Sylhet Today 24 PRINT

অবহেলায় সিলেটের ঐতিহ্যের স্থাপনাগুলো, সংরক্ষণে নেই উদ্যোগ

আজ বিশ্ব ঐতিহ্য দিবস

শাকিলা ববি |  ১৮ এপ্রিল, ২০২১

প্রাচীন জনপদের শহর সিলেট। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত পাহাড়ি, সমতল ও হাওর ঘেরা একটি অঞ্চল। বাংলাদেশের বিশাল অংশ যখন সাগরের গর্ভে বিলীন, সিলেট তখনও ছিল সভ্য সমাজ। সিলেটের ভাটি এলাকা এক সময় ছিল সমুদ্র। কিন্তু উঁচু ও পার্বত্য এলাকায় ছিল জনবসতি। ইতিহাসের প্রাচীন যুগ থেকে সিলেট জনবসতি শুরুর হদিস পাওয়া যায়।

প্রাচীন যুগের ইতিহাসের অবলম্বন প্রায় সর্বত্রই পৌরাণিক গ্রন্থাদি, কিংবদন্তি, শিলালিপি প্রভৃতি। এসব উৎস হতে দেখা যায়, খৃষ্টপূর্ব চার হাজার অব্দেও সিলেটে উন্নত সমাজ বর্তমান ছিল। প্রাচীন এই শহরে এখনো বিদ্যমান আছে অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন। ইতিহাস ঐতিহ্যে ভরপুর সিলেটকে আজও বলা যায় ঐতিহ্যের শহর।  

তবে সিলেটের ঐতিহ্যের স্থাপনা ও নির্দশনগুলো সুরক্ষায় নেই যথাযথ উদ্যোগ। ফলে এর অনেকগুলোই এখন ধ্বংসপ্রায়। অবহেলায়-অযন্তে কোনোরকমে টিকে আছে বাকিগুলো।  

আজ (১৮ এপ্রিল) বিশ্ব ঐতিহ্য দিবস। ‘ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল ফর মনুমেন্টস অ্যান্ড সাইটস (ICOMOS)’ ১৯৮২ সালে তিউনিসিয়ায় একটি আলোচনা সভায় ১৮ এপ্রিলকে ‘ইন্টারন্যাশনাল ডে ফর মনুমেন্টস অ্যান্ড সাইটস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৮৩ সালে দিনটি ‘বিশ্ব ঐতিহ্য দিবস’ হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পায়।

সিলেটের ঐতিহ্য কথা বললে যে নামটি সর্বপ্রথম আসে তা হল হযরত শাহজালাল (র.) মাজার। ক্রমান্বয়ে সিলেটের ইতিহাস ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছে আরও অনেক গুণীজন ও স্থাপনা। সিলেটের ঐতিহ্যে জড়িয়ে আছে মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্যদেবের বাড়ি, কিনব্রিজ, আলী আমজাদের ঘড়ি, মনিপুরী রাজবাড়ি, সিলেটী নাগরী লিপি, শাহী ঈদগাহ ও জিতু মিয়ার বাড়ি।    

