Sylhet Today 24 PRINT

সবুজ পৃথিবীকে শ্বাস নিতে দিন

সারওয়ার খান |  ২৬ এপ্রিল, ২০২০

এই শহরের বেঁচে থাকার মুহূর্তগুলো প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ কার্বন-ডাই অক্সাইডের বিষাক্ত বাতাসে, লোকাল বাসের যুদ্ধে, যানজটে কিংবা ব্যস্ততা-অবহেলা আর যান্ত্রিকতায় হারিয়ে ফেলেছি আমরা। গতির নেশায় ছুটে চলা এই শহরে ‘মেমসাহেব’ এর মতো মায়াবী মেয়েকে দেখার ফুরসৎ মেলে না কারো। মুড়ির টিন কিংবা সিটিং সার্ভিসে কারো চোখ আটকে যায় না অন্য কোনও চোখে। স্বপ্ন বুননের কোনো মায়াজাল এখানে তৈরি হয় না। শহর-নগর-বন্দরে এই একই ছুটে চলা, একই ব্যস্ততা, একই গতি যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছিল সবাইকে। স্বপ্নাতুর চোখগুলোয় ভর করেছিলো হাজার বছরের ক্লান্তি।

বাবা ফিরবে… কোলে নিয়ে শোনাবে রূপকথার গল্প। এমন ভাবনায় ছোট্ট শিশুটির অপেক্ষার প্রহর গোনা… বাবা সেই ফেরে, ব্যস্ত অফিস শেষে, কিন্তু ততক্ষণে শিশুটি ঘুমের দেশে বাবাকে হাতড়ে ফিরছে। তার ছোট্ট কপালে বাবার ঠোঁটের স্পর্শ হয় ঠিকই, কিন্তু তা আর অনুভব হয় না।

বিজ্ঞাপন

মা যে দারুণ রান্না করে সেটা শুনেছিলো নানীর কাছে। প্রতিদিন কেএফসি, পিৎজা হাট আর শর্মা হাউজের ভিড়ে মায়ের রান্নার স্বাদ ভুলতেই বসেছিলো কিশোর ছেলেটি।

বৃদ্ধা সেদিন আড়াল থেকে শুনেছিলেন, তাকে নিয়ে ছেলে আর ছেলে বউয়ের ঝগড়া! বৃদ্ধাশ্রম, না কোথায় যেন পাঠিয়ে দেবে বলছিলো ওরা। কাউকে কিছু বলেননি, নিজের বদ্ধ কক্ষে নিজেকেই আটকে রেখেছেন। আশ্রয়ের শেষটুকু আঁকড়ে ধরার চেষ্টা।

করপোরেট অফিসের হাজারো কাজ ও যান্ত্রিকতায় ছুটে চলা মেয়েটির পরিবারের সদস্যদের সময় দেবার সময় কই। কাজের রাজ্যে আর করপোরেট মুখোশে নিজের মধ্যে যেন অন্যের বাস।

বিগতযৌবনা স্ত্রী কতদিন তার স্বামীর জন্য নিজেকে সাজিয়ে বসেছিলো! সময় কোথায় সাহেবের! একটুও কি সময় ছিলো না!!! অভিমান আর অপেক্ষার রাজপ্রাসাদেই সময় গেছে কত…

এই অপেক্ষা সবার। এই অপেক্ষা শহরের পিচঢালা রাস্তার, মানুষের, ভালোবাসার, ফুল-পাখির, রাতের আকাশ আর মানবিকতার! অপেক্ষা শুধু অপেক্ষা ফুরোবার।

একদিন রূপকথার গল্পের সোনার কাঠি নিয়ে কেউ এসে জাগিয়ে দেবে এই শহরকে। সবকিছু ওলটপালট করে দেবে ঘুণে ধরা-বস্তাপচা সব হিসেব-নিকেশ!

আতঙ্ক, বিষাদ আর হারানোর উপাখ্যান হলেও কেন জানি মনে হয় অপেক্ষায় পালা এবার শেষ। করোনাভাইরাস পুরো পৃথিবীর ঘুমন্ত সত্তাকে জাগিয়ে দিয়েছে। ছুটে চলার প্রতিযোগিতায় আর দাম্ভিকতায় যে মানুষ, যে পৃথিবী চলছিলো তা আজ স্তব্ধ-স্থবির। আচরণে-অভ্যস্ততায় প্রতিনিয়ত যে পৃথিবী ধ্বংস করেছি, বিষাক্ত করেছি, দূষিত করেছি, নোংরা করেছি এবার কি তার ফিরিয়ে দেবার পালা…! ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে যে পরিবার-সন্তান ও প্রিয়জনকে দূরে রেখেছি, এবার কি তাদের কাছে নেয়ার পালা.. সত্যিকারের বেঁচে থাকার রসদ দিতেই কি প্রকৃতির এমন আয়োজন….

