দিলীপ রায় | ৩১ জুলাই, ২০২১
তাঁহাকে জানিবার পূর্বে নদী, নদী ছিল, পর্বত ছিল পর্বত। তাঁহাকে জানিতে গিয়া নদী, নদী রহিল না, পর্বত রহিল না পর্বত...।
বাংলাদেশের বিশিষ্ট কবি, লেখক ও সমাজবিজ্ঞানী আহমদ ছফা জীবদ্দশায় তার প্রথাবিরোধী, অকপট দৃষ্টিভঙ্গির জন্য বুদ্ধিজীবী মহলে বিশেষভাবে আলোচিত ও সমালোচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন তীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী। ষাটের দশকে তার সাহিত্য-জীবনের সূচনা হয়। সৃষ্টিশীল লেখক হিসেবে তিনি গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, কবিতা, সমালোচনা, অনুবাদ, শিশুসাহিত্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। তিনি বিভিন্ন সাহিত্য-সাময়িকী সম্পাদনা করেন। বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে তিনি সফল ছিলেন। জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা তার গল্প-উপন্যাসে অবলীলায় ফুটে উঠেছে। বাংলাদেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, মুক্তচিন্তা, স্বাধীনতাস্পৃহা, সামাজিক অসঙ্গতি এবং বৈষম্যের চিত্র রূপায়িত হয়েছে তার আখ্যানগুলোতে।
আহমদ ছফা ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ জুন চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার হাশিমপুর ইউনিয়নের গাছবাড়িয়া গ্রামে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম হেদায়েত আলী ওরফে ধন মিয়া। মায়ের নাম আসিয়া খাতুন। দুই ভাই চার বোনের মধ্যে আহমদ ছফা ছিলেন তাদের দ্বিতীয় সন্তান।
আহমদ ছফার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় তার পিতার প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দক্ষিণ গাছবাড়িয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে নিজের গ্রামের নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম নাজিরহাট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। একই বৎসরে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে। পরে বাংলা বিভাগে ক্লাস করা অব্যাহত রাখেননি। ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ থেকে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে এমএ পরীক্ষা দেয়ার আগেই বাংলা একাডেমির পিএইচডি গবেষণা বৃত্তির জন্য আবেদন করেন এবং তিন বছরের ফেলোশিপ প্রোগ্রামের জন্য মনোনীত হন। গবেষণার বিষয় ছিল ‘১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব, বিকাশ, এবং বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে তার প্রভাব’। ১৯৭১ সালে প্রাইভেটে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পরীক্ষা দেন। পরে আর পিএইচডি সম্পন্ন করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ১৯৮৬ সালে জার্মান ভাষার ওপর গ্যোটে ইন্সটিটিউটের ডিপ্লোমা ডিগ্রিও লাভ করেন। যে জ্ঞান তাকে পরবর্তী সময়ে গ্যোটের অমর সাহিত্যকর্ম ফাউস্ট অনুবাদে সাহস যুগিয়েছিলো।
ছাত্রাবস্থায় সুধাংশু বিমল দত্তের মাধ্যমে কৃষক সমিতি-ন্যাপ বা তৎকালীন গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত হন। মাস্টারদা সূর্যসেনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে অনুপ্রাণিত হয়ে তারা কয়েকজন বন্ধু মিলে চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেললাইন উপড়ে ফেলেন। পরে গ্রেপ্তার এড়াতে কিছুকাল পার্বত্য চট্টগ্রামে আত্মগোপন করেন।
আহমদ ছফা সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি শাখায় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৩০টিরও অধিক। এর মধ্যে রয়েছে ৮টি উপন্যাস, ২টি গল্পগ্রন্থ , ৫টি কাব্যগ্রন্থ , ৩টি অনূদিত বই, ১৬টি প্রবন্ধের বই। আহমদ ছফার প্রথম গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে। এটি একটি উপন্যাস, যার নাম 'সূর্য তুমি সাথী'। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে পিএইচডি অভিসন্দর্ভের জন্য জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের সান্নিধ্যে আসেন। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম গ্রন্থ হিসেবে মুক্তধারা থেকে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশ পায় তার প্রবন্ধ গ্রন্থ 'জাগ্রত বাংলাদেশ'।
