Sylhet Today 24 PRINT

কোভিড-১৯ হার্ড ইমিউনিটি বাস্তবতা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ও বাংলাদেশ

ড. মোহম্মদ মাহবুব চৌধুরী |  ১৬ মে, ২০২০

করোনাকালিন এই ভয়ংকর সময়ে একটা কথা প্রায়ই উচ্চারিত হচ্ছে- ‘হার্ড ইমিউনিটি’ ( Herd Immunity)। হার্ড (Herd) মানে ‘পাল’ তাই ‘হার্ড ইমিউনিটি’ বলতে মূলত কোন নির্দিষ্ট রোগের বিরুদ্ধে একটি এলাকা বা দেশের জনগণের সামগ্রিক ‘গণ-রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা’-কে বুঝায়। এই ‘হার্ড ইমিউনিটি’ বিষয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ কোন ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া জনিত রোগকে সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করার এটাই একমাত্র উপায়।এভাবেই বিশ্ব হতে গুটি বসন্ত নির্মূল হয়েছে এবং দুনিয়া থেকে যক্ষ্মা এবং পোলিওর মত রোগও এখন নির্মূলের পথে! কোভিড-১৯ মহামারির ক্ষেত্রেও ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জন চরম আকাঙ্ক্ষিত!

বিজ্ঞাপন

হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের মূলনীতি ও প্রক্রিয়া:
সহজ ভাষায় ‘হার্ড ইমিউনিটি’ বলতে এটা বোঝায় যে কোন জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ লোক (৬০-৯০%) যদি কোনভাবে কোন নির্দিষ্ট ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী হয়ে উঠে তখন অবশিষ্ট জনগোষ্ঠীও ‘পরোক্ষভাবে’ ঐ ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হওয়া থেকে রক্ষা পায়। তা কি প্রক্রিয়ায় এটা সম্ভব হয়?

কোন ভাইরাস যখন সম্পূর্ণ নতুন কোন জনগোষ্ঠীকে আক্রান্ত করে তখন পুরো জনগোষ্ঠীর যে কেউ আক্রান্ত হতে পারে।তাই প্রথম রোগ সংক্রমণের কিছুটা পরেই একজন হতে আরেকজনে সংক্রমণের মাধ্যমে দ্রুত গতিতে (Exponential rate)আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা হু হু করে বাড়তে থাকে। এখন আক্রান্তের সংখ্যা হু হু করে বাড়ার সাথে সাথে আস্তে আস্তে (সামান্য করে হলেও) রোগ সংক্রমণের হার কমতে শুরু করে। এর কারণ হল সময়ের সাথে আক্রান্ত রোগীর একটা অংশও তো সুস্থ হয়ে উঠে এবং তারা আর নতুন করে রোগ বিস্তার করতে পারেনা-ফলে জনগোষ্ঠীর মাঝে তাদের অবস্থান অনেকটা রোগ সংক্রমণ ‘প্রতিরোধকারী ঢাল’ বা ‘হিউম্যান শিল্ড’ ( Human-Shield) হিসেবে কার্যকর হতে থাকে।এভাবে একটা নির্দিষ্ট সময়ে পুরো জনগোষ্ঠীতে এই ‘রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন’ ব্যক্তির সংখ্যা এমনভাবে বেড়ে যায় যে রোগ সংক্রমণ বৃদ্ধির হার এক পর্যায়ে শূন্য হয়ে পড়ে (Maximum in the Curve) এবং এরপর পরই এমন একটা পর্যায় আসে যখন এই ‘প্রতিরোধী’ জনগণের সংখ্যা বেড়ে গিয়ে পুরো জনগোষ্ঠীতে তাদের অনুপাত বা শতাংশ এমন হয় যে রোগ সংক্রমণের হার উল্লেখযোগ্য হারে কমতে শুরু করে এবং সেই সাথে নতুন করে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও কমতে থাকে। ঠিক এই পর্যায়েই আমরা বলি পুরো জনগোষ্ঠীই ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জনের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এভাবে আরও কিছু সময় যেতে দিলে রোগ সংক্রমণের হার এতই নগণ্য হয় যে পুরা জনগোষ্ঠীই কার্যত ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জন করে।

