Sylhet Today 24 PRINT

কিংবদন্তি নেলসন ম্যান্ডেলা

দিলীপ রায় |  ১৯ জুলাই, ২০২১

দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বর্ণবৈষম্য বিরোধী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই ব্রিটিশ দক্ষিণ আফ্রিকার এমভেজোর এক অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ছিলেন ইস্টার্ন কেপ প্রদেশের থেম্বো রাজকীয় পরিবারের কাউন্সিলর। বাবা নাম রেখেছিলেন রোলিহ্লাহ্লা ডালিভুঙ্গা ম্যান্ডেলা। স্কুলের এক শিক্ষক তাঁর ইংরেজি নাম রাখেন নেলসন। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকায় ম্যান্ডেলা তাঁর গোত্রের নিকট 'মাদিবা' নামে পরিচিত, যার অর্থ হল 'জাতির জনক'।

তিনি ফোর্ট হেয়ার বিশ্ববিদ্যালয় ও উইটওযাটারস্র্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেন। সেখানে তিনি উপনিবেশ-বিরোধী কার্যক্রম ও আফ্রিকান জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ১৯৪৩ সালে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসে যোগ দেন এবং আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের যুব শাখার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৪৪ সালে ইয়ুথ লিগ প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। সশস্ত্র সংগঠন উমখন্তো উই সিযওয়ের নেতা হিসাবে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। একই সঙ্গে কাজ শুরু করেন একজন আইনজীবী হিসেবেও। আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের আরেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা অলিভার টাম্বোর সঙ্গে মিলে তিনি তার অফিস খোলেন জোহানসবার্গে। ১৯৬০ সালে শার্পভিলে কৃষ্ণাঙ্গ বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশের গুলিতে ৬৯ জন নিহত হলে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠে। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে আদৌ আর লাভ হবে কিনা সে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। এসময় এক বক্তৃতায় নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, “সরকার যখন নিরস্ত্র এবং প্রতিরোধবিহীন মানুষের ওপর পাশবিক আক্রমণ চালাচ্ছে, তখন সরকারের সঙ্গে শান্তি এবং আলোচনার কথা বলা নিষ্ফল।”

এএনসি সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করলে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের অভিযোগে নেলসন ম্যান্ডেলাকে ১৯৬২ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার গ্রেপ্তার করে ও অন্তর্ঘাতসহ নানা অপরাধের দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। শুরু হয় তাঁর দীর্ঘ কারাজীবন। ম্যান্ডেলা ২৭ বছর কারাবাস করেন। এর অধিকাংশ সময়ই তিনি ছিলেন রবেন দ্বীপ, পলসমুর কারাগার ও ভিক্টর ভার্স্টার কারাগারে। জেলে থাকার সময়ে বিশ্বজুড়ে তাঁর খ্যাতি বাড়িতে থাকে। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৃষ্ণাঙ্গ নেতা হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেন। ম্যান্ডেলা তাঁর জীবনীতে লিখেছেন, তাঁকে ডি-গ্রুপের বন্দি হিসেবে গণ্য করা হত, অর্থাৎ সবচেয়ে কম সুবিধাপ্রাপ্ত বন্দিদের তালিকায় তাঁকে রাখা হয়েছিল। তাঁকে প্রতি ৬ মাসে একটিমাত্র চিঠি দেওয়া হত এবং একজনমাত্র দর্শনার্থীর সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দেওয়া হত। ম্যান্ডেলাকে লেখা চিঠি কারাগারের সেন্সর কর্মীরা অনেকদিন ধরে আটকে রাখত। চিঠি ম্যান্ডেলার হাতে দেওয়া আগে তার অনেক জাগায়ই কালি দিয়ে অপাঠযোগ্য করে দেওয়া হত।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চপের মুখে এবং বর্ণবাদী গৃহযুদ্ধের আতংকে রাষ্ট্রপতি এফ. ডব্লিউ. ডি ক্লার্ক ১৯৯০ খৃষ্টাব্দের ১১ ফেব্রুয়ারি তাঁকে কারামুক্ত করার নির্দেশ দেন। সেদিন কারাগারের সামনে দেওয়া বক্তৃতায় নেলসন ম্যান্ডেলা তাঁর সমর্থকদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন সেই কথা, যা তিনি তাঁর বিচারের সময়ে আদালতে বলেছিলেন। ম্যান্ডেলা বলেন, এমন এক দক্ষিণ আফ্রিকার স্বপ্ন দেখেন তিনি, যেখানে সব জাতি, সব বর্ণের মানুষ সমান সুযোগ নিয়ে এক সঙ্গে থাকতে পারবে। “এটা এমন এক আদর্শ, যেটির আশায় আমি বেঁচে থাকতে চাই। কিন্তু যদি দরকার হয়, এই আদর্শের জন্য আমি মরতেও প্রস্তুত।”

