Sylhet Today 24 PRINT

গণতন্ত্রের অপর নাম নূর হোসেন

সিলেটটুডে ডেস্ক |  ১০ নভেম্বর, ২০১৫

`স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক` স্লোগানটির সঙ্গে সকলেই পরিচিত। এ স্লোগানটি যিনি বুকে ও পিঠে ধারণ করে তৎকালীন স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে (১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর) শহীদ হন তিনি নূর হোসেন। গণতন্ত্র ও শহীদ নূর হোসেন যেনো বাংলা মায়ের যমজ সন্তান। একই চেহারায় ভিন্ন দুটি নাম। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বরের পর থেকে এই দিনটি শহীদ নূর হোসেন দিবস পালিত হয়ে আসছে।

শহীদ নূর হোসেনের পরিচিতি :
নূর হোসেনের পৈতৃক নিবাস পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলার সাপলেজা ইউনিয়নের ঝাটিবুনিয়া গ্রামে। তার বাবার নাম মজিবুর রহমান ওরফে কাঞ্চন মিয়া এবং মায়ের নাম মরিয়ম বেগম। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তিনি তৃতীয়। নূর হোসেনের জন্ম ১৯৬৪ সালের কোনো এক বিকেলে ঢাকার নারিন্দায়।

নূর হোসেনের শৈশব, কৈশোর ও যৌবন :
নূর হোসেনের শৈশব শুরু হয় ঢাকার নারিন্দায়। তারপর কিছুদিন থাকেন ৭৮/১ বনগ্রামে ও গেন্ডারিয়ায়। আবার বেশ কিছুদিন থাকেন মুন্সিগঞ্জের রামপালে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের দুই বছর পর তার পরিবার স্থান পরিবর্তন করে ঢাকার ৭৯/১ বনগ্রাম রোডে আসার সুবাদে তার পরবর্তী জীবন অতিবাহিত হয় বনগ্রামেই। ছোটবেলা থেকেই নূর হোসেন ছিলেন খুবই চঞ্চল প্রকৃতির। বয়স বাড়তে বাড়তে হয়ে ওঠেন এক চঞ্চলমতি কিশোর। দিন কাটতো তার ঘোরাফেরা করে।

বনগ্রামের এ-বাড়ি ও-বাড়ি সবখানেই ছিল তার অবাধ যাতায়াত। তিনি এতই মিশুক ছিলেন যখন যে বাড়িতে ইচ্ছে সে বাড়িতেই খেতে বসে পড়তেন। ভালোবাসতেন সবাইকে। দরিদ্র পরিবারে জন্ম হলেও নিজেকে মানিয়ে নিতেন যেকোনো পরিবেশে। তার চলার স্টাইলে দারিদ্রের ছাপ পড়েনি কখনো, ছোটবেলা থেকেই ছিলেন পরিবারের সবার থেকে আলাদা।

দরিদ্রতা ছিল যদিও নূর হোসেনের পরিবারের নিত্যদিনের সঙ্গী তবু তিনি চেয়েছিলেন লেখাপড়া শিখতে। যার ফলে তাকে ভর্তি করা হয় বাড়ির পাশের রাধা সুন্দরী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। নূর হোসেন পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পর ভর্তি হন গ্রাজুয়েট হাই স্কুলে। অভাবের তাড়নায় বেশি দূর পড়ালেখা করতে পারেননি। অষ্টম শ্রেণি পাসের পর পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে মােটর মেকানিকের কাজে যোগ দিতে হয়েছিল। পেশা হিসেবে নূর হোসেন মিনিবাস সমিতি চালিত বাসের সুপারভাইজার হিসেবেও দীর্ঘদিন কাজ করেছেন।

নূর হোসেন কাজের ফাঁকে নিজ উদ্যোগে সদরঘাটের কলেজিয়েট নৈশ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন।

খেলাধুলায়ও তার বেশ সুনাম ছিল তাঁর। ভালো ফুটবল খেলতেন, ব্যাডমিন্টনও খেলতেন খুব ভালো। তিনি গান গাইতে পারতেন।

