Sylhet Today 24 PRINT

শুভ জন্মদিন: চিরকালেই চমৎকার চার্লি চ্যাপলিন

অঞ্জন আচার্য  |  ১৬ এপ্রিল, ২০১৫

চার্লির ভাঁড় বা ভবঘুরের উদাসীন মানুষটির কাছে পৃথিবীর মানুষ বাসযোগ্য ভালবাসা পেয়ে গেছে।

সেই ভবঘুরে মানুষটি- যার পরনে বগি ট্রাউজার্স, খুলে পড়বে বলে কোমরে দড়ি, মাথায় ক্ষুদ্রকায় বাউলার টুপি, গায়ে অতি আঁটসাঁট একটা কোট, পায়ে অতিকায় জুতো- উলটো করে পরা যদি খুলে যায়। আর নাকের নিচে টুথব্রাশের আঁশের মতো এক চিমটি মোচ। আর হাতে আছে সর্বকর্মক্ষম একটি ছড়ি।

ভবঘুরের এই অদ্ভুত সাজের পশ্চাদকাহিনী যাই থাক, এই কিম্ভুতকিমাকার মানুষটির চলনবলন বুদ্ধি অহঙ্কার ছলনা ও জীবন প্রয়াস এক মুগ্ধ করা অনির্বচনীয় স্বাদ এনে দিল দর্শকের মনে। কথাগুলো বলেন, নাট্যকার মমতাজউদদীন আহমদ।

‘চার্লি চ্যাপলিন : ভাঁড় নয় ভবঘুরে নয়’ গ্রন্থে লেখক আরও বলেন, ‘চার্লি মানেই চলমান হাস্য। চার্লির চলচ্চিত্র প্রেম ও করুণার আঁধার। ভবঘুরে চার্লি নিরাশ্রয় ও অপাঙক্তেয়, কিন্তু সে অকুতোভয়। জীবনের প্রতিভাস সে দেখে স্বপ্নে। বাস্তবের রূঢ় আঘাতে তার স্বপ্ন বার বার ভেঙ্গে যায়। বাস্তবের কঠিন সত্যের মধ্যে ভবঘুরের জন্য স্নেহাশ্রয় নেই। সর্বত্র সে একা।’

এই একা এবং অদ্বিতীয় মানুষটিকে সম্পর্কে জানা যাক আরও কিছু। স্যার চার্লস স্পেনসার চ্যাপলিন জুনিয়র, চার্লি চ্যাপলিন নামেই যিনি বেশি পরিচিত। হলিউড সিনেমার প্রথম থেকে মধ্যকালের বিখ্যাততম শিল্পীদের একজন চ্যাপলিন পৃথিবী বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালকও বটে। চলচ্চিত্রের পর্দায় শ্রেষ্ঠতম মূকাভিনেতা ও কৌতুকাভিনেতাদের একজন বলেও মনে করা হয় তাঁকে।

চলচ্চিত্র-শিল্প জগতে চ্যাপলিনের প্রভাব অনস্বীকার্য। নির্বাক চলচ্চিত্র যুগের অন্যতম মৌলিক ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব চ্যাপলিন নিজের ছবিতে নিজেই অভিনয়, সংলাপ রচনা, পরিচালনা, প্রযোজনা এমনকি সঙ্গীত পরিচালনা পর্যন্ত করেছেন। শিশুশিল্পী হিসেবে ইংল্যান্ডের ভিক্টোরিয়ান নাট্যমঞ্চ ও মিউজিক হলে সূচিত চ্যাপলিনের ৬৫ বছরের কর্মজীবনের যবনিকাপাত হয় ৮৮ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে।

সময়টা ১৮৮৯ সাল। ফিল্মের জন্য ক্যামেরা আবিষ্কার করেন যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন। পৃথিবীজুড়ে হৈ হৈ শুরু হয়ে গেল। একই বছরে অস্ট্রিয়ায় জন্ম নেয় পৃথিবীর নির্মম ঘাতক হিটলার। সে বছরই আরেক শিশু জন্ম নেয়, যে কিনা পৃথিবীর মানুষকে হাসাতে হাসাতে লুটোপুটি খাইয়ে ইতিহাসের সেরা কৌতুক অভিনেতা এবং নির্মাতা হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেন। সেই মানুষটির নাম ‘চার্লি চ্যাপলিন’।

প্রকৃতি যেন নিজের জন্যই এই কাকতালীয় ঘটনাটির সূত্রপাত ঘটিয়েছিল। যদি ক্যামেরা না হতো তাহলে পৃথিবীর ইতিহাসে চলচ্চিত্র বলে কোনকিছুর উদ্ভব হতো না; চ্যাপলিনও পৃথিবীর মানুষকে হাসাতে পারতেন না। আবার যদি হিটলার পৃথিবীতে না জন্মাতো তাহলে চ্যাপলিন তাঁর ছবির মাধ্যমে প্রতিবাদও জানাতে পারতেন না।

