Sylhet Today 24 PRINT

বেনেডিক্ট ক্যাম্বারব্যাচ: অমিত সাহসী সৃষ্টিশীল অভিনেতা

লিটন দেব জয় |  ২৪ জুলাই, ২০২১

বেনেডিক্ট ক্যাম্বারব্যাচ সেদিন তার স্ত্রী সোফি হান্টারের সাথে উবারে চেপে এক ক্লাবে যাচ্ছিলেন। খোশগল্পে মজে ছিলেন দু'জন। লন্ডনের মায়াময় প্রকৃতিও নিশ্চয়ই সেদিন তাদের অবিরাম উস্কে দিচ্ছিল উষ্ণ ভালোবাসায়! অভিনয় জীবনে ভীষণ ব্যস্ত থাকেন বেনেডিক্ট। ব্যস্ততার দিনলিপিতে প্রিয়তমা সোফি'র সাথে এমন সময় কাটানোর ফুরসত মেলে কালেভদ্রে। সেই সময়টা তাই পুরোপুরি উপভোগ করছিলেন তারা। কে জানে বেনেডিক্ট হয়তো তার প্রিয় গান 'One Day Like This' এর কথাগুলো আওড়াচ্ছিলেন মনে মনে!

"...I love your eyes
And only now I see the light
Yeah, lying with you half awake
Oh, anyway, it's looking like a beautiful day..."

লন্ডনের মেরিলবোন হাই স্ট্রিট ক্রস করছিল তাদের গাড়ি। হঠাৎ বেনেডিক্ট গাড়ির জানালা দিয়ে দেখলেন চারজন মিলে এক যুবককে মারধর করছে। যুবকটিকে খুব অসহায় দেখাচ্ছিল। কান্নাজড়িত কণ্ঠে সে বারবার অনুরোধ করে বলছিল, 'আমি ডেলিভারকো প্রতিষ্ঠানের ডেলিভারিম্যান। আমি কী করেছি? আমাকে মারছেন কেন? যেতে দিন আমাকে।'

উবারচালক ম্যানুয়েল ডিয়াসও ব্যাপারটা খেয়াল করছিলেন। 'কিছু একটা করতে হবে' চিন্তায় তিনি গাড়ি থামালেন সেখানে। উবারচালক ডিয়াস তখনও জানেন না গাড়িতে স্বয়ং বেনেডিক্ট ক্যাম্বারব্যাচ বসে আছেন। যিনি পর্দায় জাদুর মায়াজালে নিমিষেই কাবু করে ফেলেছিলেন মহাবিশ্বের অজেয় সেনাপতি থ্যানোসকে! পৃথিবী গ্রাস করতে আসা গ্রহখেকো 'ডোরমামু' যার 'সময়ের ফাঁদে' পড়ে রীতিমতো কান্নাকাটি করেছিলো! অ্যালান টিউরিং রূপে ক্রিপ্টোগ্রাফিতে যিনি জার্মান সাইফারের অর্থোদ্ধারে কমিয়ে দিয়েছিলেন বিশ্বযুদ্ধের মহাবিনাশ। থাক, এ আলাপ অন্যদিন হবে!আমরা বরং মেরিলবোন হাই স্ট্রিটে ফিরে আসি।

দুর্বৃত্তরা ঐ ডেলিভারিম্যানের সাইকেল কেড়ে নিতে চাচ্ছিল। পৈশাচিক উন্মাদনায় সাইকেলের হেলমেট দিয়ে তার মাথায় আঘাত করছিল বার বার। মাথা বেয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরা শুরু হলো তার। যুবকটির অসহায়ত্ব আর দুর্বৃত্তদের এমন নির্মমতায় বেনেডিক্ট নিজেকে সামলাতে পারলেন না। নিজের ভেতরের 'সুপারহিরো' ততক্ষণে জেগে উঠেছিল বোধহয় তাঁর! বেনেডিক্ট গাড়ি থেকে নেমে এক দৌড়ে চলে গেলেন সেখানে। জীবনের ঝুঁকি আছে জেনেও! উবারচালক ডিয়াস নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না! এ যে 'শার্লক', 'ডক্টর স্ট্রেঞ্জ' খ্যাত বেনেডিক্ট ক্যাম্বারব্যাচ! এতক্ষণ তার গাড়িতে ছিলেন অসামান্য এই অভিনেতা অথচ টেরই পাননি তিনি! হায়!

বেনেডিক্ট ঘটনাস্থলে গিয়ে মুহূর্তেই দুর্বৃত্তদের টেনে সরালেন ওই যুবকের উপর থেকে। দুর্বৃত্তদের একজন রেগে ঘুষি মারতে ছুটে এসেছিল তাকে। ক্যাম্বারব্যাচ দারুণ কৌশল আর সাহসিকতায় সেটা প্রতিরোধ করেছিলেন। চিৎকার করে বলেছিলেন, 'ছেড়ে দাও ওকে। দূরে সরো তোমরা।' দুর্বৃত্তরাও হয়ত ততক্ষণে চিনে ফেলেছিল বেনেডিক্ট ক্যাম্বারব্যাচকে! তারা দিশেহারা হয়ে দৌড়ে পালিয়েছিল সেখান থেকে। বেনেডিক্ট যুবকটিতে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরলেন। সে ঠিক আছে কী না জিজ্ঞেস করলেন। একটি সুরক্ষিত জায়গায় তাকে রেখে ক্লাবে চলে গেলেন উবারে চেপে।

