Sylhet Today 24 PRINT

বউদের বাজার, বউবাজার

বাজারের নাম বউবাজার। কে কখন বাজারটির এই নামকরণ করেছিলেন তা জানা যায়নি। কিংবা হতে পারে আদৌ কেউ নামকরণ করেননি, বাজারে গৃহবধূদের আনাগোনার কারনে লোকের মুখে মুখে বাজারটি বউ বাজার নামে পরিচিত হয়ে উঠেছে। কেবল নারীদের জন্য ও নারীদের নিয়ে এটিই সিলেটের একমাত্র নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার।

নিজস্ব প্রতিবেদক |  ১২ অক্টোবর, ২০১৫

রবিবার। সকাল সাড়ে ৭ টা। এমনিতেই সিলেটের লোকজন বেলা করে ঘুম থেকে উঠে। নগরীর সেলুনের দোকানও সকাল দশটার আগে খোলা হয় না বলে অভিযোগ আছে। ফলে এই সাতসকালে কিছু দিনমজুর, পরিচ্ছন্নতা কর্মী আর ক’জন প্রাতঃভ্রমণকারী ছাড়া সকলেই ঘুমে। শান্ত নগরী।

তবে নগরীর সুরমা পাড়ের মাছিমপুরে তখন প্রচন্ড কোলাহল। এই সাতসকালেও রীতিমত বাজার জমে উঠেছে এখানে। এই বাজারের সব বিক্রেতাই নারী। এমনকি ক্রেতারাও।

বাজারের নাম বউবাজার। কে কখন বাজারটির এই নামকরণ করেছিলেন তা জানা যায়নি। কিংবা হতে পারে আদৌ কেউ নামকরণ করেননি, বাজারে গৃহবধূদের আনাগোনার কারনে লোকের মুখে মুখে বাজারটি বউ বাজার নামে পরিচিত হয়ে উঠেছে। কেবল নারীদের জন্য ও নারীদের নিয়ে এটিই সিলেটের একমাত্র নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার।

স্থনীয় এলাকাবাসীদের সাথে আলাপকালে জানা যায়, প্রায় ত্রিশ বছর ধরে এই বাজার বসছে। শুরুর দিকে এলাকারই দু’একজন নারী অল্প কিছু পণ্য নিয়ে বসতেন। বিক্রেতা নারী হওয়ায় তাদের কাছ থেকে পণ্য ক্রয় করতে আসতেন এলাকার গৃহবধূরা। ক্রমেই বাড়তে থাকে বিক্রেতার সংখ্যা। আশপাশের এলাকার নারীরাও এখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসা শুরু করেন। বাড়তে থাকে ক্রেতার সংখ্যাও। ক্রমেই তা রুপ নেয় বাজারে।

এই বাজারের বিক্রেতাদের বিক্রেতা হয়ে উঠার গল্পটা খুব একটা সুখকর নয়। এদের প্রায় সকলেই গৃহবধূ ছিলেন। স্বামী-সন্তান নিয়ে গৃহেই জীবনটা কাটিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তারা। কিন্তু জীবনের একেকটা বাস্তবতা তাদের একেজনকে গৃহবধূ থেকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীতে পরিণত করেছে। পুরুষতান্ত্রিক পরিবার আর সমাজের চোখ রাঙানো তো আছেই।

যেমন ধরা যাক আনোয়ারা বেগমের কথা। পাঁচ বছর আগে স্বামী মারা যান আনোয়ারা বেগমের। স্বামী ভ্যান চালাতেন। স্বামী মারা যাওয়ার পর দুই সন্তানকে নিয়ে প্রায় পথে বসে পড়ার উপক্রম হয় তার। অনেক জায়গায় কাজের জন্য ধর্ণা দিয়েও পাননি। অবশেষে ৪ হাজার টাকায় স্বামীর ভ্যান গাড়ি বিক্রি করে সেই টাকায় বউবাজারে সবজির ব্যবসা শুরু করেন আনোয়ারা।

আনোয়ারা জানান, প্রথমদিকে স্বামীর পরিবারের লোকজন সহ অনেকেই বাধা দিয়েছিলেন। মনমালিন্যও হয়েছিলো এ নিয়ে। পরবর্তীতে এই ব্যবসায় পরিবারে কিছুটা স্বচ্ছলতা আসায় এখন সেই মনমালিন্য কেটে গেছে। পরিবারে তার মর্যাদাও বেড়ে গেছে। এখন প্রতিদিন তিনি দেড় থেকে ২ হাজার টাকার সবজি বিক্রি করে থাকেন। তা থেকে দিনে তার শ’দুয়েক টাকা লাভ হয় বলে জানান আনোয়ারা।

