Sylhet Today 24 PRINT

মানুষকে মানুষের মর্যাদা দিন

জাহাঙ্গীর জয়েস |  ২৭ এপ্রিল, ২০২০

আমাদের দেশের মেরুদণ্ডকে যারা ঝড় তুফানে খাড়া রাখেন নিঃসন্দেহে তাদের অন্যতম হচ্ছেন কৃষক, গার্মেন্টস শ্রমিক, চা শ্রমিক, প্রবাসী শ্রমিক। কিন্তু লজ্জাজনক হলেও সত্য হচ্ছে যে, এরাই সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত, লাঞ্ছিত, অপমানিত, নির্যাতিত এবং অধিকারহীন।

প্রথমেই আসি আমাদের দুঃখী কৃষকের কথায়। তারা ফসলের মূল্য পাক আর না পাক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফসল ফলাচ্ছেন। রোদ বৃষ্টি ঝড় কোনো কিছুই তাদের দমাতে পারে না। প্রতিবছর কয়েকজন বজ্রপাতে মৃত্যুর শিকার হন। অথচ দামের বেলায় মাথায় হাত। সরকার একটা দাম বেঁধে দিলেও সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে না কেনায় প্রান্তিক কৃষক বা সরাসরি যারা অমানুষিক শ্রম দিয়ে ধান উৎপাদন করে তাদের কোনো কাজে আসে না তা। যার জন্য প্রতিবছর কৃষক সমিতি, ক্ষেতমজুর সমিতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিসহ বিভিন্ন সংগঠন সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনার দাবি করে আসছে। ইউনিয়নে-ইউনিয়নে ক্রয় কেন্দ্র খোলার কথা বলে আসছে বছরের পর বছর ধরে। আর তা না করার ফলে লাভ পাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগী। বেশিরভাগ খুদে কৃষক যেহেতু ধার কর্জ করে ধান ফলায় তাই তারা কেটেই সেগুলো বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয় ঋণ পরিশোধ করার জন্যে। তাই সরকার গতবছর ১০৪০ টাকা ধানের মণ নির্ধারণ করলেও কোনো সাধারণ কৃষক সর্বোচ্চ ৬০০ টাকার বেশি বিক্রি করতে পারেনি। বেশিরভাগ ধান চাষি ৫০০, সাড়ে ৫০০ টাকা এমনকি তারচেয়েও কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হয়। প্রায় সব ধরনের ফসলের ক্ষেত্রে মূল্যের ব্যাপারে একই অবস্থা বলা যায়। আশপাশের অনেক কৃষকের সঙ্গে আলাপ করে বুঝা যায় যদি তাদের বিকল্প থাকতো তারা এই অলাভজনক হাড়ভাঙা খাটুনির কাজ ত্যাগ করতেন।

বিজ্ঞাপন

সুতরাং অবশ্যই কৃষকরা তাদের হাড়ভাঙা খাটুনির ফসল যেনো রাস্তায় ফেলতে বাধ্য না হোন সে বিষয়ে সরকারের আরও সতর্ক পদক্ষেপ নিতে হবে এবং অবশ্যই তা এমন হতে হবে যে কৃষকরা যেনো তাদের বালবাচ্চা নিয়ে ভালোভাবে জীবনযাপন করতে কোনো সমস্যা না হয়।

গণমাধ্যমে দেখছি বাগেরহাট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনাসহ বিভিন্ন জায়গায় সিপিবি, ছাত্র ইউনিয়ন, যুব ইউনিয়ন কৃষকের ধান কাটায় সহযোগিতা করছে। বিভিন্ন চ্যানেলের স্ক্রলে দেখলাম কৃষক লীগের হটলাইন নাম্বার দেয়া হয়েছে যাতে কৃষকদের সহযোগিতা করা যায়।

বিভিন্ন সংগঠনের এই ভূমিকা অভিনন্দনযোগ্য কিন্তু এটা তো সমাধানের পথ নয়। এবার না হয় কোভিড-১৯ মহামারীর প্রেক্ষিতে বিভিন্ন জায়গা থেকে শ্রমিক আসতে পারছে না। কিন্তু গতবারের দিকে তাকান। বিষয়টা কী ছিলো? শ্রমিকদের মজুরি দিতে না পারায় তাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। কিন্তু কৃষক যদি ফসলের লাভজনক দাম পায় তাহলে শ্রমিকদের মজুরি দিতে তো তার সমস্যা নাই। এতে সবাই উপকৃত হবে। কৃষকের ধান ক্রয়ের সময় বলবেন রাখার জায়গা নেই আবার বাইর থেকে লক্ষ লক্ষ টন চাল আমদানি করবেন। এসব ভাওতাবাজি ছাড়তে হবে।

