Sylhet Today 24 PRINT

লাল শাপলার রাজ্যে একদিন

মো. মইনুল ইসলাম |  ১৩ জানুয়ারী, ২০২১

শীতের কুয়াশামাখা মিষ্টি সকাল। সূর্যের দেখা নেই। বড়লেখা থেকে আমাদের যাত্রা। গন্তব্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সিলেটের কানাইঘাট। মাইক্রোবাসে (কার) চালকসহ আমরা ৫ জন। ঘন কুয়াশায় রাস্তায় গাড়ি এগিয়ে চলেছে। গাড়ির জানালা খোলে বাইরে থাকাই। হাড়কাঁপানো শীতের মধ্যেই রাস্তায় হরেক রকম পণ্য নিয়ে বের হয়েছেন কয়েকজন। জীবিকার টানে তাদের ছুটে চলা।

কোথাও শীতে জবুথবু মানুষ খড়কুটো জ্বেলে গা গরম রাখার চেষ্টা করছেন। পিচঢালা রাস্তা ধরে চাদরে মুড়িয়ে হেঁটে চলেছেন কর্মজীবী মানুষ। আমাদের গাড়ি চলছে। যাত্রাপথে প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছে যাই বাংলাবাজার। সকাল তখন সাড়ে ৯টা বাজে।

ততক্ষণে কুয়াশা ভেদ করে সূর্য উঁকি মেরেছে। বাজারে-রাস্তায় মানুষ বাড়তে শুরু করেছেন। বাংলাবাজার থেকে বের হয়ে আমরা উপজেলার লাল শাপলার রাজ্য ‘আন্দু লেকের’ দিকে এগোই। ওই এলাকার এক সহকর্মীর মাধ্যমে লাল শাপলার লেকটির খবর পাই। স্থানীয়দের কাছে শাপলার লেকটি ‘আন্দু লেক’ নামেই পরিচিতি পেয়েছে। স্থানটি এখনও ভ্রমণপিপাসুদের কাছে খুব একটা পরিচিতি পায়নি।

আনুমানিক ১০ মিনিট গাড়ি চলার পর দেখা মিললো অপরূপ ‘আন্দু লেকের’। দূর থেকে দেখা গেল সবুজ পাতার আচ্ছাদনে ঢাকা পড়েছে লেকের বিস্তীর্ণ জলরাশি। পানিতে ফুটে থাকা হাজারো লাল শাপলা হার মানিয়েছে সূর্যের আভাকেও। প্রকৃতির বুকে আঁকা এ যেন এক নকশিকাঁথা। এমন সৌন্দর্যে চোখ জুড়িয়ে যায়। লাল শাপলা ছাড়াও আছে সাদা ও নীল শাপলা। তবে লাল শাপলাই বেশি। আমরা লেকের আশপাশ ঘুরে ঘুরে সৌন্দর্য উপভোগ করছি। সেই সাথে স্মৃতি ধরে রাখতে মুঠোফোনের ক্যামেরায় ছবি তুলছি। এমন সময় ভ্রমণ পিপাসু একদল তরুণ ছুটে আসেন লেকে। শাপলার সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসা তাদের। লেক ও শাপলার সৌন্দর্য দেখে তারাও মুগ্ধ।

সিলেট জেলার কানাইঘাটের ১নম্বর লক্ষীপ্রসাদ ইউপি ও ৩ নম্বর দিঘীরপার পূর্ব ইউপি এবং ৪ নম্বর সাতঁবাক ইউপি মিলে লেকটির অবস্থান। বৈশাখ কিংবা আষাঢ় মাস নয় সারাবছরই সমানভাবে পানিতে ভরপুর থাকে। কোনো নদীর সঙ্গে সংযোগ নেই বলে জোয়ার এবং স্রোত কিছুই নেই। তবে নদীটির অন্যতম আকর্ষণীয় দিক হলো এটি দেখতে ইংরেজি ‘ইউ’ বর্ণের মতো। লেকটিতে পর্যাপ্ত খাবার ও মানুষের উপস্থিতি অনেক কম হওয়ার কারণে এখানে নানা প্রজাতির পাখির নির্বিঘ্নে বিচরণ চোখে পড়ার মত। শুধু লাল শাপলা আর পদ্মই না, পাখির গুঞ্জনে মুখরিত লেক। পানকৌড়ি, ডাহুক, শালিক, দোয়েলসহ দেশীয় পাখিদের কলতান সৌন্দর্য বাড়িয়েছে অনেকগুন।

