Sylhet Today 24 PRINT

বসন্ত এসে গেছে

দেবাশীষ দেবু |  ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

শিল্পোন্নত যে দেশগুলো জলবায়ুর পরিবর্তন ঠেকাতে পৃথিবীময় অর্থ আর সবক দিয়ে বেড়াচ্ছে, তারাই কিন্তু ব্যাপক কার্বন নিঃসরণের মাধ্যমে জলবায়ু বদলে দিচ্ছে। নগরে বসন্ত উৎসবের ব্যাপারটিও অনেকটা এ রকম।

গাছ কেটে, পাহাড়-টিলা সাফ করে, জলাশয় ভরাটের মাধ্যমে পরিবেশ-প্রকৃতি ধ্বংস করে দিয়ে এখানে করা হয় প্রকৃতির বন্দনা। নানাবিধ আয়োজনে বরণ করে নেয়া হয় ঋতুরাজ বসন্তকে। পয়লা ফাল্গুনে নাগরিক তারুণ্য বসনে-ভূষণে বসন্তের রঙে সেজে সমস্বরে গেয়ে ওঠে, ‘আহা আজি এই বসন্তে কত ফুল ফুটে, কত পাখি গায়।’

কিন্তু নগরে ফুল কোথায়? দোকানে দোকানে ফুল আছে বটে, তরুণীদের খোঁপায়ও আছে কিছু। কিন্তু গাছ আর বাগান কই? নগর তো পুষ্পহীন। পাখিই বা গাইছে কই?

কোকিল দূরে থাক, কাক আর চড়ুইই তো দুর্লভ এখানে। নগরজুড়ে তো কেবল ইট আর সিমেন্ট। আকাশ ঢেকে দেয়া একেকটা অট্টালিকা। গায়ের রং বদলে দেয়া সোডিয়াম আলো।

ফলে কোনো এক বসন্ত দিনে, সিলেটে গ্রামের খোলা হাওয়া আর অবারিত সবুজে বেড়ে ওঠা বাউল যখন গাইছেন, ‘বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে, সইগো বসন্ত বাতাসে...’, তখন নাগরিক কবিকে লিখতে হচ্ছে, ‘ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক, আজ বসন্ত।’

সিলেটকে বলা হতো প্রকৃতিকন্যা। এখনও বলা হয়ও। অসংখ্য পাহাড়-টিলা ঘেরা এই নগরে কিছুদিন আগেও দেখা মিলত ঘন সবুজের।

নগর লাগোয়া চা বাগান, বনভূমি, নগরের মধ্যেই ছোট ছোট টিলা, অসংখ্য দীঘি, আসাম প্যাটার্নের সব একতলা বাড়ি আর গাছগাছালি সিলেটকে করেছিল অনন্য। কিন্তু সেই দিন আর নেই। তিলে তিলে তিলোত্তমা হয়ে ওঠার কথা ছিল যে শহরের, সেটিই এখন মেগাসিটি হওয়ার দৌড়ে নেমে ছেঁয়ে গেছে অসংখ্য বহুতল ভবনে।

তবে সব শেষ হয়ে যায়নি এখনও। কোথাও কোথাও এখনও দেখা মেলে সবুজের। এখনও কোথাও ফোটে ফুল। গাছের শাখায় দোলে নবতর পাতা আর মুকুল। এই নানা রঙের ফুল-মুকুল-পাতা জানান দেয়, ‘বসন্ত এসে গেছে।’

সিলেট নগরের রিকাবিবাজার এলাকায় গিয়ে দেখা মিলল এমন পত্রপুষ্পময় সড়কের। রিকাবিবাজার-মিরের ময়দান সড়কটি ২০১৭ সালে প্রশস্ত করে সিলেট সিটি করপোরেশন। এরপর সড়ক বিভাজকে কৃষ্ণচূড়া ও রাধাচূড়ার চারা রোপণ করা হয়।

এই সড়ক ছাড়াও সুবিদবাজার-মদিনা মার্কেট সড়কের বিভাজকে লাগানো কৃষ্ণচূড়া-রাধাচূড়া গাছেও ফুটেছে রঙিন ফুল। নগরের বালুচর এলাকায় গিয়ে দেখা মিলল বসন্তের ট্রেডমার্ক হয়ে ওঠা শিমুল ফুলেরও। ফুলের উপর পাখিও বসেছে দুয়েকটা। দেখা মিলল মুকুলে পাতা ঢেকে যাওয়া আম গাছেরও। নগর থেকে বসন্ত এখনও ফুরিয়ে যায়নি তাহলে।