'দ্য সান' পত্রিকা পৃথিবীকে এই ঘটনা জানিয়েছিল উবারচালক ডিয়াসের বর্ণনায়। ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করতে বেনেডিক্টের সাথে যোগাযোগ করেছিল পশ্চিমের অনেক গণমাধ্যম। বেনেডিক্ট কথা বেশি বাড়াননি। তাকে বরং বিরক্তই মনে হয়েছে এই প্রশ্নে। তিনি বলেছিলেন, 'হ্যাঁ, আমিই সেই ব্যক্তি। এটা এমন আহামরি কোনো ঘটনা নয়। কাউকে বিপদে দেখলে এগিয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক ব্যাপার।'

বেনেডিক্ট ঘটনাটা যতই হালকা করে বলেন না কেন; এমন সাহসিকতার গল্প কিন্তু কমই শোনা যায়। আর সেলিব্রেটিদের ক্ষেত্রে তো এরকম ঘটনা রীতিমত বিস্ময়কর! কয়টা সাহসিকতার গল্প আছে এমন? হাতেগোনা নিশ্চয়ই? ছুটে চলা এই পৃথিবীতে কারো সময় নেই অন্যের দিকে তাকানো'র। সবাই দৌড়াচ্ছে নিজের স্বপ্নপূরণের হাতছানিতে। সাফল্য নামক গোলকধাঁধার পেছনে ছুটছে মানুষ। এ এক রূঢ় বাস্তবতা। মানবিকতা, সম্পর্কও জলাঞ্জলি দিচ্ছে মানুষ প্রতিনিয়ত! সেখানে এমন দৃষ্টান্ত আমাদের মুগ্ধ করে। এমন সাহসী ও মানবিক হৃদয়ের মানুষকে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানাতে বাধ্য করে।

বেনেডিক্ট ক্যাম্বারব্যাচকে পছন্দ করার পেছনে একটা ছোট্ট গল্প আছে আমার। সে সময় রবার্ট ডাউনি জুনিয়রের 'শার্লক হোমস' মুভিতে মজে আছি। শার্লক নামটা শুনলেই তার চেহারা ভাসে নিউরনজুড়ে। এতো অনবদ্য পারফরম্যান্স উপহার দিয়েছেন ভদ্রলোক যে ভুলার উপায় নেই। এরমধ্যে শুনলাম বিবিসি'র 'শার্লক' সিরিজে বেনেডিক্ট ক্যাম্বারব্যাচ অভিনয় করেছেন। জেনে খারাপ লাগলো কিছুটা। রবার্ট ডাউনি জুনিয়রকে কেন সিরিজে কাস্ট করলো না এমন শিশুতোষ চিন্তা ভাবনা করছিলাম! 'এই সিরিজ আমি দেখবোই না' এমন পণও করেছিলাম মনে মনে। তখন আসলে বেনেডিক্ট সম্পর্কে ধারণা ছিলো না খু্ব একটা। The Other Boleyn Girl, Star Trek Into Darkness দেখেছি কেবল।

এরপর সময়ের পরিক্রমায় কেটে গেলো আরও কয়েক বছর। 'শার্লক' সিরিজেরও তিন সিজন চলে আসলো। মিডিয়াজুড়ে 'শার্লক' নিয়ে বেশ মাতামাতি চলে! কিন্তু আমার তাতে কী? আমি আমার শিশুতোষ পণে অটুট! 'দেখবো না এ সিরিজ!' ভাগ্যিস ঘটনাক্রমে তার The Imitation Game, Doctor Strange, 12 Years a Slave মুভিগুলো দেখেছিলাম! নতুবা হয়তো বেনেডিক্টকে চেনা-ই হতো না আমার তখন। মুভিগুলো আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল। বলতে গেলে বেনেডিক্টকে পছন্দ করতে বাধ্য করিয়েছিল। আফসোস করেছিলাম এমন অপূর্ব এক অভিনেতাকে আগে চিনতে না পেরে!

শেষমেশ 'ভুলের প্রায়শ্চিত্ত' করতে 'শার্লক' সিরিজ দেখতে বসেছিলাম। সিরিজে এতোটাই মগ্ন ছিলাম যে তিন দিনে তিন সিজন দেখে শেষ করেছিলাম। কৈশোরের বইয়ের পাতার অষ্টাদশ শতাব্দী'র সেই শার্লক জীবন্ত হয়ে উঠলেন একবিংশ শতাব্দীর টিভি পর্দায়। এই শার্লক টুইটার ব্যবহার করেন। তার বন্ধু ডা. জন ওয়াটসন লিখে চলেন ব্লগের পর ব্লগ।

এক আজব মিষ্টি যন্ত্রণায়ও পড়েছিলাম তখন! কে বেশি ভালো করেছেন 'শার্লক হোমস' চরিত্রে? রবার্ট ডাউনি জুনিয়র নাকি বেনেডিক্ট ক্যাম্বারব্যাচ? এর সমাধান করতে পারছিলাম না। দু'জনই প্রিয়'র তালিকায় চলে গেছেন তখন। কাকে বলবো সেরা? এ যেন, 'শার্লকের অমীমাংসিত রহস্য' টাইপ অবস্থা।

বিষয়টা এখনও অমীমাংসিতই আছে অবশ্য! থাক, সব বিষয়ের মীমাংসা করতে নেই। কিছু বিষয় অমীমাংসিত-ই সুন্দর।

বেনেডিক্ট ক্যাম্বারব্যাচ অমিত সৃষ্টিশীল একজন মানুষ। তার সম্পর্কে যতোই জানবেন প্রিয় থেকে প্রিয়তর হয়ে উঠবেন তিনি। মঞ্চ, টিভি, রেডিও, সিনেমা প্রতিটি ক্ষেত্র তার রত্নখচিত সৃষ্টিশীলতার অনন্য সাক্ষী হয়ে আছে। অভিনয় শিল্পের সে রস আস্বাদন করে দেখুন। আপনিও কখন তার গুণমুগ্ধ ভক্ত হয়ে উঠবেন টেরই পাবেন না।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.