Sylhet Today 24 PRINT

পূজার সেকাল-একাল

ঝুমুর রায় |  ২০ অক্টোবর, ২০১৫

"শরতে আজ কোন অতিথি এল প্রাণের দ্বারে আনন্দগান গা রে হৃদয়, আনন্দগান গা রে... " অতিথি এসেছেন। মহাসমারোহে মায়ের পূজা শুরু। একটা প্রাণচাঞ্চল্য সবার মাঝে। উৎসব বলে কথা, তা আবার শারদোৎসব!

আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি পূজা হত পূজার মতই। খুব বুঝতে পারত সবাই যে আরাধনা হচ্ছে, দেবতার আরাধনা। ঢাকের বোল, ধূপের গন্ধ, উলুধ্বনি, শঙ্খধ্বনি, ভক্তিগীতি... মিলেমিশে একাকার। সকাল থেকেই মাইকে বাজত পূজার গান।

মা দুর্গার অনেক রূপ চিনি অনেক নামে, আমার মায়ের পায়ের জবা হয়ে, আমারও তো সাধ ছিল,আশা ছিল মনে, মঙ্গলদ্বীপ জ্বেলে অন্ধকারে দু'চোখ আলোয় ভরো প্রভু... শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে যেত গানগুলো।

মণ্ডপসজ্জায় তখন ছিল না তেমন চাকচিক্য। মূর্তিতে ছিল না কত্রিম সংযোজন। মায়ের রূপ ছিল মায়ের মতই, শুধুই মুগ্ধতা, অপরূপ স্নিগ্ধতা।

আশ্বিন এলেই অপেক্ষা মহালয়ার। মহালয়া এল, তো পূজা দরজায় কড়া নাড়ছে। চারদিক থেকে রেডিওর আওয়াজ, চণ্ডীপাঠ, ভক্তিগীতি... প্রকৃতিও যেন সাজত পূজোর সাজে। আশ্বিনের রোদ যেন ঠিক বলে দিত আর ক'দিন পরেই দুর্গা পূজা, অতিথিকে বরণ করতে ফুল তোল, ডালা সাজাও, বাজাও ঢাক... পূজোর দিনগুলোতে প্রসাদের মিষ্টি গন্ধ, কলা পাতায় খিঁচুড়ি, দেবীর মণ্ডপ জুড়ে ধূপের ধোঁয়া, ঢাকের বাজনা, আরতি নাচ... সব মিলিয়ে একটা স্বর্গীয় ভাব যেন!

এখন বদলে গেছে অনেক কিছুই। 'পূজা মানে আরাধনা' কথাটা অনেকে জানে না বলেই মনে হয়। দেবীর মূর্তিতে এসেছে পরিবর্তন। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে মা'কে সাজানো হয় আধুনিক(!) রূপে। আর এই তাল মেলাতে গিয়ে অনেকেই খেই হারিয়ে বেতাল হন।

দেবীকে আমরা বলি 'মা'। বাংলার জননীর চিরায়ত সহজ সরল রূপের উল্টো সাজে দেবীর চেহারায়, অঙ্গসজ্জায়, পোশাকে তথাকথিত আধুনিকতার প্রলেপে এখন মা'কে এখন অনেক মণ্ডপেই খুঁজে পাওয়া দায়।

দেবীর বাহন নাকি অনেক জায়গায় নিজের মত বানিয়ে দেয়া হয়। মোটর বাইকেও নাকি বসিয়ে দেয়া হয় দেবীকে। গায়ের বসনেও আধুনিকরণ! বড্ড সেকেলে দেবী, তাই আজকাল স্কার্ট বা মডার্ন পোশাক চাপানো হয় দেবীদের গায়ে। সামাজিক সাইটগুলোর কল্যাণে তেমন অনেক মূর্তি দেখে ভিড়মি খাবার অবস্থা!

শুরুতে বলেছিলাম গানের কথা। পূজামণ্ডপে আজকাল এমন সব গান বাজে, মনে প্রশ্ন জাগে, এই গান বাছাই করে কারা! এইসব মণ্ডপ বা সংঘে এমন কেউ কী নেই, যিনি বা যারা সংঘের ছেলেদের পূজার মাহাত্ম্য বুঝাতে পারেন!

'আরে বাবা, ছেলেপুলে পূজার একটু মজা করছে, করুক না' এই বলে হয়ত অনেকেই পাশ কাটিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু ভেবে দেখুন তো, কী গান বাজছে দেবতার আরাধনার স্থানে! এতে আমরা কী শিখছি, বা ভিন্ন ধর্মের অনুসারীরাই কী ভাবছেন আমাদের পূজার ব্যাপারে!

শিলা কি জওয়ানি, পেয়ারিলাল, উলালা উলালা জাতীয় গান আমাদের বাংলার সংস্কৃতির সাথেই বেমানান, আর পূজার স্থানে অনবরত বাজছে এসব গান।

আবার জনপ্রিয় এক গান, ভজ গৌরাঙ্গ, কহ গৌরাঙ্গ, লহ গৌরাঙ্গর নাম রে... গানটা শুনলে হঠাৎ মনে হবে ভক্তিগীতি, কিন্তু প্রথম লাইনটা দেখুন - কৃষ্ণ করলে লীলা, আমরা করলে বিলা... আমরা পূজা করছি, আরাধনা করছি দেবতার, আর সেই চত্বরেই বাজাচ্ছি কৃষ্ণ করলে লীলা... ঠিক এভাবেই বাজছে থোরা সা কারলে রোমান্স, তুই যে আমার কোকাকোলা, আব ম্যায় জোওয়ানি হো গ্যায়ি, এমন অসংখ্য গান, সারাদিন বাজছে এসব।

হিন্দি হোক, বাংলা হোক, যে গানের ভাষা পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, তা অবশ্যই বর্জনীয়। বিষয়টা সংশ্লিষ্টদের অবশ্যই খেয়াল রাখা উচিত। ধর্ম যখন ঘটা করে পালনই করবেন তাহলে রীতি মেনেই করুন।

পূজার স্থান আরাধনার স্থান। সেখানে আধুনিকতার নামে যেমন খুশি মূর্তি বানানো, যা ইচ্ছে গান বাজানো, এসবের দায় শুধু অল্পবয়সীদের নয়, সবার উপরেই বর্তায়। পূজার নামে এমন গা-ভাসিয়ে ছুটে চলা - কোন পথে হাঁটছি আমরা, ভাবনার বিষয়!

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.