কিংবা শোনা যেতে পারে সুজেতা আক্তারের গল্প। সুজেতার স্বামী বেঁচে আছেন। তবে বছর তিনেক ধরে একেবারে বিছানাবন্দী। প্যারালাইজড। দিনমজুর স্বামী অসুস্থ হওয়ার পর মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে সুজেতার। কিন্তু সুজেতা ভেঙ্গে পড়েননি। বাবার বাড়ি থেকে ৫ হাজার টাকা ধার এনে বউ বাজারে ফলমূলের ব্যবসা দেন তিনি। এই ব্যবসাই এখন তার সংসারের ভরণ-পোষন, অসুস্থ স্বামীর ঔষধ আর একমাত্র সন্তানের স্কুলের খরছ জোগায়। ফলমূল বিক্রি করে প্রতিদিন গড়ে আড়াইশ’ টাকার মতো লাভ করে থাকেন বলে জানান সুজেতা।

এলাকাবাসী জানান, আগে এই বাজার পাশ্ববর্তী চালিবন্দর এলাকায় বসত। পরবর্তীতে তা নদীতীরবর্তীতে মাছিমপুরে স্থানান্তরিত হয়।

বৌ-বাজার ঘুরে দেখা যায়, রাস্তার দু’পাশে প্রায় ৪০ জন নারী নিজেদের পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন। দোকানগুলোতে বিক্রয় কাজে সহযোগীতাকারীরাও নারী অথবা শিশু। বাজারে তেল-ডাল-লবন থেকে শুরু করে মাছ-মাংস-সবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব ধরনের পণ্যই পাওয়া যায়। মূলত এলাকার নিম্নবিত্ত পরিবারের গৃহবধূরাই এই বাজারের ক্রেতা ও বিক্রেতা। ঘরের পাশেই সবধরনের পণ্য পেয়ে যাওয়ায় ও বাজারে আগত সকলে নারী হওয়ায় স্বাচ্ছন্দে কেনাকাটার লক্ষ্যে ক্রেতাদের ভীড় লেগে থাকে এ বাজারে।

আলাপ হয় বউ বাজারে সবজি কিনতে আসা পাশ্ববর্তী ছড়ারপাড় এলাকার গৃহবধূ পারুল আক্তারের সাথে। তিনি বলেন, এই বাজারে অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে সবধরনের জিনিসপত্র পাওয়া যায়। তাছাড়া অন্যান্য বাজারের মতো পুরুষদের ভীড় না থাকায় স্বাচ্ছন্দে সদাইপাতি করা যায় তাই প্রায় প্রতিদিন সকালে এখানে আসি।

বাজারের আরেক ক্রেতা রুজিনা বেগম বলেন, সকাল সকাল বাজার বসায় আমরা বাজার সদাই করে নিজ নিজ কাজে চলে যেতে পারি। তাছাড়া এই বাজারে টাটকা জিনিস পাওয়া যায়। তাই এখানে আসি।

তিনি জানান, এই বাজারের ক্রেতা ও বিক্রেতাদের বেশিরভাগই নিম্নবিত্ত ও শ্রমজীবি।

বউ বাজারের সবজি বিক্রেতা আলতা বেগম বলেন, আমরা পাইকারী বাজার থেকে ভোরে পণ্য কিনে এনে এখানে বিক্রি করি। একেবারেই অল্প লাভে আমরা পণ্য বিক্রি থাকি। ফলে আমাদের কাছ থেকে ক্রেতারা অপেক্ষাকৃত কম দামে জিনিসপত্র কিনতে পারেন।

আলতা বেগম জানান, সবজি বিক্রি করে প্রতিদিন তিনি দুই থেকে আড়াইশ’ টাকা লাভ করে থাকেন।

বাজারের মাছ বিক্রেতা আফিয়া বেগম বলেন, মাছের দাম বেড়ে যাওয়ায় আগের মতো ব্যবসা হয় না। মাছের এখন যে দাম তা এখানকার বেশিরভাগ ক্রেতাদেরই নাগালের বাইরে। ফলে অনেকদিন তার মাছ অবিক্রিতই থেকে যায়। মাছ বিক্রি করে মাসে তার ৫/৬ হাজার টাকা লাভ করে থাকেন বলে জানান আফিয়া।

বাজারে ঘুরতে ঘুরতে বেলা বাড়তে থাকে। ভোরের কুয়াশা-টুয়াশা কাটিয়ে সুরমার জলে এখন তেজি সূর্যের প্রতিবিম্ভ। বেলার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বউ বাজারের ভিড় কমতে থাকে। সকাল ৭ টা থেকে ১১ টা পর্যন্ত এই বাজারে বেচাকেনা চলে। ১১ টার পর সদাইপাতির পাঠ চুকিয়ে এখানকার ক্রেতা বিক্রেতাদের যোগ দিতে হয় নিজ নিজ গৃহস্তালির কাজে। ব্যবসাবাণিজ্যকে এবার ছুটি।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.