Sylhet Today 24 PRINT

বর্ষায় মোহনীয় সিলেট

দেবাশীষ দেবু |  ২৩ জুন, ২০২১

মাত্র শেষ হওয়া বৃষ্টিতে স্নান সেরে নিয়েছে সড়কের পাশের উঁচু পাহাড়টি। গাছগুলো এখন আরও সবুজ; আরও সতেজ।

পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে আছে মেঘ। কার্পাস তুলোর মতো সাদা মেঘের দল পাহাড়ের পুরো গায়ে চুমু খেতে খেতে ঘুরে বেড়াচ্ছে উত্তর থেকে দক্ষিণে।

প্রেমের এই সুখ যেন সহ্য হচ্ছে না পাহাড়টির। তার চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে এদিকসেদিক।

পাহাড়ের চোখের জলকে কী নামে ডাকা হয়, তা অনেক আগেই গানে গানে বলে গেছেন সুবীর নন্দী: ‘পাহাড়ের কান্না দেখে তোমরা তাকে ঝরনা বলো।’

সিলেট-তামাবিল সড়ক দিয়ে যাওয়ার সময় চোখে পড়ল মেঘ-পাহাড়ের অভিসারের এমন স্বর্গীয় সৌন্দর্যের। এই সড়ক দিয়েই যেতে হয় সিলেটের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র জাফলংয়ে।

এই সড়কের পাশেই খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়। পাহাড়টির অবস্থান অবশ্য সীমান্তের ওপারে, ভারতের মেঘালয়ে। তবে সিলেট থেকেই দেখা যায় এর পূর্ণ অবয়ব।

এই সড়ক দিয়ে জৈন্তাপুর পার হলে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে পাহাড়ের বিশাল শরীরের অনেকটা। মনে হয়, এই তো হাতের কাছেই পাহাড়, দুই কদম এগোলেই যা ছুঁয়ে দেখা যাবে। কাঁটাতারের জঞ্জালের কারণে ছোঁয়া যায় না যদিও।

তাতে অবশ্য একদিকে ভালোই হয়েছে। এখানকার পাহাড়-টিলা কেটে যেভাবে সাবাড় করে ফেলা হয়েছে, তাতে ধরতে পারলে এটিরও যে ঘাড় মটকে দেয়া হতো না, সে নিশ্চয়তা কে দিতে পারে!

বর্ষায় এই পাহাড়টি মোহনীয় রূপ নেয়। ছোট-বড় অসংখ্য ঝরনা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। চাইলে দুয়েকটি ঝরনার জলে গা-ও ভিজিয়ে নেয়া যায়। আর বৃষ্টি থামার খানিক পরে গেলে তো কথাই নেই। দেখা মিলবে পাহাড়ের গায়ে মেঘের খেলা করার সুন্দরতম দৃশ্য।

হাদারপাড়ার বাজার থেকে ইঞ্জিন নৌকা করে সিলেটের আরেক পর্যটনকেন্দ্র বিছনাকান্দিতে যাওয়ার সময়ও দেখা মেলে এমন দৃশ্যের। পাহাড়টা একই আছে। মেঘগুলো বদলে গেছে কেবল। দৃশ্যপটও কিছুটা বদলেছে।

এখানে সড়কের পাশে নয়, পাহাড়ের অবস্থান নদী আর ধানক্ষেতের গা-ঘেঁষে। বিছনাকান্দি অথবা সাদাপাথরের জলের বিছানায় শুয়ে কিংবা জাফলং বা পাংথুমাইয়ে ঝরনার জলে দাপাদাপি করতে করতে পাহাড় আর মেঘের এই মিতালি তো কেবল বর্ষাকালেই দেখা মেলে।

বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদে বোঁদলেয়ারের সেই কবিতা তো অনেকেই পড়েছেন, ‘…বলো তবে, অদ্ভুত অচেনা মানুষ, কি ভালোবাসো তুমি?/ আমি ভালোবাসি মেঘ…চলিষ্ণু মেঘ…ওই উঁচুতে…ওই উঁচুতে…/ আমি ভালোবাসি আশ্চর্য মেঘদল!’

এমন বর্ষায়, এই পাহাড়ের পাদদেশে এসে, চলিষ্ণু মেঘদলকে ভালো না বেসে উপায় আছে!

শুধু এই পাহাড় আর মেঘদলের কথা বলা কেন, বর্ষায় পুরো সিলেটই তো এমন। পর্যটক আকর্ষণের জন্য জেলা প্রশাসন থেকে সিলেটকে ব্র্যান্ডিং করা হয়েছে ‘প্রকৃতি কন্যা’ নামে।

সিলেট যেন প্রকৃতির সেই সুন্দরী কন্যা, বৃষ্টির স্পর্শ যাকে আরও মোহনীয়, আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। ফলে বর্ষাকালেই সিলেট ফুটে ওঠে তার পূর্ণ রূপে, পূর্ণ যৌবনে।

সাধারণ শীত মৌসুমকেই দেশে পর্যটন মৌসুম হিসেবে ধরা হয়। এই সময়েই পর্যটকরা ঘোরাঘুরি করেন বেশি। তবে সিলেট যেন বর্ষাসুন্দরী। শীত-বসন্তের ধূলি-ধূসর আর রুক্ষতা সরিয়ে বর্ষায় নবপ্রাণে জেগে ওঠে এখানকার প্রকৃতি।

