Sylhet Today 24 PRINT

সিঙ্গাপুরের গবেষণা এবং বাংলাদেশের দিবাস্বপ্ন

ডা. ময়ূখ চৌধুরী |  ৩০ এপ্রিল, ২০২০

গত দুই দিন ধরেই এই একটা সংবাদ বাংলাদেশের সব যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে ❛মে মাসেই বাংলাদেশ থেকে করোনার বিদায়: সিঙ্গাপুরের গবেষণা❜। সঠিক অনুধাবন ছাড়াই যোগাযোগ মাধ্যমে ফলাও করে এরকম ত্রুটিপূর্ণ একটা গবেষণাকে দেশজুড়ে মোটাদাগে প্রচার করাটা অনেকটাই খাল কেটে কুমির আনার মত; ব্যাপক বিপর্যয়ের নিয়ামক। কীভাবে?

বিজ্ঞাপন

প্রথমে আসি গবেষণাটা কেন গ্রহণযোগ্য না?

১. প্রথমত বলে রাখতে হয় যে গবেষণাটি কিন্তু কোন পিয়াররিভিউড জার্নালে প্রকাশিত না। SUTD Data-Driven Innovation Lab এর নিজস্ব পোর্টালে প্রকাশিত, অর্থাৎ বৈজ্ঞানিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে এখনো জাস্টিফাইড না। শিক্ষানবিস, ছাত্র থেকে গবেষকরা নিছক অনুশীলন কিংবা শখের বসে একটা মডেল তৈরি করতেই পারেন, আমরা নিজেরাও করে থাকি, কিন্তু সঠিক পর্যবেক্ষণ ছাড়া এগুলোকে কোনভাবেই মোটাদাগে প্রয়োগ করা যাবেনা। ভবিষ্যৎবাণী হিসেবেও চালিয়ে দেওয়া যাবেনা। কেন?

২. এ মডেলগুলো তৈরি হয় এসাম্পশন তথা অনুমানের ভিত্তিতে। ডাটা সাইন্স, এপিডেমিওলজিতে নিয়মিতভাবে সিমুলেশন মডেল নিয়ে কাজ করা হয়ে থাকলেও এর মধ্যে কেবলমাত্র হাতেগোনা কিছুই গ্রহণযোগ্যতা পায়। অনুমানের গ্রহণযোগ্যতা এরকম মডেলের প্রধান অন্তরায়। আলোচিত এই মডেলটাও এরকম অনেকগুলো অগণনযোগ্য মডেলের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।

যেমন- তারা বলেছেন "In particular, the model assumes a constant population, uniform mixing of the people, and equally likely recovery of infected", অর্থাৎ বিশ্বের সর্বত্র মানুষের মেলামেশা অভিন্ন। এখন চীনের লকডাউনের সাথে যদি সুইডেনের নন-লকডাউন কিংবা বাংলাদেশের আংশিক লকডাউন গুলিয়ে ফেলা ব্যাপারটা অনেকটাই ভজঘট হবেই।

- এই মডেলের এসাম্পশনের সুরে সুইডেন, বাংলাদেশ এবং সোমালিয়ার সব মানুষ একই হারে আক্রান্ত হবেন এবং রোগমুক্তি পাবেন। তারা ভুলে গেছেন যে রোগের গতিবিধি, আউটকাম অনেকগুলো ফ্যাক্টরের উপরে নির্ভর করে, এ ব্যাপারে কথা বলতে গেলে একটা বই লেখা যায়! একবার নিজেরাই ভাবুন যেদেশগুলোর গড় আয়ু যথাক্রমে ৮২, ৭৬, ৫৪ , স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আকাশ-পাতাল তফাৎ, সার্বিক পরিচ্ছন্নতার বিশাল তারতম্য, সেখানে এ হারগুলো কীভাবে একরকম হবে?

