Sylhet Today 24 PRINT

ইতালিতে করোনাকালীন দিনরাত্রি

মো. আব্দুর রব |  ২৩ এপ্রিল, ২০২০

আজ ২৩ এপ্রিল। গৃহবন্দি থাকার আজ দেড় মাস। আর কত দিন গৃহে আবদ্ধ থাকতে হবে কিছুই জানিনা। ইউরোপের দেশগুলোতে একদিন মৃতের সংখ্যা একটু কমে তো পরের দিন আবার বেড়ে যায়। সেই কবে থেকে শুনছি ইউরোপে করোনা পরিস্থিতি উন্নতির পথে। কিন্তু সেই কাঙ্ক্ষিত উন্নতি যেন আর হচ্ছেই না। এরই মধ্যে বেশ কয়েক বার লকডাউনের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে। গতকাল স্পেনের সংসদে বিশেষ অধিবেশন বসেছে। লকডাউনের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হবে কি না তা নিয়ে আলোচনা করার জন্য। কবে নাগাদ আসলে এই লকডাউন অপসারণ করা সম্ভব হবে বা হলেও ঠিক কতটুকু করা হবে কীভাবে করা হবে সে বিষয়ে কোনো নিশ্চয়তা নেই।

আমাদের প্রতিটি দিন শুরু হয় অগণিত লাশ ও আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা শোনে। প্রায় সারাদিনই মানুষের ঝরে পড়ার খবর শুনতে হয়। চরম বিমর্ষতা আতংক ও উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে আমাদের প্রতিটি দিন অতিবাহিত করতে হয়। ভয়ংকর মৃত্যু ভয় আমাদের আঁকড়ে ধরেছে। করোনা যেভাবে তার কালো থাবা বিস্তার করছে- মনে হয় ঘরে থেকেও শেষ পর্যন্ত বাঁচা যাবে না। আগে পরিবার পরিজনের সাথে প্রতিদিন ফোনে কথা হলেও ভিডিওকলে কথা বলতাম সপ্তাহ-পনেরো দিনে একবার। এখন তো রোজ দুই তিনবার ভিডিও কলে কথা বলে স্বজনদের মুখগুলো দেখি। তৃপ্তি মেলে না। মনে হয় আরও দেখি। মনে হয় এটাই শেষ দেখা নয়তো? আবারো পরিবার পরিজনের সাথে মিলিত হতে পারব তো?

বিজ্ঞাপন

স্বাভাবিক মৃত্যু হলে না হয় মনকে সান্ত্বনা দেওয়া যেত। কিন্তু করোনায় মৃত্যু এক চরম ভয়াবহ মৃত্যু। অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন ভিডিও ক্লিপে করোনায় মৃত্যু পথযাত্রী মানুষের যে অবর্ণনীয় কষ্টের দৃশ্য দেখা যায়, তা সত্যিই বিচলিত করে ফেলে। দেখা যায়- রোগীরা তাদের সামনে পুরো ঘর ভর্তি বাতাস রেখেও বিরাট হা করে শ্বাস নিতে চেষ্টা করছে কিন্তু এক বিন্দু অক্সিজেন ফুসফুসে পাঠাতে পারছেনা। কেবল তাদের বুকের নিষ্ফল উঠা নামা দেখা যায়। তখন তাদেরকে আইসিইউতে নেওয়া হয়। ভেন্টিলেটর দেওয়া হয়। কেউ কেউ সুস্থ হয়ে ফিরে আসে কেউ আর কখনোই আসে না। এক চরম ভয়াবহ ভীতিকর দৃশ্য। এমন মৃত্যু কে কামনা করে?

হসপিটালগুলোর সামনে থেকে শত শত লাশবাহী গাড়ির সারি সাইরেন বাজিয়ে দূরে হারিয়ে যায়। এগুলো প্রতিদিনের পরিচিত দৃশ্য। এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথেই রোগীকে আপনজন থেকে আলাদা করে ফেলা হয়। হাসপাতালে নিয়ে গেলে আর কোনো আপনজন দেখতে আসে না। যে কদিন বেঁচে থাকে হাসপাতালের অপরিচিত ডাক্তার নার্সদের চর্কির মতো দৌড়াদৌড়ি দেখতে হয়। শেষ পর্যন্ত এ যুদ্ধে হেরে গেলে মৃত্যুর পরেও কোনো আপনজনকে লাশ দেখতে দেওয়া হয় না। কাছে আসতে দেওয়া হয় না। কখনো কখনো আপনজনরাই আর কোনো খোঁজ খবর নেয় না। নিজের পরিবার পরিজনের সাথে শেষ দেখা ছাড়া ও তাদের কোনো রূপ স্পর্শহীন এ মর্মান্তিক মৃত্যু কতটা কষ্টের কতটা যাতনার তা সম্পূর্ণ ব্যাখ্যাতীত।