এখন একটি জনসংখ্যার ঠিক ‘শতকরা’ কত অংশকে ‘ঢাল’ হিসেবে বা ‘রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন’ করে গড়ে তুললে পুরো জনগোষ্ঠীরই এই ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জিত হবে তা নির্ভর করবে মূলত রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাস এর অনন্য বৈশিষ্ট্যের উপর- আরও পরিষ্কারভাবে বললে ঐ নির্দিষ্ট ভাইরাসটির প্রাথমিক রোগ সংক্রমণের হার বা Ro মানের উপর।কোন ভাইরাসের Ro = ২ এর অর্থ হল ১ জন আক্রান্ত ব্যক্তি নতুন করে ২ জনকে আক্রান্ত করতে পারে এবং ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জনের জন্য অন্ততপক্ষে ৫০% জনগোষ্ঠীকে ঐ রোগের বিরুদ্ধে ‘রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা’ অর্জন করতে হয়। একইভাবে ভাইরাসের Ro =৩ হলে ৬৭% এবং Ro =৪ হলে ৭৫% জনগোষ্ঠীকে ‘রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন’ করে গড়ে তুলতে হবে যাতে পুরো জনগোষ্ঠীরই ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জিত হয়।

এখন কীভাবে কোন জনগোষ্ঠীর একটি নির্দিষ্ট অংশকে ‘রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন’ করে গড়ে তুলে কাঙ্ক্ষিত ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জন সম্ভব হয়?

দুটি উপায়ে সম্ভব:
১)ভ্যাকসিন: এই পদ্ধতিতে সরাসরি একটি কার্যকর ভ্যাক্সিন প্রয়োগের মাধ্যমে জনসংখ্যার ঐ নির্দিষ্ট অংশ বা শতাংশকে ‘রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন’ করে গড়ে তোলা হয় ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জনের জন্য।

এই প্রক্রিয়াটি নিরাপদ কারণ কোন রোগীকে মৃত্যুর ঝুঁকিতে পড়তে হয়না। কিন্তু এজন্য একটা কার্যকর ‘ভ্যাক্সিন’ হাতে থাকতে হয়।

২)প্রাকৃতিকভাবে রোগ সংক্রমণ এবং সুস্থতা অর্জন: এই পদ্ধতিতে কাঙ্ক্ষিত ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জনের জন্য প্রাকৃতিকভাবে বা ইচ্ছাকৃতভাবেই জনগোষ্ঠির একটি নির্দিষ্ট অংশ বা শতাংশকে আক্রান্ত করে তাদেরকে আবার সুস্থ করার মাধ্যমে ‘রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন’ জনগোষ্ঠী তৈরি করা হয়।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু প্রাকৃতিক উপায়ে ‘হার্ড ইমিউনিটি’অর্জনের প্রচেষ্টা অত্যন্ত বিপদজনক! কারণ ভাইরাসটি যদি অতি শক্তিশালী হয়, এর সংক্রমণ হার যদি অতি উচ্চ হয় এবং সেই সাথে জনগণের ইমিউন সিস্টেম যদি দুর্বল থাকে তবে ৬০-৭০% জনগণের ইমিউনিটি অর্জনের পথে এক বিরাট সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে হয়! তাই বৈজ্ঞানিক ভাবে এর একটা ভিত্তি থাকলেও মানবিক দিক দিয়ে বিচার করলে এটা একটা ভয়ংকর পদ্ধতি! এছাড়া অতিরিক্ত রোগীর ‘বিশেষায়িত’ চিকিৎসা দিতে গিয়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়।

কোভিড-১৯ হার্ড ইমিউনিটি-সম্ভাবনা:
কোভিড-১৯ মহামারির এর ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত ডাটা হতে দেখা গিয়েছে যে সবধরনের সাবধানতামূলক পদক্ষেপ নেয়ার পরও ভাইরাসটির প্রাথমিক রোগ সংক্রমণের হার, Ro, এর মান ২.২ -৩.৪ এর মত। এছাড়া কোন জনগোষ্ঠীতে সংক্রমণ কারী ভাইরাসটির নির্দিষ্ট স্ট্রেইন (ধরন), শক্তিমাত্রা, জলবায়ুগত কারণে এই Ro এর মান কম বেশি হতে পারে। আবার সাবধানতামূলক পদক্ষেপ বা কর্মসূচিগুলো কোন কারণে কমিয়ে ফেললে বা বাদ দিলে এই Ro এর মান আরও বেড়ে যেতে পারে। তারপরও কোভিড-১৯ করোনা ভাইরাসের Ro এর মান যদি গড়ে ৩ ধরি তবে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জনের জন্য বিশ্বের ৭ বিলিয়ন লোকের প্রায় ৬৭% লোককে ‘রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন’ করে গড়ে তুলতে হবে!

