Sylhet Today 24 PRINT

\'সর্বত মঙ্গল রাধে\' গান নিয়ে বিতর্ক : কপিরাইট আইন নিয়েও ভাবা দরকার

নওরোজ ইমতিয়াজ |  ২৫ অক্টোবর, ২০২০

সর্বত মঙ্গল রাধে বিনোদিনী রাই' গানটা আমার বিশেষ প্রিয়। গত কয়েক বছর ধরে নানা ধরনের ভার্সন মিলিয়ে এই গান কয়েকশবার শুনে ফেলেছি। এখনও শুনি।

ছোট থাকতে গানটার প্রথম যে ভার্সন শুনি, সেটা রেডিওতে, অতি জঘন্য সাউন্ড কোয়ালিটি। অবাক হয়ে ভাবতাম, শরবতের সঙ্গে মঙ্গলের কী সম্পর্ক! শরবত পান করে বিনোদিনী রাধার কী ধরনের মঙ্গল সাধিত হয়েছে!

পরে বুঝলাম, ‘শরবত’ না, ‘সর্বত’।

সম্প্রতি 'আইপিডিসি আমাদের গান' নামক উদ্যোগে বাংলাদেশের জনপ্রিয় দুজন তারকা মেহের আফরোজ শাওন ও চঞ্চল চৌধুরী গানটা নতুন করে গেয়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় সার্বিকভাবে ব্যাপক নন্দিত হচ্ছে। কপিরাইট জটিলতায় সেই গানের উদ্যোক্তারা দুইদিনের মধ্যে গানটা ইউটিউব ও ফেসবুক থেকে নামিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু তার আগেই গানের ভিডিওটা সহস্র-নিযুত সংখ্যক ডাউনলোড হয়ে গিয়েছে। এখন যে যার মতো নিজের প্রোফাইল থেকে সেই গানের ঈষৎ ঝাপসা কোয়ালিটি ভিডিও আপলোড করে মুগ্ধতা প্রকাশ অব্যাহত রেখেছেন।

নতুন ভার্সনটি আমার দারুণ লেগেছে। এটিও শতাধিকবার শুনে ফেলেছি। যদিও গানের সঙ্গীতায়োজন কিছুটা দুর্বল মনে হয়েছে। কোরাসের দুই শিল্পী দারুণ গেয়েছেন, কিন্তু সামগ্রিকভাবে মিউজিকের সঙ্গে কেন জানি সিংক করেনি। সেটা মিক্সিংয়ের সমস্যা। আজকাল লোকজন কোক স্টুডিও, গান বাংলা, জি-বাংলায় দারুণ সব অডিও-ভিডিও প্রডাকশন দেখে অভ্যস্ত। সেইসব কোয়ালিটির সঙ্গে তুলনা কর গেলে, নতুন ভার্সনের ‘সর্বত মঙ্গল রাধে’ গানের সাউন্ড মিক্সিং, কম্পোজিশন বা ইনস্ট্রুমেন্ট প্লেসিং আরও ভালো হতে পারত। মেহের আফরোজ শাওন এমনিতে চমৎকার গান করেন। কিন্তু এই গানে তার ভয়েসের টোনাল কোয়ালিটি কিছুটা ডাউন লেগেছে। চঞ্চল চৌধুরী তার স্বভাবসুলভ খোলা গলায় দারুণ গেয়েছেন।

আমার কাছে অপূর্ব লেগেছে মেহের আফরোজ শাওনের এক্সপ্রেশন। তিনি সত্যিই উঁচু দরের অভিনেত্রী। এই গানের সীমিত স্পেসেও তিনি যে এক্সপ্রেশন দিয়েছেন, সেটাই এই গান সুপারহিট হওয়ার প্রধান কারণ। চঞ্চল চৌধুরীও ভুরু নাচিয়ে নাচিয়ে যে এক্সপ্রেশন ডেলিভারিতে দিয়েছেন, তা দারুণভাবে সঙ্গত হয়েছে। পেশাদার দুই কুশলী অভিনয়শিল্পীর দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের সুবাদে গানটার মধ্যে অদ্ভুত সুন্দর প্রাণ সঞ্চারিত হতে দেখা যায়।