এলাকা ঘুরে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, আন্দু নদী এক সময় সিলেটের সুরমা নদীর শাখা ছিল। উৎস কানাইঘাটের জয়পুরে। সেখান থেকে ছুটে হাওরে মিশেছে। উৎস মুখ ভরাট হয়ে যাওয়ায় বদ্ধ জলাশয়ে রূপ নেয় এক সময়ের খরস্রোতা নদী আন্দু। স্থানীয়দের কাছে এখন এটি আন্দু গাঙ বা আন্দু লেক নামে পরিচিত। আন্দু লেক এখন লাল শাপলার দখলে। প্রায় ৫০০০ মিটার দীর্ঘ ও ৪০০ মিটার প্রস্থ এ লেকে ফুটে থাকা অসংখ্য লাল শাপলা ভ্রমণ পিপাসুদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। শিশির ভেজা ভোরে পাপড়ি মেলা লাল শাপলা মুগ্ধ করছে পর্যটকদের। সূর্যাস্তের সাথে সাথে শাপলা তার নিজের সৌন্দর্য গুটিয়ে নিতে শুরু করে। তাই সম্পূর্ন ফুটন্ত শাপলা দেখতে হলে ভোরে যেতে হয়।

তিনটি ইউনিয়নের মিলনস্থলে শাপলার রাজ্যের ‘আন্দু লেক’ অবস্থান। লেকের উত্তর দিকে রয়েছে মাথা উঁচু করা আসাম রাজ্যের পাহাড়। সিলেট-জকিগঞ্জ রোডের জুলাই নামক স্থান থেকে লেক (আন্দু) পর্যন্ত স্বচ্ছ পানির একটি সুন্দর খাল। কালের পরিক্রমায় লেকের চার পাশে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট গ্রাম। সেখানে বসতি গড়েছেন মানুষ। পুকুর না থাকায় লেক পাড়ের প্রায় প্রত্যেক বাড়ির সাথে পাকা বাঁধাই করা ঘাট। গোসল থেকে শুরু করে নিত্যদিনের কাজে লেকের পানি তারা ব্যবহার করেন। লেকটি স্থানীয়দের মাছের চাহিদা পূরণ করছে। পাশাপাশি স্থানীয় অনেকের জীবন জীবিকার উৎস এই লেক। লেকের পাশ ঘেষা রয়েছে জুলাই আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়। এছাড়া ভবানীগঞ্জ বাজার নামে একটি বাজার, ৪টি জামে মসজিদ ও ২টি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে।

ঘুরতে ঘুরতে কথা হচ্ছিল জুলাই উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক রিদওয়ানুল ইসলামের সাথে। কথা হয় এলাকার মানুষের জীবনযাপন, লেকটির নামকরণসহ নানা দিক নিয়ে। রিদওয়ানুল ইসলাম বলেন, ‘ব্রিটিশ আমলে এটাই ছিল সুরমার মূল স্রোতধারা। এ অংশটি অনেকটা আকাঁবাকা। ১৮৯৭ সালের প্রলয়ংকারী ভূমিকম্পে সুরমা নদীর এ অংশের গতিপথ বদলে যায়। মূল প্রবাহ ১ নম্বর লক্ষ্মীপ্রসাদ ইউনিয়নের দিকে সৃষ্টি হয় এবং ক্রমে সেটিই সুরমার মূল স্রোতধারায় পরিণত হয়। নব সৃষ্ট সে প্রবাহ অনেকটা সোজা হওয়ায় নৌযোগাযোগের ক্ষেত্রে অনেক সুবিধার সৃষ্টি করে এবং এটাকে মূলপথ হিসেবে সরকার ব্যবহার শুরু করে। এ সময় থেকে আদি প্রবাহ অর্থাৎ বর্তমান আন্দুগাঙ্গ একধরণের প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলে। যার কারণে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার পুরাতন সুরমাকে স্থানীয় মানুষের কল্যাণের চিন্তা করে ও এলাকাকে নদীভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এবং নদীর গতিপথ সোজা করার জন্য লেকটির দু’পাশে মাটি ভরাট করে সুরমা নদী থেকে এ অংশ বিচ্ছিন্ন করে।’

রিদওয়ানুল ইসলাম আরও জানান, লেকটি খুব পরিচিতি না পেলেও স্থানীয়ভাবে জেনে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে যান পর্যটকরা। সকাল-সন্ধ্যা লেকের পাড়ে বসে সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত দেখতে ভিড় জমায় নানা বয়সী মানুষ। ভৌগলিক কারণে এটি সম্ভাবনাময় পর্যটনকেন্দ্র। যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করলে দৃষ্টিনন্দন একটি পর্যটন স্পট হিসেবে পরিচিতি পাবে।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.