Sylhet Today 24 PRINT

জাফরুল্লাহ যেন ইবসেনের নিবেদিতপ্রাণ ‘গণশত্রু’ স্টকম্যান

ফয়সল সাইফ |  ৩০ এপ্রিল, ২০২০

বাংলাদেশে কৃষকের ধানের চেয়ে বোতলজাত পানির দাম বেশি— প্রায় দ্বিগুণের কাছাকাছি। আবার বাজার থেকে সেই ধান থেকে হওয়া চাল কিনতে গেলেই চিত্র সম্পূর্ণ বদলে যায়। এমন অভিযোগ আছে অন্য অনেক ফসলের ক্ষেত্রেও। কেন? সে প্রশ্নের উত্তর আপনি লিগ্যাল অথরিটির কাছে কখনোই পাবেন না। এদেশের চামড়াজাত পণ্যের শিল্প এখনও কাঁচামাল আমদানি নির্ভর। কেবল ২০১৮-১৯ অর্থ বছরেই প্রায় সাড়ে নয়শ কোটি টাকার চামড়া বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়েছে। অথচ গত কোরবানির ঈদেই লাখ টাকায় কেনা পশুর চামড়ার দাম উঠেছিল মাত্র ৩০০-৪০০ টাকার মত। পরে বিরক্ত হয়ে অনেকেই তা বিক্রি না করে স্থানীয় এতিমখানায় দিয়ে দিয়েছিল কিংবা পুঁতে ফেলেছিল। মনে আছে সেই সময় দেশব্যাপী চামড়ার দাম কেমন অস্বাভাবিকভাবে পড়ে গিয়েছিল? জিজ্ঞেস করলে ট্যানারি মালিকদের সংগঠন বলেছিল, তারা চামড়া আরও ১০-১২ দিন পর সংগ্রহ করবে। ওই সময় পর্যন্ত ব্যবসায়ীরা চামড়া সংরক্ষণ করে রাখতে পারলেই কেবল তারা সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া কিনবেন! কী আশ্চর্য ব্যাপারস্যাপার!

বিজ্ঞাপন

আমদানি নির্ভর একটা শিল্পের ক্ষেত্রে দেশি কাঁচামালের এমন অবমূল্যায়ন কিছুটা অবাক করে না? কিন্তু এসব কেন হয় আপনি দায়িত্বশীল কোনো পর্যায় থেকেই এড়িয়ে যাওয়া ছাড়া এর কোনো সদুত্তর পাবেন না। সম্প্রতি করোনাভাইরাস দ্রুত পরীক্ষা করতে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের উদ্ভাবিত র‌্যাপিড কিট নিয়ে যা হচ্ছে, তা-ও আসলে এই দেশে একেবারে নজিরবিহীন কিছু নয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের মতে, গণস্বাস্থ্যের উদ্ভাবিত র‌্যাপিড টেস্ট কিটের মাধ্যমে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত ভুল ফলাফল আসতে পারে। যদিও গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতার মতে এটা ৯৩ শতাংশ নির্ভুল। যাইহোক, প্রশ্ন হচ্ছে, যথেষ্ট পরিমাণে রোগীই টেস্ট করা যাচ্ছে না এমন একটি দেশের জন্য শতকরা ৮৫ শতাংশ নির্ভুল ফলাফল দিতে সক্ষম কিটের ব্যবহার কি সত্যিই ঝুঁকিপূর্ণ? কিংবা নির্ভুল ফলাফল প্রদানের হার এর চেয়ে কিছুটা কম হলেও? এটা তো কোনো ভ্যাকসিন নয় যে অবশিষ্ট ১৫ শতাংশের তাতে জীবন নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে। তবুও কেন মাঠ পর্যায়ে এর কার্যকারিতার হার পরীক্ষা করে দেখতেই এমন গড়িমসি? এদিকে ঢাবির টেকনিক্যাল কমিটির সদস্যরাও জানিয়েছেন, কিট তৈরির সক্ষমতা রয়েছে জানানোর পরও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে একমাসেরও বেশি সময় ধরে তারা কোনো আনুষ্ঠানিক সাড়াই পাচ্ছেন না! মানবদেহে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি টেস্ট করার ক্ষেত্রে শতভাগ আমদানির উপর নির্ভরশীল একটি দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওসব ক্ষেত্রে এমন ধ্যানমগ্ন ঋষির ভূমিকা নেওয়ার পেছনে রহস্য কী?

বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের অব্যবস্থাপনা ও ব্যাপক দুর্নীতি নিয়ে অভিযোগ নতুন কিছু নয়। দুর্নীতির মাধ্যমে পাহাড় গড়া ‘ছোট মাছ’ এক আবজাল হোসেনের সম্পত্তি ঘাঁটলেই গোটা স্বাস্থ্যখাতের অনিয়ম-দুর্নীতির হালহকিকতের কথা চিন্তা করে চোখ কপালে উঠে যাওয়ার মত অবস্থা হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তৃতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা ছিলেন আবজাল হোসেন। যার মাসিক বেতন সবমিলিয়ে ৩০ হাজার টাকার মত। অবিশ্বাস্য মাত্রায় দুর্নীতি করে সেই তিনিই তার নিজের ও স্ত্রীর নামে দেশ-বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছিলেন। কীভাবে সম্ভব? দুদকের অনুসন্ধানে সেসব বেরিয়ে এলে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে ডাকা হয়। তিনি এসবের কোনো সদুত্তর দিতে না পেরে দুদক কর্মকর্তাকে ‘ম্যানেজ’ করার চেষ্টা করেন। তা-ও সম্ভব না হলে তিনি কর্মকর্তার পা জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, তিনি একা ওসব দুর্নীতি করেননি। এর পেছনে আরও অনেকেই আছেন। তিনি সেসব দুর্নীতির ডকুমেন্টস দিবেন বলে সময়ও নিয়েছিলেন। এরই মধ্যে দুদকের আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত থেকে আবজাল দম্পতির সম্পদ ক্রোক ও ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ জারি করা হয়েছিল। কিন্তু ওই আদেশ জারির আগে ও পরে আবজাল হোসেন সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংকের ২১টি শাখা থেকে অন্তত ১০০ কোটি টাকা তুলে নিয়েছিলেন। আদালতের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও পরবর্তীতে তিনি বিদেশ পালিয়ে যেতেও সক্ষম হন। সূত্র: ১৬ নভেম্বর ২০১৯, যুগান্তর।

বিশ্বাস করতে পারেন, এতসব নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে কেবল একার শক্তিতে আবজাল দেশ থেকে বেরিয়ে যেতে পেরেছেন? ২০১৯ এর জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে স্বাস্থ্যখাতে কেনাকাটা, নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, পদায়ন, চিকিৎসাসেবা, চিকিৎসায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ব্যবহার, ওষুধ সরবরাহসহ মোট ১১টি খাতকে দুর্নীতিগ্রস্ত উল্লেখ করে—এসব প্রতিরোধে ২৫ দফা সুপারিশ করে তা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর হাতে তুলে দিয়েছিল দুদক। কেবল চিকিৎসায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় দুর্নীতির চিত্রটি কেমন তার একটি ছোট চিত্র পাওয়া যায় ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে। ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ১৫ হাজার টাকার ব্লাড ওয়ারমারের দাম দেখানো হয়েছে ৯ লাখ ৩২ হাজার টাকা। একইভাবে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকার কান পরীক্ষার অটোস্কোপের দাম দেখানো হয়েছে ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা। ২ কোটি ৮০ লাখ টাকার এমআরআই মেশিনের দাম দেখানো হয়েছে ৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। শুধু তা-ই নয়, এই করোনা সংকটেও থেমে নেই স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতি। গত ২৬ তারিখ ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ পত্রিকা এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাদের প্রতিবেদনে উঠে আসে, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় চিকিৎসা সামগ্রী কেনাকাটায় অর্থবিভাগ থেকে ছাড় করা টাকার মধ্যে অন্তত ২২ কোটি টাকার সঠিক হিসাবই দিতে পারছে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এর মধ্যে বিদেশ থেকে উন্নত এন-৯৫ মাস্ক আমদানির কথা বলে দেশীয় প্রতিষ্ঠান থেকে নিম্নমানের সার্জিক্যাল মাস্ক সমমানের মাস্ক সরবরাহের মত ন্যক্কারজনক কেলেঙ্কারিতেও জড়িয়েছে সংশ্লিষ্টরা। তীব্র সমালোচনা ও বিতর্কের মধ্যে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ভুল স্বীকার করে দায়মুক্তি চেয়েছে অবশ্য। কিন্তু আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে যে মাস্কটি ডাক্তার ও নার্সদের জন্য একেবারেই অপরিহার্য সেটার মান নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ কোনো প্রতিষ্ঠানের মাথাব্যথা ছিল না কেন? যেভাবে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের উদ্ভাবিত স্বল্পমূল্যের টেস্টিং কিটের শতভাগ কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে করে তারা মাথা ঘামিয়ে একাকার হচ্ছেন।

