Sylhet Today 24 PRINT

করোনায় সংকটে সিলেটের পর্যটন

হৃদয় দাশ শুভ, শ্রীমঙ্গল |  ০৮ জুন, ২০২০

নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দিন দিন বাড়ছে। প্রতিদিন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বুলেটিন থেকে জানা যাচ্ছে দৈনিক গড়ে আড়াই হাজার মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন, গত কয়েকদিনের পরিসংখ্যান বলছে প্রতিদিন মারা যাচ্ছেন ত্রিশ জনের মত ৷

মার্চের ছাব্বিশ তারিখ থেকে ৫ দফায় সাধারণ ছুটি বাড়িয়ে ৩০মে পর্যন্ত করেও সামাল দেওয়া যায়নি পরিস্থিতি৷ সচরাচর সাধারণ ছুটি বা অবসরের কোন অবকাশ পেলেই বাঙালিরা বেড়িয়ে পড়েন ঘুরতে কিন্তু পাঁচ দফার সেই সাধারণ ছুটির সময় ঘর ছেড়ে বের হওয়ার জো ছিলো না তাদের, আর এই মানুষের গৃহবন্দিত্বের কারণে সংকটে পড়ে গেছে পুরো দেশের মত সিলেটের পর্যটনখাতও৷

বিজ্ঞাপন

সিলেটের বিভিন্ন টুরিস্ট স্পটগুলো সেই মার্চ থেকেই বন্ধ থাকার ফলে পর্যটকদের আনাগোনা নেই পর্যটনের জন্য প্রসিদ্ধ শহরগুলোতে৷ স্থানীয় প্রশাসনের নির্দেশনায় বন্ধ রয়েছে বেশিরভাগ হোটেল-মোটেল-রিসোর্ট-কটেজ৷ পর্যটকরা না আসায় সম্ভাবনাময় এই শিল্পের এ করুণ দশা৷

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনাভাইরাস দু’ভাবে বিপদে ফেলছে এ দেশের পর্যটন সংস্থাগুলিকে। শ্রীমঙ্গল ট্যুর গাইড এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক তাপস দাশ বলছেন, প্রথমত বিদেশের পর্যটকেরা বাংলাদেশ সফর বাতিল করছেন। কারণ, বিভিন্ন দেশ তাদের নাগরিকদের বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কবার্তা জারি করেছে। ফলে ব্যবসা হারাচ্ছে পর্যটন সংস্থাগুলি। দ্বিতীয়ত, দেশীয় পর্যটকরা সংক্রমণের ভয়ে ঘুরতে বের হচ্ছেন না তাই এই খাত আজ সমস্যায় পড়েছে৷

সারা বছর পর্যটন বিভাগ সিলেটে পর্যটকের আনাগোনা থাকলেও শীত মৌসুমে তা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। প্রতি ঈদের ছুটিতে রীতিমত ঢল নামে। ঈদের ১০ থেকে ১৫ দিন আগে থেকেই বুকড হয়ে যায় বিভাগের প্রতিটি হোটেল-রিসোর্ট। সিলেট জেলার অন্য এলাকার পাশাপাশি পর্যটকদের সব চেয়ে বেশি ভিড় থাকে শ্রীমঙ্গল–কমলগঞ্জে। এ সব এলাকার প্রায় ৭০টি হোটেল রিসোর্টের মৌসুম- ঈদের সময়। কিন্তু চলমান করোনাসংকটের কারণে সারাদেশে কার্যত লকডাউন থাকায় এ বছর ঈদে ছিলোনা সেই আমেজ।

