Sylhet Today 24 PRINT

করোনা কালের মানবিক কথন

ডা. মো. রেজাউল কবির রাজীব |  ০৫ জুলাই, ২০২০

ডিউটি ও কোয়ারেন্টাইন পরবর্তী পারিবারিক সময় কাটিয়ে ফিরে চলেছি আবার কর্তব্যের টানে এমভি মানামীতে। কীর্তনখোলার জলে আষাঢ়ের ঢলঢলে চাঁদের প্রতিচ্ছবি দেখে পরিবারের জন্যে মনটা আকুল হয়ে উঠল। এইসব আবেগ একপাশে রেখে রাতের খাবার সেরে সবেমাত্র শোবার আয়োজন করেছি। তখন কেবিনের দরজায় ঠকঠক, লঞ্চের সুপারভাইজার এসেছেন। "স্যার, আপনিতো ডাক্তার। আমাদের লঞ্চে একজন গর্ভবতী মহিলা ব্যথায় কাতরাচ্ছেন। একটু যদি দেখে যেতেন।"

কাপড় পাল্টে তার সাথেই রওয়ানা হলাম। গিয়ে দেখি একটা কেবিনে একজন গর্ভবতী নারী একাই যাত্রা করছেন, স্বামী লঞ্চে তুলে দিয়ে গেছেন। তার সাদা চাদরে রক্তের ছোপ আর যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। মহিলার ভাষ্যমতে তিনি সাত মাসের অন্ত:সত্ত্বা। অবস্থা দেখে মনে হল প্রসব বেদনা শুরু হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে পাশের কেবিনের আইইউবিতে পড়ুয়া এক তরুণী এসে মহিলার ফোন থেকে তার স্বামীকে ফোন করে আচ্ছামত ঝেড়ে দিলেন তাকে এই অবস্থায় একা ছাড়ার জন্যে। সেই তরুণীই দোয়া-দরুদ পড়ে নারীকে পানি খাইয়ে দিলেন। এর মধ্যে কোত্থেকে দুইজন দাই এসে হাজির হলেন সুইপিং করে দিবেন বলে। আমার মাথায় ঘুরছে নারীর বয়ানে সাত মাসের গর্ভের কথা। যদিও ফান্ডাল হাইট বলছে এর থেকে বেশি। তবুও যদি ডেলিভারি করাই ও নবজাতক প্রিমেচিওর হয় এই অবস্থায় কোন সাপোর্ট দিতে পারব না। সুপারভাইজার সাহেবকে অনুরোধ করে লঞ্চের গতি বাড়াতে ও নারীর পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে ঘাটে এম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করতে বললাম।