হযরত শাহজালাল (র.) মাজার
ওলিকুল শিরোমণি হযরত শাহজালাল (র.) ছিলেন উপমহাদেশের একজন বিখ্যাত দরবেশ ও পীর। সিলেট অঞ্চলে তার মাধ্যমেই ইসলামের প্রসার ঘটে। ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি সিলেটে আগমন করেন।  সিলেটের প্রথম মুসলমান শেখ বোরহান উদ্দিনের (র.) ওপর রাজা গৌড়গোবিন্দের অত্যাচার এবং এর প্রেক্ষিতে হযরত শাহজালাল (র.) ও তার সফরসঙ্গী ৩৬০ আউলিয়ার সিলেট আগমন ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এ কারণে সিলেটকে ৩৬০ আউলিয়ার দেশও বলা হয়। আরব দেশের মাটি ও সিলেটের মাটির মিল কথিত আছে। প্রাচ্যদেশে আসার আগে শাহজালাল (র.) এর মামা মুর্শিদ সৈয়দ আহমদ কবীর (র.) তাকে এক মুঠো মাটি দিয়ে বলেছিলেন, ‘স্বাদে বর্ণে গন্ধে এই মাটির মতো মাটি যেখানে পাবে সেখানে বসতি স্থাপন করে ইসলাম প্রচার করবে।’ হযরত শাহজালাল (র.) অন্যতম শিষ শেখ আলীকে এই মাটির দায়িত্বে নিয়োগ করেন এবং নির্দেশ দেন যে, যাত্রাপথে বিভিন্ন জনপদের মাটির সাথে যেন এই জনপদের মাটির তুলনা করে তিনি দেখেন। পরে এই শিষের উপাধি হয় চাষণী পীর। সিলেট শহরের গোয়াইপাড়ায় তার মাজার বিদ্যমান। সিলেটের মাটির সাথে আরবের মাটির মিল পাওয়ায় হযরত শাহজালাল (র.) সিলেটে বসতি স্থাপন করে ইসলাম প্রচারে মনোনিবেশ করেন। সিলেটে তেল ও গ্যাস পাওয়ায় আরবের মাটি ও সিলেটের মাটির মিল প্রমাণিত হয়েছে বলে মনে করে ইতিহাসবিদরা। তিনি ১৩৪০ খ্রিস্টাব্দে ৬৯ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তিনি ছিলেন চিরকুমার। এজন্যই হযরত শাহজালালকে (র.) বলা হতো মজররদ।

শ্রী চৈতন্য দেবের বাড়ি
উপমহাদেশের বৈষ্ণবধর্মের প্রবর্তক শ্রী চৈতন্য দেবের পৈতৃক বাড়ি সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার ঢাকা দক্ষিণ ইউনিয়নের মিশ্রপাড়া গ্রামে। পঞ্চদশ শতাব্দীতে শ্রীচৈতন্য ছিলেন বাংলার একজন শ্রেষ্ঠ সংস্কারক। তিনি ২৫ বছর বয়সে গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসী হন। জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদ করেন। শ্রীকৃষ্ণের মানবিগ্রহ হিসেবে লাখ লাখ লোকের দ্বারা তিনি পূজিত হন। বাংলার ঘরে ঘরে তার নাম প্রচার হয়। জাতিধর্ম নির্বিশেষে সব শ্রেণির লোককে তিনি ভাইয়ের মতো আলিঙ্গন করে গেছেন। তার কিছু কিছু শ্লোক মন্দিরের গায়ে লেখা হয়েছে। অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে তৎকালীন সিলেটের দেওয়ান গোলাব রামের উদ্যোগে এখানে মন্দির নির্মিত হয়। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের এক ঐতিহাসিক তীর্থস্থান হিসাবে প্রতিবছর এ মন্দিরে হাজার হাজার পর্যটক যাতায়াত করেন।

তেরো ধাপ সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলে মন্দিরপ্রাঙ্গণ। প্রথমেই সিংহদ্বার। বামদিকে পাশাপাশি পাঁচটি ছোট মন্দির। এগুলোর নাম হল- নাট মন্দির, দোল মন্দির, রাম মন্দির, শ্রীমন্দির আর ভোগ মন্দির। এখানে দোল মন্দিরই মূল মন্দির। কথিত আছে একবার ঠাকুরমাকে দেখার জন্য চৈত্র মাসের কোনো এক রোববারে শ্রী শ্রী চৈতন্য দেব ও তার বৈষ্ণবসঙ্গীদের নিয়ে নগর সংর্কীতন করতে করতে ঢাকা দক্ষিণ এসেছিলেন। কিন্তু সেই রোববার চৈত্রের কত তারিখ ছিল তার সঠিক তথ্য না পাওয়ার কারণে তার ভক্তরা মহাপ্রভুর আগমনকে উদযাপন করতে চৈত্র মাসের প্রতি রোববার আয়োজন করা হত সংকীর্তন ও উৎসবের। এরপর থেকেই এই উপলক্ষে এখানে মেলা ও ধর্মীয় উৎসব অনুষ্ঠিত হয় । ৮৯১ বঙ্গাব্দের ২৩শে ফাল্গুন দোলপূর্ণিমার দিন চন্দ্র গ্রহণারম্ভের পূর্বে সন্ধ্যালগ্নে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর আবির্ভাব ঘটে। প্রথমে নাম রাখা হলো বিশ্বম্ভর। কিন্তু তার মা ডাকতেন ‘নিমাই’ বলে। একসময়ে গৃহত্যাগ করে তিনি সন্ন্যাসী হন।