পর্যটন সংশ্লিষ্ট সূত্রে যায়, প্রতি ঈদের মৌসুমে সিলেটে সবচেয়ে বেশি পর্যটক দেখা যায় বিছনাকান্দি, জাফলং, রাতারগুল, ডিবির হাওর, হাকালুকি হাওর, মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, মাধবপুর লেক, হামহাম জলপ্রপাত, মনিপুরি পাড়ায়। জেলার বিভিন্ন চা-বাগান ও বাইক্কাবিল, কালাপাহাড় এলাকায়৷ তাছাড়া চা বাগানের জন্য শ্রীমঙ্গলের বিভিন্ন পর্যটন স্পটও ব্যাপক জনপ্রিয়। এই পর্যটকদের ৯৫ শতাংশই থাকার জন্য বেছে নেন মৌলভীবাজার সদর, কমলগঞ্জ- শ্রীমঙ্গলের প্রায় ৭০টি হোটেল রিসোর্টকে। এ সব হোটেল-রিসোর্ট প্রতি বছর ঈদের সময় কয়েক হাজার পর্যটক আগাম বুকিং দিয়ে রাখেন। কিন্তু এই বছর পর্যটকের সংখ্যা ছিলো শূন্য। সেই সাথে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় পুঁজি হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তারা জানান, বন্ধ থাকলেও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কর্মচারী রাখতে হচ্ছে। যেহেতু কোন আয় নেই তাই পুঁজি ভেঙে বেতন দিতে হচ্ছে।

শ্রীমঙ্গলের এসকেডি আমার বাড়ি রিসোর্টের পরিচালক সজল দাশ বলেন, আমার ব্যাংক লোন আছে ২ কোটি টাকা। মার্চের ১১ তারিখ থেকে আমার রিসোর্ট বন্ধ। কর্মচারীদের ছুটি দিয়েছি কিন্তু তাদের বেতন তো দিতে হচ্ছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ বিলের জন্য চাপ আসছে। সব কিছু মিলিয়ে আমাদের ঋণের জালে আটকে যাচ্ছি, সরকারের সহযোগিতা ছাড়া বের হতে পারবনা। উল্টো পুঁজি হারানোর ভয়ে আছি।

বিজ্ঞাপন

শ্রীমঙ্গল শহরের গ্রিনলিফ রিসোর্টের পরিচালক এস কে দাস সুমন বলেন, গত বছর তার রিসোর্টের ঈদের ১ মাস আগেই সব বুকড হয়ে যায়। তার রিসোর্টের বেশিরভাগ বিদেশীরা আসেন। ঈদের সময়টা ব্যবসার উল্লেখযোগ্য সময় হিসেবে সারা বছরের প্রস্তুতি থাকে কিন্তু এই বছর করোনা সংকটের কারণে সেই সুযোগ ছিল না। উল্টো ঝুঁকিতে পড়েছে আমার ব্যবসা। পরিবারের অন্য খাত থেকে টাকা এনে কর্মচারীদের বেতন দিচ্ছি। তিনি জানান, আমরা পর্যটন ব্যবসায়ীরা বছরে কোটি কোটি টাকা ভ্যাট-ট্যাক্স দেই। বিপদের এই সময় সরকারের সাহায্য প্রয়োজন।

হোটেল মেরিনার পরিচালক নাজমুল হাসান মিরাজ বলেন, আমার হোটেলটি ভাড়া নিয়ে করেছি। মাসিক ভাড়া ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। কর্মচারীদের বেতনসহ মাসিক খরচ আড়াই লাখ টাকা। বর্তমান অবস্থায় ঋণে জড়িয়ে পড়েছি। সরকারের সাহায্য ছড়া এই অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়াতে পারবনা। পর্যটকদের আগমনকে ঘিরে ব্যস্ত সময় কাটান ট্যুর গাইডরা, কিন্তু এ বছর তাদের ফোনে কল আসছেনা।

লাউয়াছড়ার ট্যুর গাইড সাজু মারচিয়াং বলেন, ঈদের ২ মাস আগে থেকেই অনেকে ফোন দেন। কেউ কেউ বিকাশে অগ্রিম দিয়ে রাখেন। সব কাভার দেওয়া যায়না বলে তখন আমরা মৌসুমি মানুষ রাখি। কিন্তু এ বছর কোন গেস্ট তো দূরের কথা একটা ফোনও আসেনি।