দেশের আরেক সোনার ডিম পাড়া হাঁস আমাদের পোশাক শিল্প। যেখানে অধিকাংশ পোশাক শ্রমিকরা অমানবিক পরিবেশে লড়াই করছেন দেশের জিডিপির ঘোড়াকে চ্যাম্পিয়ন করতে। অথচ প্রায়ই তাদের রাস্তায় নামতে হয় শুধু নিজের বেতন আদায়ের জন্যে। প্রায় ক্ষেত্রেই বকেয়া হয়ে পরে কয়েক মাসের বেতন। মজুরি বৃদ্ধির দাবি আসলেই চলে আসে নানা ধরনের টালবাহানা। ছাঁটাইয়ের প্রতিবাদ, কর্মপরিবেশ উন্নয়ন, মজুরি বৃদ্ধির দাবি আসলেই নেমে আসে হুমকি ধমকি, নির্যাতন, হামলা মামলা। অথচ তাদের দোহাই দিয়ে তারা বারবার বড় বড় দান মারে।

৫ এপ্রিল, এই মহামারীর সময় কী পরিহাসটাই না করলো মালিকপক্ষের মহান মানব-মানবীরা! ভাবে-সাবে মনে হয় সরকারও যেনো তাদের কাছে কিছু না।

এই বন্ধের সময়ও সরকারের আদেশ অমান্য করে তারা হাজার হাজার শ্রমিক ছাটাই চালিয়েই যাচ্ছে। বিভিন্ন ছলে বলে তারা কারখানা যত দ্রুত খোলা যায় সেই তালে আছে। এই শ্রমিকরা তাদের কাছে টাকা বানানোর মেশিন ছাড়া আর কিছু নয়।
গত ২৪ এপ্রিল বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনার সাত বছর পূর্ণ হলো। ২০১৩ সালের এই দিন সাভারের রানা প্লাজার ধ্বস যাকে দুর্ঘটনা না বলে হত্যাকাণ্ড বলাই সঙ্গত। যেখানে এক হাজার চৌত্রিশ জন শ্রমিক মারা যায়। ২৪৩৮ জন গুরুতর জখম হয়। যা বিশ্বে তৃতীয় বৃহত্তম দুর্ঘটনা।

ওই দুর্ঘটনার পর কারখানাগুলোর অমানবিক পরিবেশ বিশ্ববাসীরও চোখ খুলে দেয়। তখন দেশি বিদেশি চাপে কিছু কাজ হলেও আজ পর্যন্ত বহু শ্রমিক তাদের সঠিক ক্ষতিপূরণ থেকে বঞ্চিত। অনেকেই পঙ্গু হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। অথচ দুর্ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী এবং বিজিএমইএ'র তহবিলে তাদের সাহায্যের জন্যে কোটি কোটি টাকা এসেছে দেশ বিদেশের বিভিন্ন মানুষ এবং প্রতিষ্ঠান থেকে। এমনকি গার্মেন্টস শ্রমিক এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মানুষ তাদের এক দিনের বেতন দিয়েও সহায়তা করেছিলেন। অথচ যাদের শ্রমে ঘামে ভোগ বিলাস তাদের মানুষই মনে করেন বলে মনে হয় না। এখনো এই লকডাউনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাদেরকে আন্দোলন করতে হয় বেতনের জন্যে। আর কতো টাকা, ক্ষমতার মালিক হলে আপনারা তাদের মানুষ মনে করবেন, লজ্জিত হওয়া শিখবেন!