কোভিড-১৯ এর এখন পর্যন্ত কোন কার্যকরী ভ্যাক্সিন আবিষ্কৃত হয়নি এবং আগামী ১২-১৮ মাসের মধ্যে হাতে আসার সম্ভাবনা না থাকায় ভ্যাক্সিন-ভিত্তিক ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জন এই মুহূর্তে সম্ভব নয়।

অন্যদিকে, প্রাকৃতিকভাবে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জনের প্রচেষ্টা অত্যন্ত বিপদজনক-কারণ রোগটি প্রাণঘাতী, অত্যন্ত ছোঁয়াচে এবং দ্রুত সংক্রমণকারী। গত পাঁচ মাসে নানা মাত্রার লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব ও অন্যান্য সাবধানতামূলক ব্যবস্থা নেয়া সত্ত্বেও এপর্যন্ত ৪৬ লাখের মত লোক আক্রান্ত হয়েছে এবং ৩ লাখের ও বেশি লোকের মৃত্যু হয়েছে যেখানে মৃত্যুর হার প্রায় ৬.৭%। যদিও এই মৃত্যুহার মূলত যারা টেস্ট করে ‘পজিটিভ’ হয়েছে তার ভিত্তিতে। এর বাইরেও প্রচুর মানুষের আক্রান্ত হয়েছে কিন্তু টেস্ট হয়নি, আবার প্রচুর মানুষের মৃত্যুও হয়েছে করোনার উপসর্গ নিয়ে যাদের সংখ্যা গণনায় আসেনি! যাই হোক এই উচ্চ-মৃত্যুর হার নির্দেশ করছে বিশ্বের ৭ বিলিয়ন মানুষকে প্রাকৃতিকভাবে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জন করতে গিয়ে কত কোটি মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে হবে! তার উপর ভাইরাসটির কোন বাছ-বিচার নেই এবং ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হলে যে কেউ মারা যেতে পারে। এ এক ভয়াবহ পরিস্থিতি! এছাড়া ২০% কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর ‘বিশেষায়িত’ চিকিৎসা প্রদান করতে গিয়ে বিদ্যমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও ভেঙে পড়ার উপক্রম হবে। তাই প্রাকৃতিকভাবে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জনের প্রচেষ্টা মোটেও ‘বাস্তবসম্মত’ নয়!

কোভিড-১৯ হার্ড ইমিউনিটি- বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট:
এই মুহূর্তে কোভিড-১৯ এর একটি ‘কার্যকর’ ভ্যাক্সিনের অভাবে ‘প্রাকৃতিকভাবে’ হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করার চাইতে বিশ্বের দেশগুলো মূলত চেষ্টা করেছে একটা নির্দিষ্ট সময় জুড়ে লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সহ অন্যান্য সাবধানতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে ‘রোগ সংক্রমণের হার’ কমিয়ে রাখতে যাতে একটি কার্যকর ‘ভ্যাক্সিন’ না আসার আগ পর্যন্ত ব্যাপক ‘প্রাণহানি’ না ঘটে বা ‘ক্রিটিক্যাল রোগী’দের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা যায়। মহামারির একেবারে শুরুতে উন্নত বিশ্বের কোন কোন দেশ ঢিলেমি করলেও রোগের তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথে কমবেশি সব দেশই এই সাবধানতামূলক পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করেছে।

এখন দেখি-প্রাকৃতিক উপায়ে কোন দেশ ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জনের প্রচেষ্টা নিয়েছে কি?
বিশ্বের কয়েকটি দেশ অফিসিয়ালি স্বীকার না করলেও তাদের গৃহীত কিছু কর্মসূচিতে ‘প্রাকৃতিকভাবে’ ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জনের একধরনের প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বোরিস জনসন মার্চের মাঝামাঝি ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্স বা স্পেনের মত বড় আকারের লোক সমাগম বা স্কুল/কলেজ বন্ধ না করার নীতি ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা হঠাৎ করে হু হু করে বেড়ে উঠলে জনগণকে ‘বাড়িতে-থাকা’র নির্দেশ দিতে তিনি বাধ্য হন। বোরিস নিজেও কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে আবার সুস্থ হয়ে উঠেছেন। উল্লেখ্য, যুক্তরাজ্যে আজ পর্যন্ত কোভিড-১৯ এ প্রায় ২ লক্ষ ৪০ হাজার লোক আক্রান্ত হয়েছে এবং ৩৪ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

