Sylhet Today 24 PRINT

স্মরণ : বিমলেন্দু দে নান্টু

মিহিরকান্তি চৌধুরী |  ০৫ মে, ২০২০

সিলেট জেলা ক্রীড়া সংস্থার প্রাক্তন সহ-সভাপতি, মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, সিলেট এর সিনিয়র সহ-সভাপতি, বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক, শহরের বিশিষ্ট বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিক, রামকৃষ্ণ মিশন, নিম্বার্ক আশ্রমসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে সংশ্লিষ্ট বিমলেন্দু দে নান্টু আমাদের অনেকের প্রিয় নানটুদা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন চিরতরে। তবে সে যাওয়া শুধুই শারীরিক। আমাদের মনে, স্মৃতিতে তিনি চির অম্লান হয়ে থাকবেন এজন্য যে এভাবে থাকার ব্যক্তিত্ব ছিল তাঁর, সকলের সাথে ছিল তাঁর হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক।

নান্টুদার সাথে পরিচয় আশির দশকের মাঝামাঝি। তাঁর ছেলে আমার ছাত্র ছিল। আমার বড়দাদার বয়সী হলেও শিক্ষক বিশেষ কওে ছেলের শিক্ষক বলে একটা মর্যাদা দিতেন, ‘আপনি’ বলতেন। দুই একবার বদলাতে চেষ্টা করে বাদ দিয়েছি। ১৯৮৮ সালে আমার পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে নান্টুদা কৃতী অভিভাবকের সম্মাননা পেয়েছিলেন। তাঁর বাসায় অনেকবার আপ্যায়িত হয়েছি। আমার সাথে শিক্ষকও আপ্যায়িত হয়েছে। তাঁর তৃতীয় ভাই পিন্টুদা আমাদের এলাকার জামাই। সম্পর্ক আমার ভাতিজীর জামাই। বয়সে বড় বলে উল্টো পিশা (পিশেমশায়) ডাকতাম। চতুর্থ ভাই বিজন স্যারের সাথে ঘনিষ্ঠতা ছিল বেশি। তিনি ব্লু-বার্ড স্কুলের জনপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন। সেখানে আমিও বেশ কয়েক বছর খণ্কাডলীন শিক্ষক ছিলাম। পাঁচ ভাইয়ের ছোট বাদলদা ছাড়া নান্টুদার সব ভাইয়ের ছেলেমেয়েরাও আমার ছাত্রছাত্রী ছিল।

বিজ্ঞাপন

নান্টুদার ব্যক্তিত্বের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক যেটা আমাকে অভিভূত করেছিল তা ছিল তাঁর একান্নবর্তী পরিবারের প্রকৃত দর্শনকে ধারণ করা। তিনি তাঁর সব ভাইবোনদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ হলেও তিনি ছিলেন তাঁদের সকলের ‘মেজদা’ কারণ গোষ্ঠীতে আরও কেউ ‘বড়দা’ ছিলেন। আজকাল এ বোধ অনুপস্থিত। কাজিন বলে আগে কিছু ছিল না। সবাই ছিল ভাইবোন । শুধু তালতো ভাইবোনকে (সিলেটি আঞ্চলিক ভাষায় তালইর ঘরর ভাই বা বোন) একটু অন্য বিবেচনায় দেখা হতো। এখন কাজিন পরিচয় দেয়। সবাই কাজিন। ভাবটা এমন যে সবাই নিজ নিজ মায়ের জরায়ুর হেফাজতে ব্যস্ত। একান্নবর্তী পরিবারের মূল দর্শন ছিল ‘এক অন্ন (ভাতের ডেগ), এক মন’। কিন্তু আজকাল বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় ‘এক ডেগ, বহু মন’। এসকল পরিবারকে ডেগান্নবর্তী পরিবার বলাই শ্রেয়। আর নান্টুদার পরিবারের বিশেষত্ব ছিল ‘বহু ডেগ, এক মন’। কালের দাবি মেটাতে এক পর্যায়ে ভাইবোনকে পৃথক থাকার ব্যবস্থা করে দিলেও ভাইবোনরা তাঁকেই পরিবারের প্রধান মনে করতেন। তিনিও অনুরূপ অভিভাবকত্ব প্রদান করেছিলেন।