আস্তে আস্তে তিনি রাজনীতিতে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন।পরবর্তীতে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের বনগ্রাম শাখার পাব্লিসিটি সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন। তখন থেকেই বিভিন্ন মিটিং মিছিলে যোগদান করতেন। নেতৃত্ব দিতেন। পুরোপুরি সক্রিয় হয়ে পড়েন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে। তখন থেকেই মায়ের মনে দুশ্চিন্তা ঢুকে পড়ে। কিন্তু তখন তিনি বাবা-মাকে বলতেন, তোমরা দেখ একদিন আমি এমন কিছু করবো যেন সবাই আমাকে মনে রাখে।

নূর হোসেনের বড় ভাই আলী হোসেন বলেন, তার-আর আমার বয়সের পার্থক্য তো বেশি ছিল না। সে সব কথাই আমাকে বলতো। অনেক সময় মজা করে বলতো, ভাই তুমি তাড়াতাড়ি বিয়ে করো, তোমার পরেই তো আমার পালা। তার স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল। দুই হাতে মেহেদির ছোপ লাগার আগেই জীবন প্রদীপ নিভিয়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে।

গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও শহীদ নূর হোসেন :
আশির দশক ছিল বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক অশুভক্ষণ। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ বুলেটের জোরে ক্ষমতা কেড়ে নেন তৎকালীন সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ধীরে ধীরে তিনি রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা অধিকৃত করতে লাগলেন। ক্ষমতায় বসেই বিরোধী দলের ওপর প্রয়োগ করেন দমন নীতি। বাংলার মানুষ হারাতে বসে ভাত আর ভোটের অধিকার। স্বৈরাচারকে কেউ মেনে নিতে পারেনি। স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য রুখে দাঁড়ায় ছাত্র-সমাজ, সাধারণ মানুষ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। সারাদেশে শুরু হয় আন্দোলন, সংগ্রাম, মিছিল, মিটিং ও ঘেরাও কর্মসূচি।

১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ঢাকা মহানগরী অবরোধ ঘেরাও কর্মসূচি ঘোষণা করে। এর বিপরীতে সরকার পক্ষ ৯ নভেম্বর ১৯৮৭ সালের সকাল ৬টা থেকে ১৫ নভেম্বর ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত সাতদিনের জন্য পাঁচ বা ততোধিক ব্যক্তির সমাবেশ, মিছিল, বিক্ষোভ প্রদর্শন ও সকল প্রকার অস্ত্র-শস্ত্র, বিস্ফোরক দ্রব্য, লাঠিসোটা বহন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। আর এ আদেশ বলবৎ করার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নিয়োগ করা হয়। এ কথা শোনার পর নূর হোসেনের মায়ের মনে দুশ্চিন্তা বাসা বাধে। কেন না নগরীর সকল মিটিং মিছিলে নূর হোসেনের অংশগ্রহণ ছিল সুনিশ্চিত। তাছাড়া দু’দিন ধরে নূর হোসেনের কোনো খবর নেই। বাসায় আসে না। বন্ধু-বান্ধবদের জিজ্ঞেস করলে বলে, ও মিছিল মিটিং নিয়ে ব্যস্ত।

১০ নভেম্বর (বাংলা ২৩ কার্তিক) ফজর নামাজ শেষে নূরের মা-বাবা ছেলের খোঁজে বের হলেন। পরিচিত একজনের কাজ থেকে জানতে পারলেন নূর হোসেন মতিঝিলের নির্মাণাধীন ডিআইটি মসজিদের (বর্তমানে রাজউক মসজিদ) দো-তলায় অবস্থান করছে। দু’জন সেখানে গিয়ে দেখেন নূর হোসেন খালি গায়ে শুয়ে আছে, সঙ্গে তার এক বন্ধু। মা-বাবাকে দেখেই নূর উঠে তড়িঘড়ি করে চাদর দিয়ে গা ঢেকে ফেলেন। কিন্তু মায়ের চোখকে ফাঁকি দিতে পারেননি। বুকে পিঠে লেখা দেখে মায়ের মনে দুশ্চিন্তা শুরু হয়। মা বলেন, চল বাসায় চলে যাই দেশের অবস্থা বেশি ভালো না। নূর হোসেন মানলেন না। বাবা-মাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বললেন, তোমরা যাও আমি বেশিক্ষণ থাকবো না। সেদিন প্রায় ত্রিশ মিনিটের মতো এক সঙ্গে ছিলেন বাবা-মা ও ছেলে। সেটাই শেষ দেখা।