ইউরোপের মধ্যে সুইডেন এখন পর্যন্ত লকডাউনের কোন নীতিই গ্রহণ করেনি- স্কুল-কলেজ, রেস্টুরেন্ট, খেলার মাঠ সব কিছুই তারা খোলা রেখেছ। সুইডেন এর পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেছেন যে তারা ‘হার্ড ইমিউনিটি থিওরি’ ফলো করছেন না কিন্তু জনগণের উপর ভরসা রাখছেন যে তারা নিজেদের সচেতনতার মাধ্যমেই রোগ বিস্তার রোধ করবে! অন্যদিকে সুইডেনের প্রধান মহামারি বিশেষজ্ঞ বলেছেন আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ‘স্টকহোম’ এ ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জিত হবে! কিন্তু এই ধরনের কর্মসূচি গ্রহণের ফলে সুইডেনে ইতিমধ্যেই ৩০ হাজার লোক আক্রান্ত হয়েছে এবং সাড়ে ৩ হাজারের বেশি রোগী মৃত্যুবরণ করেছে। সুইডেনে মৃতের সংখ্যা প্রতিবেশী দেশ ফিনল্যান্ড (মৃত ২৯৭) বা নরওয়ের ( মৃত- ২৩২) চেয়ে অনেক বেশি।

অন্যদিকে ব্রাজিলও বলছে তারা সবধরনের লকডাউনের বিরুদ্ধে। তারা সব কিছু খুলে দিয়েছে-রেস্টুরেন্ট, পাব, শপিং মল সব কিছু! তার ফলাফলও তারা হাতেনাতে টের পাচ্ছে! এখন পর্যন্ত ২ লক্ষেরও বেশি লোক আক্রান্ত হয়েছে এবং ১৪ হাজারেরও বেশি লোকের মৃত্যু হয়েছে!

কোভিড-১৯ হার্ড ইমিউনিটি- বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট:
বাংলাদেশেও মার্চ এর শেষ সপ্তাহ হতে স্কুল-কলেজ বন্ধ, দরকারি অফিস-আদালত সীমিত আকারে খোলা রেখে একধরনের ‘লকডাউন’পরিস্থিতি চালু করা হয়েছে। কিন্তু সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অভাবে পর্যাপ্ত সময় হাতে পাবার পরও আমরা নিজেদেরকে খুব একটা প্রস্তুত করে তুলতে পারিনি। আমাদের জনসংখ্যার আধিক্য, ঘনত্ব ও দুর্বল স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিবেচনায় সবচেয়ে কার্যকরী ব্যবস্থা হতে পারতো আন্তর্জাতিক ফ্লাইট সীমিতকরণ, বিদেশ ফেরত যাত্রীদের যথাযথ স্ক্রীনিং এবং কোয়ারেন্টিন এর বন্দোবস্ত করে জনগোষ্ঠীতে রোগ সংক্রমণের সম্ভাবনাকে কমিয়ে ফেলা।কিন্তু জানুয়ারি হতে মার্চ পর্যন্ত আগত ছয় লক্ষ প্রবাসীকে বিমানবন্দরে কোন কার্যকরী স্ক্রিনিং করতে পারিনি, তাদেরকে সাবধানতামূলক ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে রাখতে পারিনি বা তাদের সংস্পর্শে যারা এসেছে তাদেরকে ট্রেইস করে আইসোলেট করতে পারিনি। যার ফলে ঐ বিদেশ ফেরত যাত্রীদের দ্বারাই আমাদের এখানে কোভিড-১৯ রোগটি কম্যুনিটিতে ছড়িয়ে পড়েছে। এছাড়া ঐসময়ে নিজেদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ঘাটতিগুলো চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও গ্রহণ করিনি যার ফলে করোনার প্রাথমিক ধাক্কাতেই আমরা খেয়াল করেছি কতটা ভঙুর আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা! অসংখ্য মানুষ করোনা ‘টেস্ট’ করাতে পারছেনা, আবার সংকটাপন্ন রোগী ‘বিশেষায়িত’ চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে গিয়েও ভর্তি হতে পারছেনা! আমাদের এখানে ভাইরাসটি এখনো তার পূর্ণ শক্তিমাত্রা নিয়ে আবির্ভূত হয়নি- ধন্যবাদ ভাইরাসটির দুর্বলতর স্ট্রেইন আর আমাদের জনগোষ্ঠীর সাধারণ জেনেটিক বৈশিষ্ট্যকে! কিন্তু এর মধ্যেই আমাদের এখানে সরকারি হিসেবে ২০ হাজার এরও বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে এবং ৩১৪ এর মত মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে । এই মৃত্যুর হার দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ- প্রায় ১৫% এর মত! যাই হোক টেস্টের অভাবে বেসরকারিভাবে আক্রান্ত এবং করোনা উপসর্গে মৃতের সংখ্যা সরকারি হিসেবের চাইতে আরও বেশি! এই মুহূর্তে প্রতিদিনই আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এবং মৃতের সংখ্যা বাড়ছেই!