বিজ্ঞাপন

এবার আসি চা শ্রমিক প্রসঙ্গে। প্রায় সাত লাখ চা শ্রমিক নামকাওয়াস্তে মজুরিতে অর্থনীতির চাকায় শান দিচ্ছেন। চাকা যতো এগুচ্ছে তাদেরও ততো আগাবার কথা কিন্তু সেটা দেখা যাচ্ছে না। বরং তারা যেনো দেশের ভেতরে থেকেও দেশের ভেতরে না। সারা দেশ যখন ঝুঁকিপূর্ণ, লকডাউনে, ছুটিতে। রাষ্ট্রের হর্তাকর্তারা যখন বলছেন ঘরে থাকুন, নিরাপদ থাকুন। তখন তাদের নাকি কোনো ঝুঁকি নেই। প্রকৃতির অপার মায়ায় তারা ঝুঁকি মুক্ত। তাই তাদের ছুটি নেই, লকডাউন নেই। ওখানে নাকি কোভিড১৯ ঢুকার পথ পাবে না। কিন্তু ৩১ মার্চ ডেইলি স্টারের একটা প্রতিবেদনে শ্রীমঙ্গলের মির্জাপুর চা বাগানের একজন নারী শ্রমিক করোনা লক্ষণ নিয়ে মারা গেছেন বলে খবর বেড়িয়েছি। তাছাড়া চুনারুঘাট উপজেলার চণ্ডীছরা চা বাগানের এক শিশু ২৫ এপ্রিল করোনাভাইরাসে মারা গেছে। আরও একজন করোনা পজিটিভ। ২৫ মার্চ যখন সরকারি বেসরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয় তখন চা শ্রমিকরা সেই ছুটি পায়নি।

৩০ মার্চ প্রধানমন্ত্রী সিলেট বিভাগীয় জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে মত বিনিময়েও চা শ্রমিকের ছুটির ঘোষণা না আসার কারণে ৩১ জন নাগরিক ক্ষোভ প্রকাশ করে রেশন ও এক মাসের বেতনসহ ছুটির দাবিতে বিবৃতি প্রদান করেন।

অন্যদিকে কুলাউড়া উপজেলার কালিটি চা বাগানের ৫৩০ জন শ্রমিক তিন মাস যাবত তাদের মজুরি ও রেশন পাচ্ছেন না। ধর্মঘট, আন্দোলন, ভুখা মিছিল করেও প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করাতে পারছেন না। বিভিন্ন টালবাহানা করে কাজ চালিয়ে গেছে মালিক। আর এখন নাকি উনি লাপাত্তা। ধনী উৎপাদনে সারা বিশ্বে প্রথম হওয়া রাষ্ট্র এখানে নিশ্চুপ। আর তাদের বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ বিভিন্ন সমস্যা তো আছেই। এভাবে সরকার তার নাগরিকদের সমতা নিশ্চিতের সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় উদাসীনতা, নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণ জয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে এরকম বৈষম্য কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।

রাষ্ট্র তথা সরকারের উন্নত জিডিপির আখ্যানে আরেক মহামূল্যবান অধ্যায় প্রবাসী রেমিটেন্স। রেকর্ড রিজার্ভের ঢেঁকুর তুলে ভুলে যান তারা প্রবাসীরা কীভাবে বিদেশ যায়, কীভাবে দিন যাপন করে। তাদের কর্মপরিবেশ কেমন। রাষ্ট্র নির্ধারিত ব্যয়ের কতো গুণ বেশি খরচ করে তারা বিদেশ যায়। পদে পদে ভোগান্তি আর অবহেলা, তুচ্ছতাচ্ছিল্য সহ্য করে স্বপ্নের প্রবাসে যায় তারা। সাগরে ডুবে, মরুভূমি, পাহাড় জঙ্গলে কতো জন মারা যায়। তাদের প্রয়োজনে দূতাবাসের সহযোগিতা কেমন।
বছর বছর কতো প্রবাসীর লাশের স্তূপে জিডিপির ঘোড়া দৌড়ে।

ইতোমধ্যে সিংগাপুর যতো মানুষ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে তার অর্ধেক বাংলাদেশী। প্রায় তিন হাজারের কাছাকাছি। কেনো? কারণ আমাদের রেমিটেন্স যোদ্ধারা ওখানে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর গণরুমের মতো গাদাগাদি করে থাকতে বাধ্য। তাদের কর্মপরিবেশ খুব সুখকর নয়। সৌদি থেকে কতো নারী নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরেছে তার কোনো কৈফিয়ত আছে রাষ্ট্রের হর্তাকর্তাদের কাছে? তাদের চোখের জলে কারো হৃদয় ভিজে বলে তো মনে হয় না!

চোখ খুলে দেখুন কার শ্রমে রূপ লাবণ্য, কার শ্রমে ভোগ বিলাস, কার ঘামে ঝলমল অট্টালিকা, কার ঘামে স্বপ্নবিলাস। সুতরাং মানুষকে মানুষের মর্যাদা দেন। তার অধিকার নিশ্চিত করেন।

জাহাঙ্গীর জয়েস: কবি ও রাজনৈতিক কর্মী।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.