গাছে গাছে নতুন পাতা গজায়, শুকিয়ে যাওয়া নদী-হাওর পানিতে টইটম্বুর হয়ে ওঠে। পাহাড়ে দৃশ্যমান হয় ঝরনা। জলে ভাসে রাতারগুল, হাওরে হিজল। আর বৃষ্টির ছোঁয়া পেয়ে চা-বাগানগুলো হয়ে ওঠে আরও ঘ্রাণময়, আরও সবুজ। এই পাহাড়, হাওর, বন, চা-বাগান, এসব নিয়েই তো সিলেট এবং এই বৃষ্টি-বর্ষা নিয়েও।

বিশ্বের সবচেয়ে বৃষ্টিবহুল অঞ্চল মেঘালয়ের মওসিন্রামের পাশে সিলেটের অবস্থান। ফলে সারা বছরই এই অঞ্চলে বৃষ্টি থাকে। আর বর্ষা মৌসুমে তো কথাই নেই। দিন-রাতভর চলতেই থাকে ধারাপাত। এতে নাগরিক জীবনে কিছু বিপত্তিও আসে বটে।

সড়কে জল জমে। ভাঙা সড়কে কাদা হয়। যখন-তখন আসা বৃষ্টিতে ভিজে জবুথবু হতে হয় কর্মব্যস্ত নগরবাসীকে।

বর্ষার নাগরিক এই জঞ্জালের চিত্র দারুণভাবে তুলে ধরেছিলেন সুকুমার রায়, ‘আপিসের বাবুদের মুখে নাই ফুর্তি/ ছাতা কাঁধে জুতা হাতে ভ্যাবাচ্যাকা মূর্তি/ কোনখানে হাঁটু জল, কোথা ঘন কর্দম/ চলিতে পিছল পথে পড়ে লোকে হর্দম।’

তবে নাগরিকদের এসব বিপত্তি নিয়ে ভাবতে প্রকৃতির বয়েই গেছে। প্রকৃতিতে তো তখন নবযৌবনের উচ্ছ্বাস।

বর্ষায় এখানকার হাওরগুলো, বিশেষত সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর এক আশ্চর্য সুন্দর রূপ নেয়। শুকিয়ে যাওয়া হাওরের চারদিকে থইথই করে পানি। একেবারে আদিগন্ত বিস্তৃত যাকে বলে।

পানির মধ্যেই গলা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে সারি সারি হিজল-করচ। দূরে, আরও দূরে পানির সঙ্গে মিশে যায় আকাশ। কখনো বা সূর্য ঝুলে থাকে হিজলের ডালে।

হাওরের মধ্যে ছোট ছোট দ্বীপের মতো একেকটা জনবসতি। দেখলে মনে হবে পানির মধ্যে ভেসে বেড়াচ্ছে এগুলো। আর জেলেরা সত্যি সত্যিই ভেসে ভেসে মাছ শিকার করে চলছেন। কেউ জাল দিয়ে, কেউ বড়শি, কেউ বা অন্য কিছু দিয়ে।

হাওরে ভাসতে ভাসতে লাউড়ের গড়, বারেকের টিলা, শহীদ সিরাজ লেক- এসব দিকে চলে গেলে আবার বিশাল দেহ নিয়ে কাছে এসে দাঁড়াবে সেই পাহাড় আর তার গায়ে খেলা করা মেঘদল।

প্রকৃতির এমন সুবিন্যস্ত সুন্দর রূপ দেখেই হয়তো এই অঞ্চলের এক উদাসী রাজা একদিন গেয়ে উঠেছিলেন, ‘আঁখি মুঞ্জিয়া দেখ রূপ, আঁখি মুঞ্জিয়া দেখ রূপ রে/আরে দিলের চক্ষে চাহিয়া দেখ বন্ধুয়ার স্বরূপ রে।’

বর্ষায় বেশ দুর্ভোগও পোহাতে হয় হাওরপারের মানুষদের। শান্ত-স্থির হাওরেও হঠাৎ ঢেউ ওঠে। ভয়ংকর সব ঢেউ, স্থানীয় ভাষায় যাকে ‘আফাল’ বলে। এর ধাক্কায় ভেঙে পড়ে হাওরপারের জনবসতি। তীব্র হয়ে ওঠে ভাঙন।

কখনো বা তীব্র ঝড় উড়িয়ে নিয়ে যায় ঘরের চালের টিন, মাটির বেড়া। আর বন্যা দেখা দিলে তো দুর্ভোগ সীমা ছাড়িয়ে যায়।

মানুষের এসব দুর্ভোগ, উপদ্রব সত্ত্বেও বর্ষা আসে প্রকৃতিতে নতুন প্রাণের আহ্বান নিয়ে। এই সময় মাছেরা উজায়। নতুন পোনা ছাড়ে। বীজ থেকে নতুন গাছ জন্মায়। অঙ্কুরোদগম হয়। প্রকৃতিতে যেন বর্ষার আহ্বান- প্রাণের সঞ্চার করো।

সিলেট ছাড়া আর কোথায় গেলে এমন স্পষ্ট করে বোঝা যাবে বর্ষার এই আহ্বান? পাহাড়, নদী, ঝরনা, অরণ্য, হাওর—প্রকৃতির এমন বৈচিত্র্য আর কোথায়ই বা আছে?

আচ্ছা, মানুষের জন্যও কি এই আহ্বান নিয়ে আসে বর্ষা? মিলনের, প্রাণসঞ্চারের? হবে হয়তো। না হলে রবীন্দ্রনাথের কেন মনে হবে, ‘এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরিষায়।’

কেন বর্ষায়ই ‘তারে’ বলতে হবে, কেন অন্য ঋতুতে নয়?

(প্রতিবেদনে ব্যবহৃত ছবিগুলো তুলেছেন হাসান মোরশেদ, তানভীর রুহেল ও মোসাইদ রাহাত)

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.