এখন দেখি প্রাকৃতিকভাবে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জন করতে হলে আমাদের জনগোষ্ঠীর কতজন লোককে ‘আক্রান্ত’ হতে দিয়ে ‘রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন করে তৈরি করে তুলতে হবে? কোভিড-১৯ করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে ‘প্রাকৃতিকভাবে’ হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের জন্য প্রায় ৬৭% অর্থাৎ বাংলাদেশের ১৮ কোটি জনসংখ্যার ১২ কোটি লোককে আক্রান্ত হতে দিয়ে ‘রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন’ করে গড়ে তুলতে হবে। এখন আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর হার ১০% হলে মৃতের সংখ্যা হবে ১ কোটি ২০ লাখ, যদি ১০ ভাগ কমিয়ে ১% ও ধরি তবে মৃতের সংখ্যা হবে ১২ লাখ, আরও কমিয়ে মৃতের হার ১০০ ভাগ কমিয়ে ০.১% ও যদি ধরি তাহলে ও মৃতের সংখ্যা হবে ১ লাখ ২০ হাজার! কী ভয়াবহ অবস্থা!! আমরা কি চাইবো এত বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে জেনে-বুঝে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে, শুধুমাত্র ‘প্রাকৃতিকভাবে’ হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের জন্য? এটা মোটেও ‘বাস্তবসম্মত’ নয় এবং মানুষ হিসেবে আমরা তা চাইতেও পারিনা! পিরিয়ড।

কোভিড-১৯ হার্ড ইমিউনিটির বাস্তবতা ও লকডাউন শিথিলতার রূপরেখা: বিশ্ব ও বাংলাদেশ
কোভিড-১৯ এ ব্যাপক প্রাণহানির সম্ভাবনা বিবেচনায় প্রাকৃতিকভাবে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জনের জন্য সমস্ত লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব এ সাবধানতামূলক ব্যবস্থাগুলো একেবারেই তুলে দেয়া যেমন বাস্তবসম্মত নয় তেমনি অর্থনৈতিক বিবেচনায় দীর্ঘ সময় লকডাউনে থাকাও সম্ভব নয়। আমাদের এর মাঝামাঝি একটা কার্যকর পন্থা বের করতে হবে। কী করা যেতে পারে?

লকডাউন যদি খুলতেই হয় তবে অন্ততপক্ষে একটা স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যান বের করতে হবে। উন্নত দেশগুলো অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা করে আস্তে আস্তে তাদের দেশের বাস্তবতায় ধাপে ধাপে লকডাউন শিথিল করার পরিকল্পনা করছে কতগুলো বিষয়কে বিবেচনায় নিয়ে:

বিজ্ঞাপন

• বয়স্করা অতিমাত্রায় ঝুঁকিগ্রস্ত বলে তাদের কে পুরোপুরি বাসায় রেখে অপেক্ষাকৃত তরুণদের বা সুস্থ হয়ে উঠা রোগীদের সর্বোচ্চভাবে কাজে লাগানো।
• অতি জরুরি সেবার কর্মীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজে ফেরানো।
• সীমিত মাত্রার জনসমাগমের অনুমতি দেয়া।
• কর্মক্ষেত্রে, রেস্টুরেন্টে, অন্যান্য ব্যবসায়, ধর্মীয় উপাসনালয় বা অন্যান্য জনসমাগমে নিরাপদ শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার বিধান।
• পরিস্থিতি বিবেচনাপূর্বক ধাপে ধাপে আন্তর্জাতিক ট্রাভেল সহ অন্যান্য বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক কর্ম-কাণ্ডের নিষেধাজ্ঞা শিথিলকরণ।