কিনব্রিজ
সিলেটের প্রবেশদ্বার কিনব্রিজ। সিলেট শহরের কেন্দ্রস্থলে এই কিনব্রিজ এলাকা। সিলেটের ইতিহাস ঐতিহ্যকে জানান দেয় সুরমা নদীর বুকে দাঁড়িয়ে থাকা এই ব্রিজ ।

১৯৩৩ সালে নির্মিত হয় ১ হাজার ১৫০ ফুট দৈর্ঘ্যের ও ১৮ ফুট প্রস্থের কিনব্রিজ। এটি চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয় ১৯৩৬ সালে। ভারতের আসাম প্রদেশের তৎকালীন গভর্নর মাইকেল কিনের নামেই কিনব্রিজ হিসেবে নামকরণ করা হয়। লোহা দিয়ে তৈরি কিনব্রিজের আকৃতি অনেকটা ধনুকের মতো বাঁকানো। এর দৈর্ঘ্য ১,১৫০ ফুট এবং প্রস্থ ১৮ ফুট। প্রায় আট দশক ধরে সচল সেতুটি মুক্তিযুদ্ধের সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সংস্কারকাজ শেষে আবারও সচল হয় সেতুটি। নব্বই দশকের পর সিলেটে সুরমা নদীর ওপর আরও চারটি সেতু নির্মাণ করা হয়। কিনব্রিজ নগরের মধ্যভাগে হওয়ায় যানবাহন চলাচল কখনো বন্ধ হয়নি। ব্রিজটি দেখার জন্য ও এই ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার জন্য সিলেটে আগত পর্যটক ভিড় জমান।

আলী আমজদের ঘড়িঘর
কিনব্রিজের উত্তরপাড়ে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা আলী আমজদের ঘড়িঘর। কিনব্রিজ হয়ে নগরের প্রবেশমুখ সুরমা নদীর চাঁদনি ঘাট এলাকায় এটি অবস্থিত। ১৮৭৪ সালে মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়ার পৃথিম পাশার জমিদার নবাব আলী আহমদ খানের উদ্যোগে ঘড়িটি স্থাপন করা হয়। ঘড়িটি আড়াই ফুট ডায়ামিটারের। এর কাঁটা দুই ফুট লম্বা। লোহার খুঁটির ওপর ঢেউটিন দিয়ে আবৃত সুউচ্চ গম্বুজ আকৃতির ঘড়িটি সিলেটের ঐতিহ্য। নবাব আলী আহমদ ঘড়িটি স্থাপন করলেও এটি পরিচিতি পায় তার ছেলে আলী আমজাদের নামে। জানা যায়, ১৮৭৪ সালে সিলেট জেলা আসাম প্রদেশের সাথে একত্রীভুক্ত হয়। তখন এই নিয়ে সিলেটে তীব্র প্রতিবাদ হয়। সিলেটের জনগণকে শান্ত করার জন্য তৎকালীন বড়লাট লর্ড নর্থ ব্রম্নক সিলেট সফর করেন এবং বড়লাটের সফর উপলক্ষে এবং স্থানীয় জনসাধারণের সুবিধার্থে জমিদার আলী আহমদ খানের নিজ তহবিল হতে এই ঘড়িটি নির্মাণ করা হয়।