এমতাবস্থায় নারীকে বাম কাত হয়ে শুইতে বলে আমি রুমে এলাম। ব্যথা বাড়লে বা যেকোন সমস্যা হলে ডাকতে বললাম। এরমধ্যে বেশ কয়েকবার গিয়ে দেখে এলাম। লঞ্চের গতি বাড়ানোতে দেশের বাইরে অবস্থানরত মানামীর উর্ধতন কর্তৃপক্ষ বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত হয়ে গেছেন। তারাও বারবার গর্ভবতী নারীর খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। পুরো লঞ্চে সাজসাজ রব পড়ে গেছে। রাত দুটোর দিকে আমাকে এসে আবার ডেকে নিয়ে গেল। গিয়ে দেখি পানি ভেঙে গেছে ও প্রসব বেদনা প্রচন্ড বেড়ে গেছে। সেখানে আবির্ভাব ঘটল শমরিতা হাসপাতালে মেডিসিনে কর্মরত এক ডাক্তারের। তাকে পিভি করতে বললাম। ক্রাউনিং হয়ে গেছে দেখে ডেলিভারির প্রস্তুতি নিলাম। ফান্ডাল প্রেশার দিতেই খুব সুন্দরভাবে বাচ্চা বের হয়ে এল। প্লাসেন্টার মাথা একজনকে ধরতে বলে বাচ্চার দিকটা গিট দিয়ে ছোট একটা কাঁচি দিয়ে কর্ড কাটলাম। কোত্থেকে এক রতি সুতো নিয়ে এল কেউ একজন। তা দিয়ে কর্ড ক্লাম্প করে দিলাম। ডেলিভারির সময় খুব নিচুস্বরে বাচ্চার কান্নার শব্দ শোনা গিয়েছিল। ঐ ডাক্তার বোনকে বললাম বাচ্চাকে উল্টে ব্যাক ম্যাসাজ করে দিতে ও মাউথ টু মাউথ ব্রিদিং দিতে। তার হাতে বাচ্চাকে দিয়ে এবার আমি মায়ের দিকে মনোযোগ দিলাম। আঙুলে পেঁচিয়ে জেন্টেল ইউটেরাইন ম্যাসাজ দিতে দিতে প্লাসেন্টা ডেলিভারি করলাম। আল্লাহর অশেষ রহমতে সম্পূর্ণ প্লাসেন্টা খুব সুন্দরভাবে বের হয়ে এল। বুক থেকে অনেক বড় পাথর বুঝি নেমে গেল। প্রসব পরবর্তী রক্তপাত হলে এই মাঝরাতে মাঝনদীতে কিভাবে ম্যানেজ করব ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। আরেকজনকে হালকা ম্যাসাজ করতে বলে আবার বাচ্চার দিকে মনোযোগ দিলাম। সেই ডাক্তার বোনের নিবিড় পরিচর্যায় বাচ্চা কেঁদে উঠেছে। সেইসাথে শরীরের ফ্যাকাসে ভাব গিয়ে গোলাপি হয়ে উঠেছে। কি সুন্দর করে তাকিয়ে আছে! তার এই দৃষ্টির কাছে ঐ চাঁদের আলোও বুঝি হার মেনেছে! একটু পর মাকে পরিষ্কার করে তার কোলে বাচ্চাকে তুলে দিয়ে বললাম বুকের দুধ খাওয়াতে। বাচ্চার সাকিং রিফ্লেক্সও বেশ ভাল দেখে আমি রুমে ফিরে এলাম। এরমধ্যে আমি পানিতে, ঘামে, রক্তে ভিজে একসার। ফেরার পথে লঞ্চের সুপারভাইজার ও অন্যান্য স্টাফরা আমাকে এসে ধন্যবাদ জানালেন ও আমার সাথে ছবি তুললেন।

প্রায় এক যুগ পর নরমাল ডেলিভারি করানো সহজ ছিলনা মোটেও। উত্তেজনায়, আবেগে, আনন্দে আমার এক অপার্থিব অনুভূতি কাজ করছিল। ফ্রেশ হয়ে একটু রেস্ট নিলাম। লঞ্চ ছেড়ে নামার সময় সবার কাছে বিদায় নিলাম। আমি কবে ফিরব জানতে চেয়ে সুপারভাইজার সাহেব বললেন তাদের উর্ধতন কর্তৃপক্ষ আমাকে ফেরার পথে তাদের আতিথেয়তা গ্রহণের অনুরোধ করেছেন। সারারাতের ঝক্কি শেষে এমন কিছুর জন্যে প্রস্তুত ছিলাম না মোটেই। আর আমরা বাংলাদেশের ডাক্তাররা এসব ব্যবহার পেয়ে অভ্যস্ত না তাই প্রচন্ড আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লাম। আমিও তাদেরকে ধন্যবাদ জানিয়ে নেমে পড়লাম আমার আপন গন্তব্যে।

এর আগে বিভিন্ন লঞ্চে যাওয়া হলেও এমভি মানামীতে এটাই ছিল আমার প্রথম ভ্রমণ। তাদের পেশাদারিত্ব, দায়িত্বশীলতা, আন্তরিকতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। বিশেষ করে পুরো লঞ্চ খুঁজে আমাকে বের করে তারা বেশ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। তাদের উপরমহলের তদারকি ও সৌজন্য প্রশংসার দাবি রাখে। সেইসাথে আমি মন থেকে ধন্যবাদ জানাই আইইউবির সেই তরুণী ও শমরিতা হাসপাতালের সেই ডাক্তারকে যাদের সহযোগিতায় এই মহান কাজটা অনেক সহজে সম্পাদন করা সম্ভব হয়েছিল। এছাড়াও পুরো লঞ্চের যাত্রীদের সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব ও মানবিকতা আমাকে মুগ্ধ করেছে।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.