উপরোক্ত বিষয়গুলোর আলোকে আমাদেরকেও আমাদের দেশের বাস্তবতায় ধাপে ধাপে লকডাউন তুলে নেবার একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করতে হবে।

এটা উল্লেখ করলে ভুল হবেনা যে, নানা সীমাবদ্ধতা আর অব্যবস্থাপনা থাকা সত্ত্বেও সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশে গত দেড় মাসের লকডাউনে কিছুটা সাফল্য এসেছে- রোগে মৃতের সংখ্যা এখনো অনেক দেশের তুলনায় যথেষ্ট কম। কিন্তু এই সাফল্যকে অক্ষুণ্ণ রেখে একটা নিরাপদ পর্যায় বা স্থিতাবস্থায় পৌঁছানোর জন্য আমাদের এই লকডাউন প্রক্রিয়াটা যখন আরও কয়েক সপ্তাহ চালিয়ে যাবার দরকার ছিল তখনই ঘোষণা এসেছে গার্মেন্টস শ্রমিকদের কাজে ফিরে যাবার, সরকারি-বেসরকারি কর্মচারীদের কর্মক্ষেত্রে কাজের ডিউটি বাড়ানো সহ, হাট-বাজার, ঈদ শপিং এর জন্য মলগুলো খুলে দেবার। এর ফলাফল কী হতে পারে তা আমরা এই মাসের শেষ নাগাদ ভালোভাবেই বুঝতে পারবো। আরও কয়েকটা সপ্তাহ দেখা যেতে পারতো আমাদের কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যার ট্রেন্ড টা কী দাড়ায় এবং এই সময়ের মাঝে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সামান্য হলেও তো কিছুটা ঘাটতি পূরণের ব্যবস্থা করা যায় কিনা। এখানে উল্লেখ্য যে দেশের মধ্য বা উচ্চবিত্তের অনেক মানুষই সাবধানতার জন্য এই রোজার মাস বা অন্ততপক্ষে এই মাসের শেষ পর্যন্ত লকডাউনটি চালিয়ে যাবার জন্য মানসিকভাবে কিছুটা প্রস্তুতও ছিল। প্রশ্ন আসতে পারে দেশের ৩০-৩২% অতি দরিদ্র, দরিদ্র ও নিম্নআয়ের মানুষদের (৫.৫-৬.০ কোটি) তো বের হতেই হবে জীবিকার জন্য! কিন্তু সেক্ষেত্রেও সাময়িক একটা জরুরি বন্দোবস্তেরও সুযোগ ছিল বা আছে!আমাদের বার্ষিক উন্নয়ন বাজেটের একটা বড় অংশ তো এখনো অব্যবহৃত অবস্থায় আছে ( প্রায় ১ লক্ষ কোটি টাকার মত) সেখান হতে জরুরি ভিত্তিতে ৩০-৪০ হাজার কোটি টাকা ব্যবহার করে এই মানুষগুলোকে এককালীন কিছু নগদ টাকা বা ফ্রি-রেশনের ব্যবস্থা করলেও তাদেরকে তো আর কয়েক সপ্তাহ বা মাসের জন্য জীবিকার সন্ধানে বের হতে হতোনা। পশ্চিম বংগ বা পাকিস্তান কিন্তু এধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে তাদের নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য, অনেক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও। সরকার বিষয়টি ভেবে দেখতে পারে। এছাড়া, শপিং মল বা আবদ্ধ জায়গার পরিবর্তে খোলা জায়গায় হাট-বাজারের ব্যবস্থা করা যেতে পারে এখনো। কোন কোন ব্যবসায়ী ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে জনস্বাস্থ্যের বিবেচনায় ঈদের জন্য তারা তাদের শপিং মল বন্ধ রাখবেন।তাদের এ দায়িত্বশীল উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন-আমাদের গবেষকরা বাংলাদেশে প্রাপ্ত করোনা ভাইরাসের জিনম সিকোয়েন্স বের করতে সমর্থ হয়েছে যা আমাদের কে এই ভাইরাসের মিউটেশন ট্রেন্ড মনিটর করতে, এর শক্তিমাত্রা বুঝতে বা এর বিরুদ্ধে কার্যকরী ভ্যাকসিন বা ড্রাগ নির্বাচনে যথেষ্ট সাহায্য করবে। আরেকটি বিষয়- গণস্বাস্থ্যের উদ্ভাবিত প্লাজমাভিত্তিক র‍্যাপিড টেস্টিং কিটটির কার্যকারিতা পিসির টেস্ট এর সাথে ক্রস-চেক করে ভেরিফাই করা যায় কিনা।এটা আমাদের দেশে তৈরি, সস্তা এবং ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা সম্ভব। যদিও সরাসরি ভাইরাসের পরিবর্তে রোগ প্রতিরোধী এন্টিবডির উপস্থিতি সনাক্ত করার মাধ্যমে এই কিটটি কাজ করবে তাই অনেক ফলস পজিটিভ ও নেগেটিভ রেজাল্ট আসবে। তাই রোগ নিশ্চিত করার জন্য গণস্বাস্থ্যের কিটটি খুব বেশি নির্ভরযোগ্য না হলেও অন্ততপক্ষে প্রাথমিক স্ক্রীনিং এর জন্য এটা ব্যবহার করে পিসিআর দিয়ে রোগটিকে পরে কনফার্ম করা যেতে পারে। তবে এটার সবচেয়ে কার্যকরী ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার হতে পারে জনগোষ্ঠীর ঠিক কত অংশ ‘ইমিউনিটি’ অর্জন করেছে তা জানার জন্য। আমাদের নীতিনির্ধারকরা বর্তমান বাস্তবতায় দেশের মানুষের সার্বিক কল্যাণে উপরোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনা বা পুনর্বিবেচনা করতে পারেন।