এসব দৃশ্য দেখতে দেখতে এবং ভাবতে ভাবতে দুশ্চিন্তা আর আতংকে আমাদের মানসিক ভারসাম্য ঠিক রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানসিক শক্তি যাদের কম তারা তো মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে উদ্ভ্রান্ত হয়ে পড়েছে। গতকাল ইতালির মিলানের এক বাংলাদেশি ভাই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে তার পাঁচ বছরের কন্যা সন্তানকে হত্যা করে ফেলেছে। ইতালির সব পত্রিকা এটাকে লিড নিউজ করেছে। এতে ইতালির বাঙালি কমিউনিটি এক চরম অস্বস্তিতে পড়েছেন।

আমরা যারা পরিবার পরিজন দেশে রেখে দূর প্রবাসে অনেক দিন পড়ে আছি তাদের মানসিক অবস্থা খুবই খারাপ। চরম বিমর্ষতা, বিষণ্ণতা আর আতংক আমাদেরকে অক্টোপাসের মতো ঘিরে ধরেছে। আমরা মানসিক অবস্থা ঠিক রাখার জন্য এসব খবর যতদূর সম্ভব এড়িয়ে চলি। কিন্তু সম্পূর্ণ নির্বিকার থাকা সম্ভব হয়না। শুনতে না চাইলেও এসব খবর আমাদেরকে শুনতে হয়। এতে আমাদের মানসিক অবস্থা ক্রমেই খারাপের দিকে সবেগে ধাবিত হচ্ছে। খুব শীঘ্রই এ অবস্থা থেকে উত্তরণেরও কোনো পথ দেখছিনা।

বিজ্ঞাপন

আমাদের অবশ্য খাওয়া দাওয়ার কোনো সমস্যা নেই। মাসখানেকের বাজার করা আছে। আর নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি দু-একদিন পর পর কেউ একজন কিনে নিয়ে আসেন। প্রায়ই বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন থেকে ত্রাণ নিয়ে আসার জন্য ফোন আসে। আমরা যাই না। মনে করি তারাই নিক যাদের প্রয়োজন আমাদের চেয়ে বেশি। গতকাল একটা কল পেয়ে ত্রাণ আনতে গেলাম কারণ এটা ছিল বাসা থেকে মাত্র দু মিনিট দূরত্বে। এত পাশে হওয়াতে একটু কৌতূহলবশতই গেলাম। গিয়ে দেখি নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে লোকেরা কী সুন্দর লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো হুড়োহুড়ি নেই। আগে যাওয়ার চেষ্টা নেই। আমার টার্ন আসলে ভিতরে গিয়ে দেখি বিশাল টেবিলে হরেক রকমের নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য রাখা। দূর থেকে দাঁড়িয়ে দুজন সুশ্রী মহিলা আমাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বলল- যা ইচ্ছা যতটুকু ইচ্ছা নিতে পারেন। দুটো টোনা ফিস একটা দুধ ও দুই প্যাকেট পাস্তা নিয়ে বেরিয়ে এলাম।

বেরিয়ে এসে যে দৃশ্য দেখলাম এজন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। দেখলাম আমাদের স্বদেশী দু-তিনজন ভাই যতটুকু পারেন বড় বড় ব্যাগ ভরে নিয়ে পাশের মুদির দোকানে গিয়ে বিক্রি করে টাকা নিয়ে চলে যাচ্ছেন। এই ভয়াবহ দুর্দিনেও উনাদের এ হেন আচরণ দেখে আমি শুধু অবাকই হইনি লজ্জিতও হয়েছি।

যাই হোক আমরা এখনো ভাল আছি। জানি না কতদিন শারীরিক ও মানসিকভাবে ভাল থাকতে পারব।

মো. আব্দুর রব: রোম, ইতালি। ইমেইল: [email protected]

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.