১৮৮৯ সালের ১৬ এপ্রিল লন্ডনের ওয়ালওয়ার্থ শহরের ইস্ট স্ট্রিটে জন্ম চার্লির। জন্মের কোন বৈধ প্রমাণপত্র পাওয়া যায়নি বলে তাঁর জন্ম নিয়ে সবসময়ই রয়ে গেছে কুয়াশা। সংবাদমাধ্যমে নানা সময়ে নানা রকম তথ্য দিয়েছে তাঁর জন্মস্থান সম্পর্কে।

এমনকি তাঁর চলচ্চিত্র জীবনের প্রথমদিকে চ্যাপলিন নিজেও একবার বলেছেন, ফ্রান্সের ফঁতেউব্ল শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। ১৮৯১ সালের মানবশুমারি থেকে জানা যায়, চার্লি তাঁর মা হান্নাহ চ্যাপলিন এবং ভাই সিডনির সাথে দক্ষিণ লন্ডনের ওয়ালওয়ার্থ শহরের বার্লো স্ট্রিটে থাকতেন, যা কেনিংটন জেলার অন্তর্গত।

তবে এর আগেই তাঁর বাবা চার্লস চ্যাপলিন জুনিয়রের সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে যায় তাঁর মায়ের। চ্যাপলিনের শৈশব কাটে ভয়াবহ দারিদ্র্য আর দুঃসহ কষ্টের মধ্যে। তাই হয়ত তিনি উপলব্ধি করতেন দেয়া ও পাওয়াতে কী আনন্দ। একটা কথা তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘বৃষ্টিতে হাঁটা খুবই ভাল। কারণ ওই সময় কেউ তোমার চোখের জল দেখতে পায় না।’

অসহনীয় দারিদ্র্যতার কারণে শিশু বয়সেই অভিনয়ের দিকে ঠেলে দেয় চ্যাপলিনকে। তাঁর মা-বাবা দুজনেই ছিলেন মঞ্চের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই এ পেশাতে আসাটাই তাঁর কাছে ছিল অনেক সহজ। চ্যাপলিন সেই সময়ের জনপ্রিয় লোকদল ‘জ্যাকসন্স এইট ল্যাঙ্কাসায়ার ল্যাডস’-এর সদস্য হিসেবে অংশ নেন নানা অনুষ্ঠানে।

মাত্র ১৪ বছর বয়সে উইলিয়াম জিলেট অভিনীত শার্লক হোমস নাটকে পত্রিকার হকার চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। এই সুবাদে তিনি ভ্রমণ করেন ব্রিটেনের বিভিন্ন প্রদেশে এবং অভিনেতা হিসেবে তিনি যে খুবই সম্ভাবনাময়, তা জানিয়ে দেন সবাইকে।

১৯১৪ সালে তাঁর নির্মিত ‘দ্য ট্রাম্প’ বা ভবঘুরে চরিত্রটি দিয়ে বিশ্ব চলচ্চিত্রে আলোড়ন তুলেছিলেন তিনি। নির্বাক চলচ্চিত্রের যুগে মানুষকে হাসানোর মতো দূরূহ কাজটি শুধুমাত্র অঙ্গভঙ্গি দিয়ে তিনি করে গেছেন অত্যন্ত সফলভাবে। সাদাসিধা ভবঘুরে একটা মানুষ, যার পরনে নোংরা ঢিলেঢালা প্যান্ট, শরীরে জড়ানো জীর্ণ কালো কোট, পায়ে মাপহীন জুতো, মাথায় কালো মতো হ্যাট আর হাতে লাঠি। যে ব্যাপারটি কারও চোখ এড়ায় না তা হচ্ছে লোকটার কিম্ভুত আকৃতির গোঁফ।

রাস্তায় রাস্তায় লোকটা ঘুরছে আর ঘটাচ্ছে অদ্ভুত সব কাণ্ডকারখানা। আর এসব দেখেই হেসে কুটিকুটি হচ্ছে বিশ্বের কোটি মানুষ। দ্য ট্রাম্প চলচ্চিত্র খুঁজে পেয়েছিল সর্বকালের সেরা শোম্যানকে। ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, পর্তুগালে ‘শার্লট’ নামে পরিচিত চ্যাপলিনের ‘ট্রাম্প’ ভবঘুরে হলেও বিট্রিশ ভদ্রজনোচিত আদব-কায়দায় সুসংস্কৃত এবং সম্মানবোধে অটুট।