৩. সার্বিকভাবে কোভিড-১৯ নিয়ে এপিডেমিওলজিক্যাল গবেষণাগুলোর সবচেয়ে বড় অন্তরায় হচ্ছে রিপোর্টিং, আর এই লুপহোলের উপরেই কিন্তু আলোচ্য গবেষণাটির SIR (Susceptible-Infected-Recovered) Model নির্মিত। এখানকার উদাহরণ দেই। সুইডেনে শুরু থেকেই হালকা সর্দিকাশি নিয়ে রোগীদেরকে বাসায় থাকার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। সেক্ষেত্রে তারা কিন্তু আক্রান্ত হলেও রিপোর্টিংয়ের আওতার বাইরে। আর যারা এসিম্পটোমেটিক, তাদের কথা বাদই দিলাম। বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই চিত্রটা এরকম। তাই কত জনের মধ্যে কত ভাগ আক্রান্ত আর তারমধ্যে কতজন সেরে উঠছেন ব্যাপারটা সহজভাবে অনুমান করে নেওয়াটা অসঠিক।

বিজ্ঞাপন

৪. তাদের গবেষণার আরেকটা অন্তরায় হচ্ছে- তারা ধরেই নিয়েছে রোগের গতি একইভাবে থাকবে লকডাউন কিংবা ইন্টারভেনশান ছাড়া। আমাদের ভুলে গেলে হবে না, সংক্রমণ কমে গেলেও ইন্টারভেনশান তুলে ফেললে আমরা আবার আগের পর্যায় ফিরে যেতে পারি। শতবর্ষ আগে ১৯১৮-১৯ সালের স্প্যানিশ ফ্লুর কথা কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, প্রথমবারের থেকে প্রায় ৫ গুণ বেশি জোরে আঘাত হেনেছিল দ্বিতীয় ওয়েভ।

এবার আসি, যোগাযোগ মাধ্যমে এরকম ত্রুটিপূর্ণ গবেষণা প্রচারের ঝুঁকি প্রসঙ্গে। রিপোর্টের প্রথম অংশে তারা নিজেরাই সাফ অক্ষরে ডিসক্লেইমার জুড়ে দিয়েছেন যে গবেষণাটি শুধুমাত্র একাডেমিক উদ্দেশ্যে, বিভিন্ন দেশের বাস্তবচিত্রের সাথে মানানসই নয়। যাচাই করে নেওয়ার দায়িত্ব পাঠকের এবং এ তথ্যের ওপর ভিত্তি করে খুব আশাবাদী হওয়া যাবে না। বরং এর উপর ভিত্তি করে অত্যধিক আশাবাদী হয়ে আমরা যদি কঠোর ব্যবস্থা বন্ধ করে দিলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।

দুঃখজনকভাবে যেসব গণমাধ্যম সংবাদটি প্রকাশ করেছেন তারা কেউ এ ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছেন বলে চোখে পড়েনি। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে জনস্বাস্থ্যে চিকিৎসক এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের পাশাপাশি কিন্তু অবিসংবাদিতভাবে গণমাধ্যমের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। গণমাধ্যম যেভাবে নীতিনির্ধারকদের প্রভাবিত করতে পারে, এর চেয়ে আরও বেশি প্রভাবিত করতে পারে দেশের সাধারণ জনগণকে। যক্ষ্মার চিকিৎসা থেকে, টিকাদান কর্মসূচি, পরিবার পরিকল্পনাসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য প্রকল্পে গণমাধ্যমের সহস্র-নিযুত গৌরবোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আছে আমাদের বাংলাদেশে। তাই তাদের কাছ থেকে আশাটাও বেশি। কথায় আছে - A great power comes a great responsibility.

ডা. ময়ুখ চৌধুরী: কনসালটেন্ট, এপিডেমিওলজি এন্ড এইচইওআর, সাইন্টিফিক সল্যুশন স্ক্যান্ডিনেভিয়া, স্টকহোম

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.