এসব আসলে খুবই কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়। রাষ্ট্র আক্রান্তদের জন্য যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারছে না। রোগীদের থাকার ভালো পরিবেশ দিতে পারছে না। ডাক্তার-নার্সদের প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সরঞ্জাম দিতে পারছে না—তারা আক্রান্ত হচ্ছে। প্রতিদিন আবেদনকারীদের খুবই সামান্য একটি অংশকে মাত্র টেস্টের আওতায় আনতে পারছে। এমন অবস্থায় নিজ দেশে উদ্ভাবিত স্বল্পমূল্যের করোনাভাইরাস টেস্টের কিট নিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত কিছু লোক একজোট হয়ে নানান প্রশ্ন তুলেই যাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে স্বাস্থ্যখাতের কোনোদিকে তেমন কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সবদিকেই ঢিলেঢালা অবস্থা। এদিকে এপ্রিলের শুরুতে যে গার্মেন্টসের একাংশের শ্রমিকদের দলবেঁধে পায়ে হেঁটে চাকরিতে ফিরতে বাধ্য করা হল। আবার ওইদিনই দলবেঁধে বাড়িও পাঠানো হল— তা নিয়েও স্বাস্থ্যখাত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের তেমন কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয়নি। এ থেকে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার কোনো আশঙ্কা করে কেউ একটা কথাও বলেনি। জাতির জন্য তাদের যত বিপদের ভয় সব শুধু গণস্বাস্থ্যের উদ্ভাবিত কিট নিয়ে। তা-ও এটা কোনো ভ্যাকসিন নয়। হাস্যকর নয় ব্যাপারটা?

বিজ্ঞাপন

নিয়মনীতি বলে যে দেশে কিছু আছে তা নিয়ে প্রায় সবসময়ই কর্তৃপক্ষকে আমরা নির্বিকার দেখি। কিন্তু হঠাৎ করে সব নিয়ম-কানুন এসে হাজির নিজ দেশে উদ্ভাবিত স্বল্পমূল্যের টেস্ট কিটটির সামনে। এখানেই শুরু হল সব ছিদ্রান্বেষণের প্রক্রিয়া। টেস্ট না করার চেয়ে কি কিছু ভুলের সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও টেস্ট করে নেওয়া উত্তম নয়? মোটাদাগে এর নেগেটিভ ইফেক্ট তো বলার মত তেমন কিছুই নয়। তা-ও কার্যকারিতা যাচাই না করে এই কিট ব্যবহার করতেই হবে এমন দাবি গণস্বাস্থ্য তুলেনি। টেস্টবিহীন একজন ভাইরাস পজিটিভ রোগীর সাধারণ্যে হাঁটাচলা মেনে নেবেন, কিন্তু মাত্র কয়েকশ টাকার টেস্টের ফলে কিছু ভুল-নেগেটিভ (মূলত যিনি পজিটিভ) রোগীর সাধারণ্যে হাঁটাচলা মেনে নিবেন না, আমদানির স্বার্থে এই তো খেলো যুক্তিটি আপনাদের? অথচ কার্যকর ভ্যাকসিন নাই—এই পরিস্থিতিতে অধিক থেকে অধিকতর টেস্টের মাধ্যমে ভাইরাস আক্রান্তদের আলাদা করে ফেলা ছাড়া ভালো বিকল্প কী? উন্নত বিশ্ব ঠিক এই কাজটিই করে যাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ শুরু থেকেই যেন উল্টো।

আর এদিকে কিট নিয়ে বিপাকে পড়া গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের অবস্থা দেখে মনে পড়ে যাচ্ছে, উনিশ শতকের প্রভাবশালী নরওয়েজিয়ান নাট্যকার হেনরিক ইবসেনের নাটক ‘অ্যান ইনেমি অব দ্যা পিপল’-এর কথা। সাধারণের জন্য নিবেদিতপ্রাণ একজন মানুষ (ডা. স্টকম্যান) সাধারণের জন্য লড়াই করতে নেমে কীভাবে সুবিধাভোগী শ্রেণির অব্যাহত ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচারের ফলে শেষ পর্যন্ত সাধারণের চোখেই হয়ে উঠেন একজন গণশত্রু—ইবসেনের নাটকে মূলত তা-ই তুলে ধরা হয়। জনকল্যাণ নয়, গণস্বাস্থ্য মূলত ব্যবসার জন্য তাদের উদ্ভাবিত শতভাগ সফল নয় এমন একটি কিট তড়িঘড়ি করে সরকারের কাছে হস্তান্তরের আড়ালে বাজারজাত করে মুনাফা অর্জন করতে চাইছে, কিংবা এর পেছনে আছে ডা. জাফরুল্লাহর নোংরা রাজনীতির খেলা—এ জাতীয় প্রচারণা শেষমেশ তাকে যেন উল্টো গণশত্রুর উপাধিই দিতে চাইছে। তাহলে ইবসেনের স্টকম্যান কি আজকের বাংলাদেশে জাফরুল্লাহর মধ্যে ফিরে আসছেন না?

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.