অন্যদিকে ১৯৩১ সালে তাঁর নির্মিত ‘সিটি লাইট’ একটি নির্বাক হাস্যরসাত্মক প্রেমের ছবি। এ ছবিটি চার্লির কাহিনী, পরিচালনা, প্রযোজনা ও অভিনয়ে নির্মিত। আজ থেকে সাত যুগ আগের এ ছবিটি এখনও তুমুলভাবে জনপ্রিয়তা বজায় রেখে চলেছে নতুন প্রজন্মের কাছে। কমেডি-রোমান্টিক ছবির ক্যাটাগরিতে আজও এটি দখল করে আছে এক নম্বর স্থান।

তাঁর উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রগুলো হলো- মেকিং অব লিভিং (১৯১৪), কিড অটো রেসেস এ্যাট ভেনিস (১৯১৪), দ্য ট্রাম্প (১৯১৫), এ ডগস লাইফ (১৯১৮), শোল্ডার আর্মস (১৯১৮), দ্য কিড (১৯২১), দ্য গোল্ড রাশ (১৯২৫) প্রভৃতি। চার্লি চ্যাপলিন সম্পর্কে একটি মজার তথ্য বেশ সমাদৃত।

চার্লি চ্যাপলিন তখন বিশ্বখ্যাত এক ব্যক্তিত্ব। সেসময় চ্যাপলিনের অনুকরণে আয়োজন করা হয় এক অভিনয় প্রতিযোগিতার। ওই প্রতিযোগিতায় গোপনে নাম দেন চ্যাপলিন নিজেও। প্রতিযোগিতাও হয়ে গেল। প্রথম ও দ্বিতীয় যারা হলেন- ঘোষণা করা হয় তাদের নামও। প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান অধিকারী অভিনেতা হলেন চার্লি চ্যাপলিন।

জীবদ্দশায় কিছু অসাধারণ উক্তি করেছিলেন চ্যাপলিন। তিনি তাঁর শৈশব সম্পর্কে বলতেন, ‘আমার শৈশব ছিল অত্যন্ত কষ্টের। কিন্তু এখন তা আমার কাছে নষ্টালজিয়া, অনেকটা স্বপ্নের মতো লাগে।’ মানুষের জীবন সম্পর্কে তিনি বলতেন, ‘মানুষের জীবন ক্লোজ শটে দেখলে ট্র্যাজেডি, কিন্তু লং শটে সেটাই কমেডি।’

নির্বাক চলচ্চিত্রের এই কিংবদন্তি সবাক চলচ্চিত্র সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘শব্দ খুবই দুর্বল। ওটাকে হাতির চেয়ে বড় কিছুই বলা যায় না।’ আর এই কমেডিয়ানের শ্রেষ্ঠ উক্তি সম্ভবত এটাই : ‘না হেসে একটা দিন পার করা মানে একটা দিন নষ্ট করা।’ তাই হাস্যরসের মধ্য দিয়ে চ্যাপলিনের চলচ্চিত্রে সবসময় উঠে এসেছিল সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতিসহ তৎকালীন বিভিন্ন রাজনৈতিক সমস্যা, দুটি বিশ্বযুদ্ধ, হিটলারের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ, জাতীয়তাবাদ, মানবাধিকারসহ নানা সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়বস্তু।

প্রতিটি চলচ্চিত্রেই চ্যাপলিন তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন কোন না কোন বক্তব্য এবং সেটা তিনি করেছিলেন তাঁর চিরচেনা ভবঘুরে ভঙ্গিতে। বিশেষ করে বিভিন্ন ছবিতে তাঁর রাজনৈতিক জ্ঞানের যে পরিস্ফূটন দেখা যেত, তা ছিল সত্যিই চমৎকার।

চ্যাপলিনের বর্ণময় ব্যক্তিজীবন তথা সমাজজীবন খ্যাতি-বিতর্ক দুইয়েরই নিম্ন থেকে ছুঁয়ে গেছে শীর্ষ বিন্দু। তবে তাঁর জীবনের একটি বিশাল ট্র্যাজেডি হলো অস্কার জয়। অনারারি এ্যাওয়ার্ড ছাড়াও কম্পোজার হিসেবেও অস্কার জিতেছেন তিনি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এতবড় একজন অভিনেতাকে কখনও তাঁর অভিনয়ের জন্য অস্কার দেয়া হয়নি।

১৯৭৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে ৮৮ বছর বয়সে সুইজারল্যান্ডে প্রয়াত হন এ মহান শিল্পী। কিন্তু এমন বর্ণিল যাঁর চরিত্র, মৃত্যুতে তাঁর জীবন তো আর থেমে যেতে পারে না। মৃত্যুর মাত্র চার মাসের মাথায় চুরি হয়ে গিয়েছিল তাঁর মৃতদেহ। পরে অবশ্য পুলিশ তা খুঁজে বের করেন।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.