পর্যটন সেবা সংস্থা শ্রীমঙ্গলের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক বলেন, আমার রিসোর্টগুলাতে গত বছর ২ মাস আগেও অনেকে বুক করেছেন। পরিচিত অনেককে শেষ মুহূর্তে দিতে পারিনি বলে তাদের মন খারাপ হয় কিন্তু এই বছর উল্টা চিত্র। শুনেছিলাম প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদনা থেকে আমাদেরকেও দেওয়া হবে। কিন্তু কবে হবে, বা হবে কিনা নিশ্চিত নই। যেভাবে আমরা ক্ষতির মুখে পড়েছি ব্যবসা ঠিকিয়ে রাখতে হলে প্রণোদনা দরকার।

এদিকে, করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে চলতি বছরের জুন নাগাদ প্রায় ৩ লাখ পর্যটনখাতের কর্মী তাদের চাকরি হারাবেন। সংশ্লিষ্ট শিল্পের বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে প্যাসিফিক এশিয়া ট্র্যাভেল এজেন্সি (পাটা) বাংলাদেশ চ্যাপ্টার এই অনুমান করেছে। পাটার অনুমান, জুন নাগাদ পর্যটনখাতে ৯ হাজার ৭০৫ কোটি টাকার লেনদেন হবে। সংস্থাটি তাদের এসব অনুমান সংক্রান্ত একটি সার্বিক হিসাবনিকাশ বেসামরিক বিমান চলাচল এবং পর্যটনমন্ত্রী মাহাবুব আলীকে লেখা এক চিঠিতে উল্লেখ করে। ওই চিঠিতে বর্তমান অবস্থার কারণে বেশকিছু প্রণোদনা চালু করতেও সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে পাটা। এতে স্বাক্ষর করেন পাটা বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের চেয়ারম্যান এবং হোটেল রিজেন্সির শীর্ষ নির্বাহী শহীদ হামিদ।

চিঠিটিতে জানানো হয়, করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারির কারণে দেশের পর্যটন শিল্প একেবারেই মুখ থুবড়ে পড়েছে। 'শত শত পর্যটন এবং ভ্রমণ আয়োজক কোম্পানি বন্ধ হতে চলেছে, ব্যাপক সংখ্যায় ছোট হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট এবং রেস্টুরেন্ট ব্যবসা বন্ধ হবে। আর এই মহামারির পর বেকার হয়ে পড়বেন আরও লাখ লাখ মানুষ।' পাটা বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের মহাপরিচালক তৌফিক রহমান জানান, পর্যটনখাত সংশ্লিষ্ট শিল্পের বিদ্যমান বাণিজ্যিক তথ্য সংগ্রহ করেই তারা চিঠিতে উল্লেখিত হিসাবটি প্রস্তুত করেছেন। তিনি বলেন, এই ব্যাপারে আমরা বেসরকারি বিমান পরিবহন সংস্থা, হোটেল, রিসোর্ট, ট্র্যাভেল এজেন্ট, ট্যুর অপারেটর এবং পরিবহন খাতের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করেছি।

দেশের অন্যতম শীর্ষ ট্যুর অপারেটর কোম্পানি জার্নি প্লাসের এই মুখ্য নির্বাহী আরও জানান, বর্তমান হিসাবে ৩ লাখ সাড়ে ৯ হাজার কর্মী চাকরিচ্যুত হবেন বলে অনুমান করা হচ্ছে। তবে পর্যটনের সকল খাতে এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
এই অবস্থায় সরকারের কাছে জরুরি সহায়তা দেওয়ার দাবি করে পাটা। এই ব্যাপারে চিঠিতে বলা হয়, 'উদীয়মান একটি খাত হিসাবে আমরা সরকারের কাছে প্রণোদনা বাবদ ন্যূনতম এক হাজার কোটি টাকা দেশের হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, রেস্তোরা, ট্যুর অপারেটর, পর্যটকবাহী সড়ক পরিবহনখাত এবং বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলোকে বরাদ্দ দেওয়ার অনুরোধ করছি। এছাড়াও আরও দুই হাজার কোটি টাকা এই মুহূর্তে সুদমুক্ত ঋণ হিসাবে বরাদ্দ দেওয়া জরুরি। স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসার আগ পর্যন্ত আমরা গ্যাস, বিদ্যুৎসহ নানা প্রকার ইউটিলিটি বিল মওকুফ করার অনুরোধ করছি।'

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.