যে স্লোগান বুকে পিঠে লিখে গণতন্ত্রের আন্দোলনে জীবন্ত পোস্টার হয়ে ইতিহাস হয়ে আছেন সেই স্লোগান নূরের গায়ে সাদা রঙ দিয়ে লিখে দিয়েছিলেন তারই বন্ধু মো. ইকরাম হোসেন। লেখার সময় নূর হোসেনকে বলেছিলেন, ‘এভাবে বুকে পিঠে লিখলে পুলিশ যদি তোকে গুলি করে? প্রতি উত্তরে নূর বলেছিলেন, `বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের জন্য প্রায় সারা জীবন জেল খেটেছেন, অনেক কষ্ট সহ্য করেছেন। আমি কেন পারবো না। আমি গণতন্ত্রের জন্য শহীদ হতে প্রস্তুত।'

ওইদিন সকাল ৯টা পর্যন্ত ঢাকা মহানগরীর সর্বত্র জীবন যাত্রা ছিল মোটামুটি স্বাভাবিক। সকাল ৯টার দিকে তোপখানা রোড পুলিশ বক্সের অদূরে সিপিপি অফিসের সামনে কিছু লোক জমায়েত হলে পুলিশ সেখান থেকে প্রায় ২০ জনকে আটক করে। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে থেকে প্রায় দু’শ লোকের মিছিল শুরু হয়ে পুলিশ বক্সের দিকে এগুতে থাকে। এ সময় পুলিশ হাউজ বিল্ডিং ফিন্যান্স কর্পোরেশন ভবনের সামনে লাঠিচার্জ করে। এরপর থেকে মিছিলে লোক সংখ্যা বাড়তে থাকে। তোপখানা রোডের পুলিশ বক্স থেকে গোলাপ শাহ মাজার পর্যন্ত লোক জমায়েত হতে থাকে।

১০টা ৪০ মিনিটের দিকে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা পুলিশ বক্সের কাছে আসেন ও তার পাজেরো জিপে দাঁড়িয়ে হ্যান্ড মাইকে ঘোষণা দেন, `আমরা সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণভাবে আমাদের কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছি। সরকারের পদত্যাগ না হওয়া পর্যন্ত এ আন্দোলন চলবে। তিনি সচিবালয় এবং ব্যাংক বীমা থেকে সকল কর্মচারীকে বের হয়ে আসারও আহ্বান জানান। মিছিলের স্লোগান আরো জোড়ালো হতে থাকলো।

এরশাদ পতনের জন্য সংগঠিত সুবিশাল মিছিলের প্রধান ফোকাস ছিলেন একজন সাধারণ বেবিট্যাক্সি চালক মজিবুর রহমান (কাঞ্চন হাওলাদার) এর দ্বিতীয় ছেলে কালো বর্ণের, লম্বা টগবগে যুবক নূর হোসেন। সেদিন তার চোখে মুখে ছিল যেন আগুনের ফুলকি। বুকে পিঠে লেখা ছিল স্বাধীন বাংলার জনগণের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি। সেদিন মিছিলে গিয়েছিলেন নূর হোসেনের বড় ভাই আলী হোসেনও। মিছিলে সবার আগে ছোট ভাইকে দেখে, তাকে ডেকে বাসায় ফিরে যেতে বললেন। কিন্তু কার কথা কে শোনে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে মরণবাণী ধারণ করে যেন মরতেই এসেছিলেন অকুতোভয় নূর হোসেন।

সেদিনের ঘটনা স্মৃতিচারণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, `সেদিন আমরা যখন মিছিল শুরু করেছিলাম তখন নূর হোসেন আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি তাকে কাছে ডাকলাম এবং বললাম তার গায়ের এই লেখাগুলোর কারণে তাকে পুলিশ গুলি করবে। তখন সে তার মাথা আমার গাড়ির কাছে এনে বললো, `আপা আপনি আমাকে দোয়া করুন, আমি গণতন্ত্র রক্ষায় আমার জীবন দিতে প্রস্তুত।`

