চা শ্রমিকেরা সোলেমান খানকে বাগান থেকে বের করে দেন। পরবর্তীতে যারা চা শ্রমিক ইউনিয়নের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তারাও একই কায়দায় দীর্ঘ সময় শ্রমিক ইউনিয়ন পরিচালনা করেন। শ্রমিক অধিকারে কথা না বলে বিভিন্ন সময়ে সরকার ও মালিকপক্ষের হয়ে সংক্ষুব্ধ চা নিবৃত করতেই বেশি মনোযোগ ছিলো তাদের। ফলে পূর্ণ স্বাধীন চা শ্রমিক ইউনিয়ন গঠনের স্বপ্ন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে চা বাগানে যে 'সোলেমান হটাও' আন্দোলন হয়েছিলো তার বাস্তবায়ন আজো হয়নি। কাজেই লেজুরবৃত্তি থেকে মুক্ত স্বাধীন চা শ্রমিক ইউনিয়ন এখন সময়ের দাবি।

সরকার জিডিপি বোঝে গরীব মানুষ বোঝে না। অধিক লাভ কিংবা জিডিপির আশায় চা শ্রমিকদের মৃত্যুর মুখে পর্যবসিত করে উন্নয়নের বুলি দেশের আপামর জনগণ সহ্য করবে না। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ২০১৮ সালের চা মেলায় চা শ্রমিকদের বাড়ি বানানোর জন্য মালিকদের ২ শতাংশ হারে ঋণের ঘোষণা দিয়েছিলেন। বাস্তবে এর কোন হদিস নেই এখনো। চা শ্রমিকদের দীর্ঘদিনের দাবির পর প্রথমবারের মতো গঠিত চা শ্রমিকদের জন্য পৃথক মজুরি বোর্ড গত বছরের অক্টোবরে গঠিত হলেও এখনো নতুন মজুরি নির্ধারিত হয় নি। কাজেই বলতে চাই উন্নয়নের মূলা ঝুলিয়ে চা শ্রমিকদের সাথে ধোঁকাবাজির পরিণাম ভয়াবহ হবে। মহামারী করোনায় সর্বোচ্চ মৃত্যুঝুঁকিতে থাকা চা শ্রমিকদের অবিলম্বে সমজুরিতে ছুটিসহ পর্যাপ্ত চিকিৎসা সহায়তা প্রদান না করলে এর বিপরীতে সরকার-বাগান মালিক-শ্রমিক ইউনিয়ন সবাইকেই চড়া মূল্য দানের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। রাষ্ট্রের অবহেলায় উপেক্ষিত চা শ্রমিকদের সেই বিদ্রোহ কেউ দমাতে পারবে না।

মিখা পিরেগু: সভাপতি, ছাত্র ইউনিয়ন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সংসদ; সহসভাপতি, বিশ্ববিদ্যালয় চা ছাত্র সংসদ।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.