Sylhet Today 24 PRINT

‘ভাইয়ের মতো আমিও কিছুটা হিমু’

আহসান হাবীব |  ১৩ নভেম্বর, ২০১৫

আমার বেড়ে ওঠার পুরোটা সময় অতিবাহিত হয়েছে বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদকে ঘিরে। তার স্মৃতিই আমার স্মৃতি, তার দেখাই আমার দেখা। যে কারণে আমি যদি আমার ছেলেবেলা নিয়ে লিখি, সেটা হয়ে যাবে তার ছেলেবেলা। আমি যদি আমার প্রথম জীবনের গল্প সাজাই, তাহলে সেই গল্পের ভিত তাকে কেন্দ্র করেই এগোবে। তার সঙ্গে রয়েছে আমার অসংখ্য স্মৃতি। এর মধ্যে একটি ঘটনা এখনো তাকে নিয়ে আমার ভেতর ভাবনার সৃষ্টি করে।

আমাদের শৈশবের একটা সময় কেটেছে বগুড়ায়। হুমায়ূন আহমেদ তখন দশম শ্রেণীতে আর আমি সম্ভবত ওয়ানে পড়ি। ছোটবেলাতেই বুঝে গিয়েছিলাম তার মধ্যে পাগলামি আছে। একদিন তিনি হুট করে বললেন, ‘চল সাইকেল চালিয়ে কোথাও ঘুরে আসি।’ এর পর আমাকে সাইকেলের পেছনে বসিয়ে মহাস্থানগড়ের কাছাকাছি নিয়ে গেলেন। এ সময় হঠাত্ই আমার পা সাইকেলের চাকায় আটকে গিয়ে অঝোর ধারায় রক্ত পড়তে থাকে। অন্যরা হলে হয়তো এমন পরিস্থিতিতে বাসায় চলে যেত। কিন্তু তার ভেতর এমন কিছুই দেখলাম না। উল্টো ধমক দিয়ে বললেন, ‘খবরদার, কাঁদবি না। পায়ের দিকে তাকাবি না।’ তার পর সাইকেলে করেই দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে চিকিত্সা করিয়ে বাসায় নিয়ে আসেন।

এর পর কেটে গেছে অনেকটা সময়। তত দিনে আমরা অনেক বড় হয়ে গিয়েছি, কাজের চাপে সবাই ব্যস্ত। একদিন হুট করেই ভাই আমাকে ফোন দিয়ে বললেন, ‘এক্ষুণি তোর পাসপোর্টটা পাঠিয়ে দে।’ বললাম, ‘কেন?’ বললেন, ‘আমেরিকা যাচ্ছি, তোকে সঙ্গে নিয়ে যাব।’ হঠাত্ করে তার এ আবদার শুনে বিপদে পড়ে গেলাম। ভাবলাম, প্রস্তুতি ছাড়া এখন কীভাবে অত দূর যাই।’ এমন পরিস্থিতিতে তাকে মিথ্যা কথা বললাম, ‘পাসপোর্ট খুঁজে পাচ্ছি না, হারিয়ে গেছে।’ তখন রেগে বললেন, ‘পাসপোর্ট হারিয়ে গেছে, মানে কি! এটা হারানোর জিনিস নাকি?’ এর পর তিনিও তার যাত্রা বাতিল করেছেন।

জীবনভরই যে হুমায়ূন আহমেদ আমাকে সেই শিশুই ভাবতেন, সেটার আরেকটা উদাহরণ আছে। আন্তর্জাতিক একটি পুরস্কার পাওয়ার খবর শুনে তিনি বাসায় চলে এলেন। তার পর হাতে ৫ হাজার টাকা দিয়ে বললেন, ‘এটা রাখ, তোর পকেট খরচ।’

সত্যি বলতে কী, আজ আমি যে নামে পরিচিত, সেটি কিন্তু তারই দেয়া। বাবার দেয়া নাম মাসুদ আহমেদ পাল্টে এ নাম দেয়ার ক্ষেত্রে তার যুক্তিও ছিল। আহসান হাবীব নামে তার এক মেধাবী বন্ধু ছিলেন। তিনি চাইতেন আমিও যেন তার বন্ধুর মতোই মেধাবী হই।

তিনি কিন্তু পড়াশোনার ব্যাপারে খুব সিরিয়াস ছিলেন। মাঝে মাঝে আমার বোন ও আমাকে ‘অত্যাচার’ও করতেন। শিক্ষক হিসেবে তিনি বেশ কঠিন ছিলেন। যখন পড়াতে বসতেন তখন আমরা মনে মনে বলতাম, ‘আহারে, সর্বনাশ। আবার তার পাল্লায় পড়েছি।’ এখন বুঝি তিনি আসলে এগুলো আমাদের ভালোর জন্যই করেছেন।

হুমায়ূন আহমেদের প্রভাব আমার ভেতর আছে। এর কারণ হলো, পড়াশোনার কারণে তিনি যখন ঢাকায় থাকতেন, তখন প্রতি সপ্তাহেই মায়ের সঙ্গে আমিও তাকে চিঠি লিখতাম। আমার চিঠি লেখার ধরনটা ছিল বিচিত্র। আমি ছবি এঁকে এঁকে সব বর্ণনা করতাম। সেও পাল্টা ছবি এঁকে আমাকে উত্তর দিত। এভাবেই হয়তো কার্টুন আঁকার ক্ষেত্রে সেন্স অব হিউমারের ব্যাপারটা আমার ভেতরে আস্তে আস্তে বপন হয়েছে। আমার মেজ ভাই জাফর ইকবালও কার্টুন আঁকতেন। আমি তার দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছি। কিন্তু প্রথম প্রভাবিত হয়েছি বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদের দ্বারাই।

আরেকটি কথা, অনেকেই জানে না, হিমু চরিত্রটি তিনি কাকে নিয়ে রচনা করেছেন। আসলে হিমু হলো আমাদের বাবা চরিত্র। বাবাকে অবলম্বন করেই তিনি হিমুকে সাজিয়েছেন। অবশ্য আমাদের পরিবারে সবার মধ্যেই এই হিমু আছে। ভাইয়ের (হুমায়ূন আহমেদ) মতো আমিও কিছুটা হিমু।

তার শূন্যতা আমাকে ভাবায়। মৃত্যুর পর তার যত বই, সবই আমার কাছে নিয়ে এসেছি। প্রতি রাতে ওই বইগুলো পড়ি। তার লেখা পড়ে মনে হয়, এই মানুষটির আরো কিছুদিন থাকা উচিত ছিল। অনেকেই বলে হুমায়ূন আহমেদের রচিত সাহিত্য ভাসা ভাসা, উনি মধ্যবিত্তের জীবন নিয়ে লিখেছেন। কিন্তু আমি মনে করি, হয়তো তিনি সামান্য বিষয় নিয়েই লিখতেন। কিন্তু তার একটি বাক্যই বিশাল একটি গল্প বলতে সক্ষম।

আহসান হাবীব : হুমায়ূন আহমেদের ছোট ভাই, লেখক ও কার্টুনিস্ট।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.