পায়ে কেডস জুতা, পরনে জিন্সপ্যান্ট, কোমড়ে বাঁধা শার্ট, উদোম গতর, বুকে পিঠে লেখা অমর বাণী। সত্যিই জনতার মাঝে সেদিন এক অন্য রকম মুখ ছিলেন তিনি। যা সকলের চোখে লক্ষণীয়। যেটি ফাঁকি দিতে পারেননি এরশাদের লেলিয়ে দেয়া পুলিশ বাহিনীর চোখকেও। মিছিলটি যখন গুলিস্তান জিরো পয়েন্টের কাছাকাছি পৌঁছায় ঠিক তখনই শুরু হয় মিছিলের উপর পুলিশের গুলিবর্ষণ। যার একটি গুলি এসে ফুটো করে দেয় নূর হোসেনের বুক।

বায়তুল মোকাররমের মূল গেটের কাছে মুহূর্তের মধ্যে লুটিয়ে পড়েন নূর হোসেন। মরণ যন্ত্রণায় যখন নূর হোসেন ছটফট করছিলেন তখন সুমন নামে এক যুবক তাকে একটি রিকশায় করে হাসপাতালের দিকে যাচ্ছিলেন। নূর হোসেনকে বহনকারী রিকশাটি যখন গুলিস্তানের গোলাপ শাহ মাজারের কাছে পৌঁছায় ঠিক তখনই পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ায় স্বৈরাচারীর পুলিশ বাহিনী। পুলিশের কয়েকটি গাড়ি এসে রিকশাটিকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে। আরো নির্মমতার স্বীকার হন মৃত্যুর সময় গুণতে থাকা নূর হোসেন। গুলিবিদ্ধ নূর হোসেনকে টেনে হিঁচড়ে রিকশা থেকে নামিয়ে পুলিশ গাড়িতে তুলে নেয়। নূর যখন মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল, তখন একজন নিষ্ঠুর পুলিশ সদস্য পায়ের বুট দিয়ে তার বুক চেপে ধরে।

এরপর নূর হোসেনকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরে হয়ত বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে এক সময় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নিতে বাধ্য হন বাংলার এই সাহসী বীর সন্তান। সেদিন নূর হোসেন ছাড়াও নিহত হন যুবলীগের আরেক নেতা নূরুল হুদা বাবুল ও কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের ক্ষেতমজুর নেতা আমিনুল হুদা (টিটো)।

শহীদ হওয়ার পর নূর হোসেনের পরিবার :
১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর বেলা ১১টার দিকে লোকমুখে গুঞ্জন ওঠে বুকে পিঠে লেখা যুবলীগ কর্মী পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন। এ সব উড়ন্ত খবর নূর হোসেনের পরিবারের সবাইকে অস্থির করে তোলে।

এ বিষয়ে নূর হোসেনের মামা কালা চাঁদ মিয়া বলেন, `চারদিকে যখন খবর ওঠে নূর হোসেনের গায়ে পুলিশের গুলি লাগছে তখনই নূরের বাপে, তার বড় ভাই আলী হোসেন আর আমি পাগলের মতো ছোটাছুটি করতে থাকি। খুঁজতে থাকি নূর হোসেনকে। কিন্তু কোথাও তার খোঁজ মেলেনি। সকলের চোখমুখে তখন ছিল শুধু আতঙ্কের ছায়া। একেকজনের মুখে একেক রকম কথা। চারদিকে রব উঠছে কাপ্তান বাজারের দিকে কেউ যেতে পারছে না। চারদিকে শুধু পুলিশ আর পুলিশ।

সন্ধ্যা ৭টার দিকে হঠাৎ আলী হোসেন আমারে বলে, মামা আমার মন বলছে নূর হোসেন আর নাই। সে সত্যি সত্যিই মারা গেছে। আমি তখন তার মুখের দিকে চেয়ে কোনো কথা বলতে পারিনি। সাড়ে ৭টার দিকে পাশের বাসার মোখলেস নামে একটি ছেলে রেডিওতে বিবিসির খবর শুনে দৌঁড়ে এসে বলে, কই আপনারা? রেডিওতে নূর হোসেনের খবর বলতেছে। কয়েকবার পড়া হয় সেই খবরটি। তখন আমরা নিজ কানে শুনি আসলেই নূর হোসেন আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। তখনই কান্নার রোল পড়ে বনগ্রামের এ বাড়িতে।