কারামুক্তি লাভের পর তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ সরকারের সঙ্গে বর্ণবাদ নিপাতের প্রচেষ্টায়ে শান্তি আলোচনায় অংশ নেন। সাবেক শ্বেতাঙ্গ শাসকদের দিকে বাড়িয়ে দেন বন্ধুত্বের হাত। এর ফলশ্রুতিতে ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে সব বর্ণের মানুষের অংশগ্রহণে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে ম্যান্ডেলা তাঁর দল এএনসি'র হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এবং জয় লাভ করেন। ১৯৯৪ সালের ১০ মে নতুন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন নেলসন ম্যান্ডেলা। এর মধ্য দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের অবসান ঘটে এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্রের আদর্শের ধারক ম্যান্ডেলা ১৯৯১ থেকে ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

গণতন্ত্র ও সামাজিক ন্যায়ের প্রতীক হিসেবে গণ্য ম্যান্ডেলা ২৫০টিরও অধিক পুরস্কার পেয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ভারত সরকার প্রদত্ত ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে ভারতরত্ন পুরস্কার। তাছাড়াও ১৯৯৩ সালে তাঁকে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়।

ম্যান্ডেলার ব্যক্তিগত জীবনও ছিল ঘাত-প্রতিঘাতে ভরা। ১৯৯৪ সালে তিনি তাঁর প্রথম স্ত্রী ইভলিন মেসকে বিয়ে করেন। এই বিয়ে বেশিদিন টেকেনি। দ্বিতীয় স্ত্রী এবং দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহযোদ্ধা উইনি ম্যান্ডেলার সঙ্গে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্তটি ছিল তাঁর জীবনের কঠিনতম সিদ্ধান্তগুলোর একটি। ৮০তম জন্মদিবসে তিনি তৃতীয়বার বিয়ে করেন মোজাম্বিকের সাবেক ফার্স্ট লেডি গ্রাসা মার্শেলকে। অবসরে যাওয়ার পরও নেলসন ম্যান্ডেলার ব্যস্ততা কমেনি, কারণ ততদিনে স্বাধীনতা এবং বিশ্ব শান্তির এক আইকনে পরিণত হয়েছেন তিনি। তাঁর এক ছেলে মারা গিয়েছিলেন এইডসে। এ ঘটনার পর তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় এইডস প্রতিরোধ এবং এর চিকিৎসা নিয়ে সোচ্চার হন। বাকী জীবনের বেশিরভাগ সময়ে তিনি দারিদ্র দূরীকরণ এবং এইডস নিরাময়ের লক্ষ্যে প্রচারণায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। নেলসন ম্যান্ডেলাকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তাঁকে কীভাবে মনে রাখলে খুশী হবেন তিনি? তাঁর উত্তর ছিল, “আমি চাই আমার সম্পর্কে এরকম কথাই বলা হোক, এখানে এমন এক মানুষ শায়িত আছেন, যিনি পৃথিবীতে তার কর্তব্য সম্পাদন করেছেন।”

আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, প্রখর রসবোধ, শত্রুতা ভুলে বৈরি প্রতিপক্ষের প্রতি উদারতা এবং তাঁর বর্ণাঢ্য জীবন কাহিনী-এসব মিলিয়ে নেলসন ম্যান্ডেলা ছিলেন এক অনন্য কিংবদন্তি। শুধু দক্ষিণ আফ্রিকায় নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায়ও তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

৫ ডিসেম্বর ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দ তারিখে বিশ্বের এই মহান নেতা মৃত্যুবরণ করেন।

দিলীপ রায়: প্রভাষক, গণিত বিভাগ, মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজ, সিলেট।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.