মনিপুরী রাজবাড়ি
ঊনবিংশ শতাব্দীতে সিলেট নগরীর মির্জাজাঙ্গালে এলাকায় মনিপুরী রাজবাড়িটি স্থাপিত হয়। এই রাজবাড়ি প্রাচীন স্থাপত্য কীর্তির অন্যতম নিদর্শন। এ ভবনের নির্মাণ শৈলী সিলেট অঞ্চলের কৃষ্টি-সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এই রাজবাড়িটি আজ অবহেলিত ও বিলীন প্রায়। তৎকালীন মনিপুরী রাজ্যের তিন সহোদর রাজা চৌর্জিৎ সিং, মার্জিত সিং ও গম্ভীর সিং রাজবাড়িটি তৈরি করে এখানে বসবাস করেন। পরে চৌর্জিৎ সিং ও মার্জিত সিং কমলগঞ্জের ভানুগাছ এলাকায় বসতী স্থাপন করলেও রাজা গম্ভীর সিং থেকে যান মির্জাজাঙ্গালের রাজবাড়িতে। ১৮২৬ সালে ব্রিটিশ সরকারের সহযোগিতায় বার্মার সাথে যুদ্ধ করে মনিপুর রাজ্য পুনরুদ্ধারের আগ পর্যন্ত রাজা গম্ভীর সিং সপরিবারে এখানেই অবস্থান করেন। মনিপুরী সম্প্রদায়ের ইতিহাস-আবেগ-অনুভূতির অন্যতম স্থান মির্জাজাঙ্গালের রাজবাড়ির সংস্কারের জন্য আজ অবধি কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। রাজাকতৃক নির্মিত প্রাসাদের তিন চতুর্থাংশের কোন অস্তিত্ব নেই। উপরন্তু রাজবাড়ির সামনে অপরিকল্পিত ভাবে মন্দির নির্মাণ করে রাজবাড়ির পুরাকীর্তি ঢেকে রাখা হয়েছে। বর্তমানে মনিপুরী ঠাকুর ও ব্রাহ্মণ পরিবারের লোকজন বংশ পরম্পরায় বসবাস করছেন এ রাজবাড়িতে। পূর্বসূরি রাজার রেখে যাওয়া নানা বস্তুকে সোনালী স্মৃতি হিসেবে ধারণ করে আছে পরিবারগুলো। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- একমন ওজনের মন্দিরের একটি ঘণ্টা। যার গায়ে মনিপুরী ভাষায় লেখা আছে,‘‘শ্রীহট্ট কুনোঙ্গী শ্রী মহাপ্রভুদা শ্রীলশ্রী পঞ্চযুক্ত মনিপুরে স্বরচন্দ কীর্তি সিংহ মহারাজন্য কৎখিবী সরিকনি ইতিশকাব্দা ১৮০০ তারিখ ১৮ জ্যৈষ্ঠ’’। মনিপুরী সংস্কৃতি সিলেটের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যেরই অংশ । দেশীয় ঐতিহ্য রক্ষার্থে এই সুপ্রাচীন, ঐতিহাসিক রাজবাড়ির সংস্কার ও পুরাকীর্তির সংরক্ষণে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

সিলেটী নাগরী লিপি
সিলেটের আঞ্চলিক বা কথ্য ভাষার বিজ্ঞান সম্মত লিপি মালা হচ্ছে সিলেটী নাগরী লিপি। সিলেটের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্যতম দলিল এই নাগরী লিপি। নাগরীর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে-এটি সিলেট অঞ্চলের মুসলমানদের একান্ত নিজস্ব সম্পদ। নাগরী লিপিতে রচিত পুঁথি পুস্তকের বিষয়বস্তু ছিল মূলত নামায, রোজা, হজ্ব, যাকাত, ইসলামী ইতিহাস, ঐতিহ্য, কাহিনী এবং রাগ, বাউল ও মরমী সঙ্গীত নিয়ে। এ পর্যন্ত ৮৮টি মুদ্রিত গ্রন্থসহ(নাগরী হরফে) ১৪০টি গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া গেছে। ‘সিলেটী নাগরী লিপি ভাষা ও সাহিত্য’ সম্পর্কে গবেষণা করে গোলাম কাদির ১৯৮৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। নাগরী সাহিত্যে ছাদেক আলী সর্বাধিক জনপ্রিয় কবি। তিনি ১৭৯৮ সালে কুলাউড়ায় জন্ম গ্রহণ করেন। ইসলাম ধর্ম গ্রহণের আগে তার নাম ছিল গৌর কিশোর সেন। ১৮২৩ সালে তিনি মৌলভীবাজারের মুনসেফ ছিলেন। নাগরী পুঁথি রচয়িতাদের মধ্যে এ পর্যন্ত মুন্সী ইরপান আলী, দৈখুরা মুন্সী, আব্দুল ওহাব চৌধুরী, আমান উল্যা, ওয়াজি উল্যা, শাহ হরমুজ আলী, হাজী ইয়াছিনসহ ৫৬ জনের পরিচিতি পাওয়া গেছে। গোলাম হুসনের লিখিত ‘তালিব হুসন'কে প্রথম গ্রন্থ রূপে ধরে নেওয়া হয়। ড: সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় খৃষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীকে নাগরী লিপির প্রচলন কাল বলে মত প্রকাশ করেন। আবার কেউ কেউ মনে করেন ষোড়শ শতাব্দীর শেষ দিকে মোঘলদের দ্বারা তাড়িত হয়ে সিলেটে আগত আফগান পাঠানরা এর সৃষ্টি করেন। এ ব্যাপারে আরেকটি মত চালু রয়েছে। সেটি হল- ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ সৃষ্ট সংস্কৃত বহুল বাংলার বিকল্প রূপে সিলেটীরা এই লিপি ও সাহিত্যের জন্ম দেন।নাগরী লিপিতে সাহিত্য সৃষ্টির অনেক পর এর মুদ্রণ শুরু হয়। টাইপ ও ছাপা খানার অভাবে হাতে লিখেই নাগরীর প্রসার ঘটে। এ সময় সিলেট শহরের হাওয়াপাড়া নিবাসী মৌলভী আব্দুল করিম ইউরোপ সফর শেষে দেশে ফেরেন। নাগরী লিপির টাইপ তৈরি করে চালু করেন ছাপা খানা। বন্দর বাজারে স্থাপিত ঐ প্রেসের নাম ছিল ইসলামিয়া প্রেস। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রেসটি বোমায় পুড়ে যায়। সিলেট শহরের নাইওরপুলে ছিল সারদা প্রিন্টিং পাবলিশিং। ১৯৪৭ পূর্ববর্তীকালে কলকাতা ও শিয়ালদহেও নাগরী লিপির প্রেস ছিল। বৃহত্তর সিলেট, কাছাড়, করিমগঞ্জ, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ প্রভৃতি এলাকায় নাগরী লিপি ও সাহিত্যের প্রচার ও সমাদর ছিল। নাগরীর অক্ষর মাত্র ৩২টি। যুক্ত বর্ণ সাধারণত ব্যবহৃত হয় না। মাত্র আড়াই দিনে শেখা যায়। তাই মহিলাদের মধ্যে নাগরীর প্রচার ও প্রসার ছিল বেশী। বর্তমানে নাগরী লিপির চর্চা কম হলেও তা একেবারে হারিয়ে যায়নি।