বিজ্ঞাপন

শেষ কথা হল, ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জন কোভিড-১৯ রোগকে নির্মূল করার একমাত্র কার্যকরী উপায় এবং তা অর্জনের সবচেয়ে নিরাপদ পদ্ধতি হল বেশিরভাগ জনগোষ্ঠীকে ভ্যাক্সিন এর আওতায় নিয়ে এসে ‘রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন’ করে তৈরি করা। কিন্তু এই করোনা ভাইরাসের একটি কার্যকর ভ্যাক্সিন হাতে আসতে ন্যূনতম আরও এক বছরের মত সময় লাগতে পারে এবং সমগ্র পৃথিবীর মানুষকে ভ্যাক্সিনের আওতায় নিয়ে আসতে আরও বেশ কয়েক বছর লেগে যেতে পারে। ভ্যাক্সিনের অনুপস্থিতিতে ‘প্রাকৃতিকভাবে’ হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের প্রচেষ্টা কোনভাবেই ‘বাস্তবসম্মত’ নয় কারণ রোগটি প্রাণঘাতী, ভয়ংকর ছোঁয়াচে, দ্রুত সংক্রমণকারী! কোটি কোটি মানুষকে এভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়াতো কোন মানবিকতা নয়!!অন্যদিকে বৈশ্বিক অর্থনীতির চাকা চালু রাখতে হলে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা প্রণয়ন করে, সতর্কতামূলক ব্যবস্থা বজায় রেখেই ধাপে ধাপে লকডাউন তুলে নেয়া বা শিথিল করা ছাড়া আমাদের হাতে আর কোন বিকল্পও নেই। সমন্বিত বৈশ্বিক প্রক্রিয়ায় আগামী এক বছরের মধ্যেই আমরা কোভিড-১৯ রোগ প্রতিরোধের একটি কার্যকর ‘ভ্যাক্সিন’ বা রোগের চিকিৎসার জন্য একটি কার্যকর ‘ড্রাগ’ হাতে পাবো- মনে-প্রাণে এই কামনা করছি। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই ভয়াবহ মহামারিকে আমরা অচিরেই জয় করবো-পৃথিবীও তার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে আবার-এই প্রত্যাশায়!

 

ড. মোহম্মদ মাহবুব চৌধুরী: ২০১৩-১৪ সালে কানাডার অটোয়াস্থ কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে পিএইচডি সম্পন্ন করে বর্তমানে একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি (NXP Semiconductor Inc.)-তে External Quality Engineer হিসেবে কর্মরত। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ হতে বিএসসি (সম্মান) এবং এমএসসি সম্পন্ন করে ২০০৬ সালে উচ্চশিক্ষার্থে কানাডায় যাওয়ার আগে তিন বছর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে শিক্ষকতা করেন।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.