এখন, নোংরা-দুর্গন্ধময় রাস্তাটা পাড়ার ছেলেরা নিয়মিত পরিস্কার রাখছে। দল বেঁধে টাকা তুলে, অসহায় মানুষগুলোর মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে আমাদেরই ক’জন। সামাজিক-শারীরিক দূরত্ব সচেতনতায় লাজুক, উদাসী, বেকার, পরিশ্রমী, দায়িত্বশীল কিংবা অবুঝ সব প্রাণ’ই যেন এক কাতারে।

ব্যস্ত বাবার ফুরসৎ মিলেছে। রূপকথার গল্প শুনতে চাওয়া শিশুটি সারাদিন ‘বাবা’, ‘বাবা’ বলে ঘুরছে। ব্যস্ত বাবাও প্রাণভরে চুমু খাচ্ছে তার অক্সিজেনের সিলিন্ডারটিকে। একবার ঘাড়ে তো একবার পিঠে, আবার খেলাচ্ছলেই সময় যায় পিতা-সন্তানের।

যে কিশোর বিশ্বাসই করতে পারছিলো না মা তার এত ভালো রান্না করে! সে এখন মায়ের পিছে নানা আবদারের বায়নায়… মা’ও সারাদিন ছেলের নিত্যনতুন আবদার হাসিমুখে পূরণ করছে।

আর সেই বৃদ্ধা? এখন তো সে সন্ধ্যার আসরের কেন্দ্রবিন্দু। একদিকে বউমা পায়ে তেল লাগিয়ে দেয় আর নাতনিরা চুলে বিলি কেটে নেয়। মায়ের মনে এত কথা জমে ছিলো! ছেলেবেলার গল্প শুনতে শুনতে ভাবে বৃদ্ধার ছেলে। সবাই এখন বৃদ্ধার মতোই বাড়িটাকে আঁকড়ে ধরেছে।

করপোরেট ব্যস্ততার যাঁতাকলে পিষ্ট হতে থাকা মেয়েটা এখন প্রতিদিন সময় দেয় পরিবারকে। প্রতিবেলায় খাবারটা পরিবারের সাথে খেয়ে অন্যরকম তৃপ্তি হয় তার। মুহূর্তগুলোর এমন উদযাপনই তার কাছে এখন সুখ।

রহমান সাহেব ছাদবাগান থেকে চন্দ্রমল্লিকা নিয়ে এসে গুঁজে দিয়েছেন বহুদিনের অবেহেলার, বিগতযৌবনা স্ত্রীর চুলে। ঠিক যেন তিরিশটা বছর পর ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটলো।

সংকটের এই সময়ে আমরা হয়তো স্বাভাবিকতা হারিয়েছি। কিন্তু কখনো কি ভেবেছেন আসলেই কি স্বাভাবিক ছিলো যাপিত জীবন? উত্তর “না” মনে হলে ভাবুন- পৃথিবী এখন বিশ্রাম নিচ্ছে, ওকে একটু একা থাকতে দেয়া দরকার। নিজেকে ঘরবন্দি না মনে করে পরিবারবন্দি ভাবেন। দেখবেন অনেক কিছু সহজ হয়ে যাবে।

বিজ্ঞাপন

মোবাইল আর সিরিজ থেকে চোখ সরিয়ে এবার একটু নিজের সন্তান কিংবা বাবা-মায়ের দিকে তাকান। ওনারা আর কিচ্ছু চায় না, আপনার সময়টুকু ছাড়া, আপনার মনোযোগটুকু ছাড়া।

যে স্ত্রী পথ চেয়ে বসে থাকতো আপনার জন্য, ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে যাকে সময় দিতে পারেননি, তাকে এবার দাম্পত্যের আসল রূপটা দেখতে দিন। জীবনের কোনো কিছুই তুচ্ছ নয়, এবার না বুঝলে আর কবে বুঝব আমরা?

এই মৃত নগরে আবার ভালোবাসা ফিরে আসবে। অদৃশ্য ঘাতকরা পরাজিত হবে। হুমায়ূনরা ফিরবে চাঁদনি পসর রাতের স্নিগ্ধতায়। প্রিয়তমার হাত ধরে আবার হারিয়ে যাবে শুভ্র। শহীদ কাদরীরা ব্ল্যাক আউটের পরিবর্তে দুমড়ে দিবে এই লকডাউন। প্রকৃতিতে ফিরে আসবে মানুষের ভ্রাতৃত্ব-ভালোবাসা ও মানবিকতার গল্প। বুটের শব্দ নয়, নগরী ভরে উঠবে চঞ্চল শিশুদের উল্লাসে…

ভালো থাকুক পৃথিবী…

সারওয়ার খান: প্রাক্তন শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট। ইমেইল: [email protected]

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.