শাহী ঈদগাহ
সিলেটের শাহী ঈদগাহ। ভারতের অহিংস আন্দোলনের নেতা মহাত্মা গান্ধী থেকে শুরু করে কায়দে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, মাওলানা মোহাম্মদ আলী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হকের মতো নেতাদের পদস্পর্শে ধন্য স্থানটি। ১৭৮২ খ্রিষ্টাব্দে এখানেই হাদা মিয়া ও মাদা মিয়া ভ্রাতৃদ্বয়ের নেতৃত্বে ইংরেজ বিরোধী অভ্যুত্থান হয়েছে। অতীতে সিলেটের বড় বড় সমাবেশের স্থানও ছিল এটি। আর প্রতি বছর ঈদ জামায়াতে লোক সমাগমের বিষয়টি তো বলাই বাহুল্য। দেশের প্রাচীনতম এই ঈদগাহটি নজরকাড়া কারুকার্যময়। ঈদগাহর প্রাকৃতিক দৃশ্য খুবই মনোরম। এই ঈদগাহ মোগল ফৌজদার ফরহাদ খাঁ নির্মাণ করেন। এখানে এক সাথে প্রায় দেড় লাখ মুসল্লি ঈদের জামাত আদায় করতে পারেন। সিলেট নগরীর শাহী ঈদগাহ এলাকায় এর অবস্থান। দৃষ্টিনন্দন কারুকার্যখচিত এই ঈদগাহের মূল ভূখণ্ডে ২২টি সিঁড়ি মাড়িয়ে উপরে উঠতে হয়। এরপরই ১৫টি গম্বুজ সজ্জিত ঈদগাহ। সীমানা প্রাচীরের চারদিকে রয়েছে-ছোট বড় ১০টি গেইট। ঈদগাহের সামনে অজুর জন্য বিশাল পুকুর রয়েছে।