তারপরও খুঁজতে লাগলাম নূর হোসেনের লাশ। রাত ১২টার দিকে কিনা ঠিক মনে নাই, খবর পেলাম পুলিশের গুলিতে নিহত তিনটি লাশ পরের দিন সকালে যার যার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। সকালে লাশের খোঁজে যাই শাহবাগ কন্ট্রোল রুমে। তখন সেখানকার একজন এসপির সঙ্গে নূর হোসেনের বাবার কথা হয়। এসপি বলেন, দেখেন আমাদের যদি ক্ষমতা থাকতো তাহলে আমরা দিয়ে দিতাম। এটা আমাদের আওতার বাইরে। ঘোরাঘুরি না করে বরং চলে যান। সেখান থেকে হতাশ হয়ে আমরা ফিরে এলাম।

পরে পত্রিকায় খবর পেলাম জুরাইনের কবরস্থানে তার কবর হয়েছে। এ খবর শুনে ১৩ নভেম্বর ছুটে যায় জুরাইনে। কিন্তু কবর শনাক্ত করতে পারিনি। তবে সেদিন কবর খোদকরা বলেন, তিনজনের মধ্যে একজন ছিল সুদর্শন, ফর্সা, মোটাসোটা। তার গলায়, হাতে ও আঙ্গুলে চেইন ঘড়ি ও আংটির দাগ ছিল। অপর ব্যক্তির মুখে দাঁড়ি, পায়ে কেডস জুতা, পরনে প্যান্ট, উদোম গতর, বুকে পিঠে কী যেন লেখা ছিল। তৃতীয় ব্যক্তির পরনে ছিল চেক লুঙ্গি। তখন আন্দাজ করতে পারি কোনটা নূর হোসেনের কবর।

তিনি আরো বলেন, সেদিন নূরের বাবা কবর খুঁড়তে চেয়েছিলেন কিন্তু পারেননি। পরিবারের সকলে কান্নাকাটি করেও কোনো লাভ হয়নি। পরে শনাক্ত করা হয় পূর্ব কোণের দেয়ালের পাশের কবরটিই শহীদ নূর হোসেনের।

পুত্র বিয়োগের শোক বুকে চেপে মজিবুর রহমান রোদ-বৃষ্টি, কুয়াশা উপেক্ষা করে ঢাকার রাস্তায় বেবিট্যাক্সি চালিয়ে কোনো রকম সংসারের খরচ যোগাড় করেন। তখনও তাকে দৈনিক জমা দিতে হতো ১৫০ টাকা। তেল, স্ট্যান্ড পার্কিং ও খাওয়া খরচ বাদে সারাদিন শেষে হাতে অবশিষ্ট থাকত ৬০ থেকে ৭০ টাকা। এই রোজগার বেশি হলে ১০০ টাকা হতো। অসুস্থ শরীর নিয়ে যেদিন বেবিট্যাক্সি চালাতে পারতেন না সেদিন চলতে হতো কষ্ট করে। কেননা নূর হোসেনের বাড়তি টাকা আর সংসার খরচে যোগ হচ্ছে না। বড় ছেলে আলী হোসেনও কখনো কাজ পাচ্ছেন আবার কখনো বেকার হয়ে পড়ছে। তাছাড়া অন্যরাও বেশ ছোট। তখন পুরো খরচ বহনের ভার পড়তো সেই বৃদ্ধ মজিবুর রহমানের ঘাড়েই।

নব্বই এর দশকে এসে মজিবুর রহমান শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। তিনি তখন আর আগের মতো পরিশ্রম করতে পারতেন না। তখন তার বড় ছেলে আলী হোসেনের জন্য প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান একটি চাকরির ব্যবস্থা করেছিলেন। পরে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার নিজস্ব গাড়িচালক হিসেবে নিয়োগ পান। বর্তমানেও তিনি এ দায়িত্বে আছেন। তাছাড়া তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ আওয়ামী মোটরচালক লীগের সভাপতি।