সিলেট সিটি করপোরেশন জানিয়েছে, নগরের বিভিন্ন সড়ক বিভাজক, সুরমা নদীর দুই তীর, মানিকপীর টিলাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ফুল গাছের চারা রোপণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘আমরা নগরে পরিবেশের সুরক্ষায় সবসময় সচেষ্ট। পরিবেশ ধ্বংস করে কোনো উন্নয়ন আমরা চাই না। নগরের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। ফুলের গাছ লাগানো তার একটি অংশ।

‘শুধু সড়ক বিভাজকে নয়, নগরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গা ও সুরমা নদীর তীরে আমরা কৃষ্ণচূড়া-রাধাচূড়া গাছ রোপণের উদ্যোগ করছি। এগুলো সফল হলে নগরে বসেই প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন সবাই। সিলেটকে আমরা একটি পর্যটকবান্ধব সুন্দর নগর হিসেবে গড়ে তলতে চাই।’

কেবল নগরের কথাই বলা কেন, গ্রামও কি আছে আগের মতো? ‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর’-কবির এই আকুতি উপেক্ষা করে এখন আমাদের নতুন স্লোগান, ‘গ্রাম হবে শহর’।

তবু তো নগর থেকে ভালো। বসন্তের মিহি হাওয়া, ফুল, ভ্রমর আর পাখির গানের যা কিছু অবশিষ্ট আছে, তা এখনও গ্রামেই পাওয়া যায়।

তাই নাগরিক শিশুদের ঋতুবৈচিত্র্য দেখাতে প্রতি দুই মাস অন্তর অন্তর গ্রামে নিয়ে যান বিমান তালুকদার নামে সিলেটের এক সংস্কৃতিকর্মী। ‘মেঠোসুর’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করেন তিনি।

এই পত্রিকার উদ্যোগেই শিশুদের নিয়ে যান প্রকৃতির কাছে। সর্বশেষ গত ৬ ফেব্রুয়ারি নগরের শতাধিক শিশু ও তাদের অভিভাবকদের শীতের সৌন্দর্য দেখাতে হাকালুকি হাওরে নিয়ে যান বিমান।

তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে উন্নয়ন মানেই পরিবেশ-প্রকৃতি ধ্বংস। একদিকে নদী দখল করে ফেলা হচ্ছে, অপরদিকে অসংখ্য সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। কিন্তু নদীই যদি না থাকে, সেতু দিয়ে কী হবে? আমাদের উন্নয়নগুলো এ রকমই।

‘নগরে বসে এখন আর ষড়ঋতু বোঝা যায় না। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা- এই তিন ঋতুই নাগরিক মানুষ উপলব্ধি করতে পারে। ফলে ঋতুবৈচিত্র্য বুঝতে হলে গ্রামে যেতে হবে। এ কারণে আমরা নগরের শিশুদের ঋতুবৈচিত্র্য দেখাতে গ্রামে নিয়ে যাই। বসন্তের সৌন্দর্য দেখাতেও গ্রামে নিয়ে যাব।’

প্রতি বছর বসন্ত বরণে সিলেট নগরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলেও এবার করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে বড় কোনো আয়োজন হচ্ছে না বলে জানালেন সিলেট সম্মিলিত নাট্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রজতকান্তি গুপ্ত। ক্যাম্পাসগুলো বন্ধ থাকায় এবার ঘরোয়া আয়োজনে বসন্তকে বরণ করে নেয়া হবে বলে জানান তিনি।

আর পরিবেশবাদী সংগঠন ‘ভূমিসন্তান বাংলাদেশ’-এর সমন্বয়ক আশরাফুল কবীরের মতে, প্রকৃতি বন্দনার উৎসবের পাশপাশি প্রকৃতির সুরক্ষায়ও আমাদের মনোযোগী হতে হবে। নতুবা পলাশ-শিমুল-কোকিল আর বসন্ত কেবল বইয়েই থাকবে। বাস্তবে এসবের দেখা মিলবে না।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.