জিতু মিয়ার বাড়ি

চাঁদনী ঘাটের সিঁড়ি, আলী আমজাদের ঘড়ি, বন্ধু বাবুর দাড়ি, আর জিতু মিয়ার বাড়ি সিলেটের পরিচিতিতে বহুল প্রচলিত এই লোকগাথা। চুন সুরকি দিয়ে নির্মিত মুসলিম স্থাপত্য কলার অনন্য নিদর্শন এই জিতু মিয়ার বাড়ি। সিলেট নগরীর শেখঘাটে কাজীর বাজারের দক্ষিণ সড়কের পাশে ১ দশমিক ৩৬৫ একর ভূমি জুড়ে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী এই বাড়িটি নির্মাণ করেন খান বাহাদুর আবু নছর মোহাম্মদ এহিয়া ওরফে জিতু মিয়া। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে বাড়িটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে বর্তমানে জায়গায় বাড়িটি স্থানান্তরিত হয়। খাঁন বাহাদুর জিতু মিয়ার প্রথম স্ত্রী ছিলেন তার চাচা মাওলানা আব্দুল রহমানের মেয়ে সারা খাতুন। সারা খাতুনের অকাল মৃত্যুতে ঢাকার নবাব পরিবারের খাজা রসুল বক্সের মেয়েকে তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন। এ স্ত্রীও অকালে মৃত্যুবরণ করেন। তাদের ঘরে কোনো সন্তানাদি ছিল না। তবে পরবর্তীতে জিতু মিয়ার ৫টি বিয়ে করেছিলেন বলে জানা যায়। সে সব স্ত্রীর ঘরে তার বহু সন্তান সন্ততি রয়েছে। কিন্তু দূরদর্শী জিতু মিয়া তার জমিদারি ও বিশেষ করে আলীশান বাড়িটির অস্তিত্ব চিরদিন অক্ষত রাখার লক্ষ্যে মৃত্যুর আগে ১৯২৪ সালে নিজেকে নিঃসন্তান উল্লেখ করে তৎকালীন আসাম সরকারের অনুমোদন নিয়ে তার যাবতীয় সম্পত্তি ওয়াকফ করেন। কে বি এহিয়া ওয়াকফ এস্টেট নামে এস্টেট এর মোতাওয়াল্লি নিযুক্ত হন তৎকালীন জেলা প্রশাসক। পরবর্তীতে সিলেট বিভাগে উন্নীত হলে বিভাগীয় কমিশনার পদাধিকার বলে এ এস্টেটের মোতাওয়াল্লি নিযুক্ত হন। ইতিহাস থেকে জানা গেছে, মৌলভী আবু নছর মোহাম্মদ ইদ্রিছ কাজী হয়ে সিলেট আসেন নবাবী আমলে। সুরমা নদীর তীরে তার বিচারালয়কে কেন্দ্র করে তৎকালীন সময়ে গড়ে উঠে একটি গঞ্জ। লোকজন একে খানবাহাদুর গঞ্জ বাজার বলে ডাকতো। তার মৃত্যু পর তার পুত্র মাওলানা আবু মোহাম্মদ আবদুর কাদির ও মাওলানা আবুল হোসাইন মোহাম্মদ আব্দুর রহমান তাদের বিশাল জায়গীরকে কেন্দ্র করে জমিদারি এস্টেট গড়ে তোলেন।

সিলেটের ইতিহাস ঐতিহ্যের ব্যাপারে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সভাপতি ও প্রবীণ ব্যক্তিত্ব ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, একটি শহর, একটি দেশ, একটি জাতি কতটুকু সমৃদ্ধ ও সুসংগঠিত তা বুঝা যায় তাদের ঐতিহাসিক স্থাপনা, বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের ইতিহাস থেকে। এ হিসেবে সিলেটকে ঐতিহ্যের নগরী বলা চলে। কি নেই সিলেটে। নিজস্ব লিপি, জমিদারদের জমিদারি, রাজা বাদশাদের রাজবাড়ি সবই আছে। কিন্তু এসব ঐতিহাসিক স্থাপনা, নিদর্শন সংরক্ষণে নেই যথাযথ উদ্যোগ। এইসব সংরক্ষণ না করলে আগামী প্রজন্ম সিলেটের গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস জানতে পারবে না। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের উচিত পুরো সিলেট বিভাগকে নিয়ে আলাদাভাবে চিন্তা করা। কারণ শুধু সিলেট নগরীতে নয়, সারা সিলেট বিভাগে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ইতিহাসের ঐতিহাসিক নিদর্শন। এ ব্যাপারে সরকারকেও আরও দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.