আইপিডিসি গানের পরিচয় দিতে গিয়ে লিখেছে, এই গান লোকজ গান হিসেবে সংগৃহীত। সেখানেই ঝামেলা লেগে গিয়েছে। দুই বছর আগেই এই গানের কপিরাইট নিয়ে রেখেছে ‘সরলপুর’ নামক একটি ব্যান্ড। ময়মনসিংহ অঞ্চলের এই ব্যান্ড মূলত ফোক গান গায়। রাজধানী-কেন্দ্রিক নয় বলে বোধহয় তারা সেই অর্থে সারা দেশে সুপরিচিত নয়। ৮ বছর আগে ইউটিউবে একটা ভিডিওতে তারা এই গানের ইতিহাস বর্ণনা করেছিল। মূল গানটা বাউল-সাধক শিল্পীরা গ্রামে-গঞ্জে পালাগানের আসরে পরিবেশন করতেন, সেটি এখন খুঁজে পাওয়া দুস্কর। সরলপুর ব্যান্ডের একজন উদ্যোক্তা নিজের আগ্রহে গানটা খুঁজতে শুরু করে ৩০ শতাংশ উদ্ধার করতে পেরেছিলেন। বাকিটা রাধাকৃষ্ণ লীলাকীর্তনের ভাবধারা ও শব্দচয়নের রীতি অনুসরণ করে তারা নিজেরা লিরিক লিখে পুনর্নির্মাণ করেছেন। তাদের লিরিক রচনা ও সুরপ্রয়োগেও দারুণ মেধা ও মুন্সীয়ানার প্রকাশ দেখা যায়।

ইউটিউবে সরলপুরের গাওয়া কয়েক রকম ভার্সন পাওয়া যায়। সাউন্ড কোয়ালিটি, গায়কী, মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্ট ও ভিডিওর অবস্থা কোনোটারই তেমন ভালো নয়। কিন্তু গানটা তারা গেয়েছেন সর্বোচ্চ দরদ দিয়ে। এর বাইরে আরও আরও কয়েকজন গানটা গাইবার চেষ্টা করেছেন, লাখ লাখ ভিউ হয়েছে, সাউন্ড কোয়ালিটি চমৎকার, কিন্তু গায়কী বীভৎস।

সার্বিক বিচারে শ্রুতিমাধুর্য্য ও প্রাণপূর্ণতার বিবেচনায় আমার কাছে সরলপুরের গাওয়া ভার্সনগুলোই সেরা লেগেছে। ভালো মিউজিক ভিডিও নির্মাতাকে দিয়ে এই গানটার চমৎকার একটা ভার্সন বানিয়ে তাদের উচিত দ্রুত আপলোড দেওয়া।

কিন্তু মেহের আফরোজ শাওন ও চঞ্চল চৌধুরীর গাওয়া গানটাও ইউটিউব ও ফেসবুকে অতি অবশ্যই থাকা দরকার। অনলাইনে ফোক গানের খাঁটি মানের অডিও-ভিডিও বড় অভাব। 'সর্বত মঙ্গল রাধে' গানটার এই ভার্সনের তাই মহাসমারোহে বিচরণ থাকা উচিত।

আইপিডিসি ধর্নাঢ্য প্রতিষ্ঠান। তারা মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কাজে নেমেছে বলে ধারণা করি। বিতর্ক শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা তাদের ভার্সন অপসারণ করে নিজেদের সদিচ্ছার প্রমাণ দিয়েছে। আইপিডিসির উচিত দেরি না করে সরলপুরের লোকজনের সঙ্গে তাড়াতাড়ি আলোচনায় বসে যাওয়া। সরলপুর যদি ক্ষতিপূরণ বা রয়ালিটির ন্যায্যমূল্য পেয়ে যায়, তাহলে তাদেরও উচিত হবে আইপিডিসির ভার্সন প্রকাশের বিষয়ে অযথা আপত্তি বহাল না রাখা। গানটা কিন্তু সার্বিকভাবে ভালোই হয়েছে।

বাংলাদেশের কপিরাইট অফিসের কাজকর্ম নিয়েও একটু-আধটু কথা বলা দরকার। কেউ গিয়ে দাবি করলেই, তাকে কপিরাইট দিয়ে দেওয়া উচিত কিনা, সেটা তাদের নতুন করে ভাবতে হবে। এর আগে মাসুদ রানা সিরিজের কপিরাইট নিয়ে তারা অনধিকার-চর্চিত ভুলভাল রায় দিয়ে লেজেগোবরে করেছে। ময়মনসিংহ গীতিকা বা ওই ধরনের লোকগীতির ভাবধারা থেকে সংগৃহীত ৩০ শতাংশ আদিগানের সঙ্গে ৭০ শতাংশ নিজেদের কনটেন্ট যুক্ত করে পুরো গানটির ওপর কপিরাইট পাওয়া যায় কিনা, সেটা নিয়েও বিতর্ক হতে পারে। বাংলাদেশে কপিরাইটের আইনকানুন খুব বেশি মানুষ জানে না, আইনের ধারাগুলোও কেমন জানি দুর্বোধ্য আর অস্পষ্ট। সত্যিকারের জানা-বোঝা মানুষদের নিয়ে এই আইনগুলো ঘসামাজা করা দরকার কিনা, সেটাও ভাবা দরকার।
'সর্বত মঙ্গল রাধে' গানের সর্বত মঙ্গল কামনা করছি।

নওরোজ ইমতিয়াজ : লেখক, সাংবাদিক।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.