নান্টুদা ক্রিকেট অত্যন্ত ভালোবাসতেন। তাঁর সাথে যোগাযোগ ও ঘনিষ্ঠতার আরেক বিশেষ ক্ষেত্র ছিল এটি। ক্রিকেট বুঝতেন ও ভালোবাসতেন মনঃপ্রাণ দিয়ে। এখনও মনে আছে ১৯৮৭ বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সময়ের কথা। কত আলোচনা, কত বিশ্লেষণ প্রত্যেকটা ম্যাচ নিয়ে। ৮ নভেম্বর ১৯৮৭ ইডেনে ফাইনাল খেলা দেখতে আমি ও আমার প্রিয়ভাজন ছাত্র তুষান টিকিট ও হোটেলের ব্যবস্থা করেছিলাম। আশা ছিল ভারত-পাকিস্তান ফাইনাল খেলা দেখার। প্রথম সেমিফাইনালে লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে অস্ট্রেলিয়া পাকিস্তানকে এবং দ্বিতীয় সেমিফাইনালে বোম্বের (মুম্বাই) ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে ইংল্যান্ড ভারতকে হারিয়ে দিলে কলকাতার হোটেল ব্যবসা থেকে শুরু করে টিকিটের কালোবাজার সবকিছুই মার খায়। ঢাকা থেকে খেলা দেখতে কয়েকজন ক্রীড়ামোদীর দমদম বিমানবন্দর পর্যন্ত প্লেন চার্টার করা ছিল। সেটিও বাতিল হয়। আমরাও যাইনি। ৮ নভেম্বর ফাইনাল খেলা টিভিতে দেখেছিলাম। বিদ্যুতের রসিকতার জন্য দ্বিতীয় ইনিংসের ৮/১০ ওভার দেখা হয়নি। ওই দিন বেলুড় মঠের ভাইস প্রেসিডেন্ট স্বামী ভূতেশানন্দজী মহারাজ সিলেট আসেন। অনেকে তাই ব্যস্ত ছিলেন। রাতে খবর ও হাইলাইটস দেখে চলল। পরের দিন নান্টুদার কাছে সেই ৮/১০ ওভার পুষিয়ে নিলাম। তিনি ডেভিড বুন ও অ্যালান বোর্ডারের ব্যাটিং ও বোর্ডারের নিয়ন্ত্রিত স্পিন বোলিং এর ভক্ত ছিলেন, ভক্ত ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার। ফাইনালে বুন ও বোর্ডার তাঁর ইজ্জতের খেয়াল করেছিলেন। আমাকে বললেন, “দেখলেন তো ভারত পাকিস্তান পারলো না, আমি আগেই জানতাম। অস্ট্রেলিয়া একটি ভালো দল (ঢেকুরের সাথে)”। আমি বললাম, “তা ঠিক, তবে এই ম্যাচে ভারত পাকিস্তানও খেলেছে। দুই আম্পায়ার রামবাবু গুপ্তা ও মেহবুব শাহ ছিলেন যথাক্রমে ভারত ও পাকিস্তানের।” চমৎকৃত হলেন কিন্তু ক্রিকেটের অনেক বিষয় জেনেও এই তথ্য না জানার মধ্যে চেহারায় সূক্ষ্ম একটি আফসোসের ইঙ্গিত ছিল। এতোই ছিল তাঁর জানার আগ্রহ, এতোই স্পিরিটেড ছিলেন তিনি।

নৈতিকতার অধিকারী ছিলেন। নীতি-নৈতিকতার বিষয় তাঁকে প্রভাবিত করত। ১৯৮৭ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ওয়েস্ট ইন্ডিজ গ্রুপ পর্বেই বিদায় নেয়। কোর্টনি ওয়ালশের বদান্যতায় সেলিম জাফর বেঁচে যাওয়ায় তাদের এ দুর্গতি হয়। কোর্টনি ওয়ালশের প্রশংসায় তিনি পঞ্চমুখ ছিলেন। ঘটনাটি ছিল পাকিস্তান-ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচে টেইলএন্ডার সেলিম জাফর নন-স্ট্রাইকিং এন্ডে ক্রিজের অনেক বাইরে ছিলেন। বোলার কোর্টনি ওয়ালশ ইচ্ছে করলে তাঁকে আউট করতে পারতেন। ইতিহাসও হয়ত ভিন্ন হয়ে যেত।

নান্টুদা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের ফার্স্টক্লাস কনট্রাক্টর ছিলেন সেই পাকিস্তান আমল থেকে। কনট্রাক্টর হিসেবে অত্যন্ত সৎ ছিলেন, সৎ ছিলেন ব্যবসায়ী হিসেবেও । ছিলেন প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক ভাবনার অধিকারী । তাঁর সর্বজনগ্রাহ্যতা তা প্রমাণ করে। অনেক গরীব পিতাকে কন্যাদায় থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করেছেন, সাউথইস্ট ব্যাংকের ডাইরেক্টর হিসেবে অনেককে চাকুরী দিয়েছেন। সমাজের বিভিন্ন প্লাটফর্ম এ তাঁর ছিল সরব অংশগ্রহণ ও উপস্থিতি। রসবোধ ছিল প্রখর। জীবনযাত্রায় একটা শৃঙ্খলা ছিল। পান খেতেন কিন্তু পান করতেন না। দেখিনি, শুনিওনি।

বিজ্ঞাপন

যোগাযোগের প্রোফাইল ছিল সেইরকম, মন্ত্রী থেকে দপ্তরী পর্যন্ত এককালের স্থানীয় হিন্দুসমাজে যার অধিকারী ছিলেন বিমলেন্দু দাস সাধুবাবু। দুই বিমলেন্দু বাবু দুই যুগে সমাজহিতৈষী ছিলেন। দুজনেই প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্ব ছিলেন।

প্রবাদ আছে, ‘রাজা জন্মিতে রানী’। তাঁর সফলতার পেছনে তাঁর সহধর্মিণী আমাদের বৌদির মতো একজন গুণী মহিলার অবদান অনেক। একান্নবর্তী পরিবারে মায়ের ভূমিকায় ছিলেন। হাল ধরেছিলেন মায়া মমতায় ও বাস্তবতায়।

বিমলেন্দু দে নান্টুদার শূন্যস্থান পূরণ হবার নয়। বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।

লেখক: মিহিরকান্তি চৌধুরী: লেখক, গবেষক ও অনুবাদক এবং ডেপুটি রেজিস্ট্রার, মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি, সিলেট ।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.