১৯৯৬ সালে এরশাদ জেল থেকে ছাড়া পেয়ে নূর হোসেনের পরিবারের সঙ্গে দেখা করে তাদের খরচের জন্য মাসিক পাঁচ হাজার টাকা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও মজিবুর রহমান এক সভায় এরশাদকে স্বৈরাচার বলায় টাকা দেয়া বন্ধ করে দেয়া হয়। শেখ হাসিনা (১৯৯৬-২০০১) প্রধানমন্ত্রী হলে নূর হোসেনের পরিবার ১৯৯৭ সালে সরকারের কাছ থেকে মিরপুর মাজার রোডে পাঁচ কাঠা পরিমাণ একটি জমি পায়। পরে ১৯৯৮ সালে কোন রকমে টিনশেড বাসা তৈরি করে নূর হোসেনের পরিবারের সবাই বনগ্রাম রোডের বাসা ছেড়ে এই বাসায় এসে ওঠেন।

বর্তমানে নূর হোসেনের পরিবারে কিছুটা স্বচ্ছলতা ফিরে এসেছে। তার বড় ভাই আলী হোসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত গাড়িচালক, ছোট ভাই দেলোয়ার হোসেন ও আনোয়ার হোসেন ব্যবসা করেন, বোন সাহানার স্বামী মো. আজগর আলীও ছোট খাটো ব্যবসা করেন। অভাবের কারণে তারা বেশি পড়ালেখা না করতে পারলেও তাদের ছেলে-মেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে।

মজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর ২০০৭ সালে মিরপুর মাজার রোডের জায়গাটি দেয়া হয় ক্যাসেরো ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টস লি. নামে একটি আবাসন নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানকে। সেখানে ক্যাসেরো শহীদ নূর হোসেন টাওয়ার নামে ১৩তলা একটি ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। কিন্তু তিন বছরের মধ্যে ভবনটির দায়িত্বভার দেয়ার কথা থাকলেও প্রায় দশ বছর পার হওয়ার পর মাত্র তিনতলার ছাদ ঢালাই করা হয়। এটি নিয়ে বেশ বিপাকে পড়েছেন তারা। সবাইকে এখন থাকতে হচ্ছে ভাড়া বাসায়।

তার স্মৃতিতে গড়ে ওঠা স্থাপনা ও সম্মাননা :
শহীদ নূর হোসেনের স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে তার আত্মত্যাগকে শ্রদ্ধা জানিয়ে গণতান্ত্রিক সরকারের আমল থেকে নূর হোসেনের মৃত্যুর দিনটিকে সরকারিভাবে প্রথমে ঐতিহাসিক ১০ নভেম্বর দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরে আওয়ামী লীগের সমর্থনে ১০ নভেম্বরকে শহীদ নূর হোসেন দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ১৯৯৬ সালে এরশাদ নূর হোসেনের মৃত্যুর জন্য জাতীয় সংসদে অফিসিয়ালভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং তার দল জাতীয় পার্টি ১০ নভেম্বরকে গণতন্ত্র দিবস হিসেবে পালন করে।

তার স্মৃতিতে গড়ে ওঠা স্মারক ও স্থাপনার বিবরণ এই-যে স্থানে পুলিশের গুলিতে নিহত হন, তার নামানুসারে সেই গুলিস্থানের জিরো পয়েন্টের নামকরণ করা হয় নূর হোসেন চত্বর। ১৯৯১ সালে তার চতুর্থ মৃত্যুবাষির্কী উপলক্ষে দুই টাকা মূল্যের স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া তার কার্যালয়ে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে তা অবমুক্ত করেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ নূর হোসেনের একটি মুরাল রয়েছে। `স্বাধীনতা সংগ্রাম ভাস্কর্য` চত্বরে বিভিন্ন শহীদ, জাতীয় বীর, জগৎ বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী, কবি-সাহিত্যিকদের ভাস্কর্যের সঙ্গে স্থান পায় শহীদ নূর হোসেনের ভাস্কর্য। এর শিল্পী ভাস্কর শামীম সিকদার। ভাস্কর্যটির উচ্চতা ১০ ফুট, দৈর্ঘ্য ৫ ফুট এবং প্রস্থ ৫ ফুট।

নুর হোসেনের বুকে ও পিঠে লেখা স্লোগানটি সারাদেশের জনতার স্লোগানে পরিণত হয়। ফলে সেই সংগ্রামের ধারায় ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর স্বৈরাচারী শাসক পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এর মধ্যে দিয়ে স্বৈরাচার সরকারের পতন ঘটে এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় ।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.