১৯৭১ সালে ‘লেখক সংগ্রাম শিবির’ গঠন ও এর বিভিন্ন কার্যক্রমে সক্রিয় অংশ নেন। ৭ মার্চ ‘স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পত্রিকা’ হিসেবে প্রতিরোধ প্রকাশ করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এপ্রিল মাসে কলকাতা চলে যান। মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সেখান থেকে 'দাবানল' নামের পত্রিকা সম্পাদনা করেন। দেশ স্বাধীন হবার পর বাংলাদেশে ফিরে আসেন। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে দৈনিক গণকন্ঠ ধারাবাহিকভাবে ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ রচনা প্রকাশ করে। এ কারণে তৎকালীন সরকারের রোষানলে পড়তে হয়। ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে 'সিপাহী বিদ্রোহের ইতিহাস' গ্রন্থ প্রকাশ পায়। ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে দৈনিক ইত্তেফাকের সাংবাদিক নাজিমুদ্দিন মোস্তানের সহায়তায় কাঁটাবন বস্তিতে ‘শিল্পী সুলতান কর্ম ও শিক্ষাকেন্দ্র’ চালু করেন। বাংলা একাডেমি থেকে 'বাঙালি মুসলমানের মন' প্রবন্ধগ্রন্থ প্রকাশ পায় ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে।
ছফা মহাকবি গ্যোটের ফাউস্ট অনুবাদ শুরু করেন ১৯৭০ সালে। মুক্তধারা থেকে ফাউস্টের অনুবাদ বের হয় ১৯৮৬ সালে। ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত হয় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস 'অলাতচক্র'। ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে 'পুষ্প বৃক্ষ' এবং 'বিহঙ্গপুরাণ' এবং 'অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী' প্রকাশিত হয়। ‘অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী’ পূর্বে একটা সাপ্তাহিক পত্রিকায় 'প্রাণপূর্ণিমার চান' নামে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল। জাপানি ভাষায় পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গপুরাণ উপন্যাসের অনুবাদ প্রকাশ পায় ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে। বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক ও সামসময়িক কালের বিশিষ্ট পণ্ডিত অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের প্রসঙ্গে রচিত 'যদ্যপি আমার গুরু' প্রকাশিত হয় ১৯৯৮ সালে। তার জীবদ্দশায় আহমদ ছফা রচনাবলী প্রকাশ শুরু হয়। ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে আহমদ ছফা রচনাবলী দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশ পায়। জীবিতকালে বিভিন্ন সংবাদপত্রে কলাম লেখতেন নিয়মিত।
তিনি লেখক শিবির পুরস্কার ও বাংলা একাডেমি কর্তৃক সাদত আলী আখন্দ পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন। ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে ইতিহাস পরিষদ পুরস্কার গ্রহণ করেছেন বলে জানা যায়। তাকে ২০০২ সালে সাহিত্যে (মরণোত্তর) একুশে পদক প্রদান করা হয় ।
২০০১ সালের ২৮ জুলাই অসুস্থ অবস্থায় ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালে নেয়ার পথে এই গুণী মানুষটির মৃত্যু হয়। পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে জানাজা শেষে মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে তার দাফন হয়।
সবশেষে তার একটি বিখ্যাত উক্তি দিয়ে লেখাটি শেষ করি- “কাউকে জ্ঞান বিতরণের আগে জেনে নিও যে তার মধ্যে সেই জ্ঞানের পিপাসা আছে কি না। অন্যথায় এ ধরণের জ্ঞান বিতরণ করা হবে এক ধরণের জবরদস্তি। জন্তুর সাথে জবরদস্তি করা যায়, মানুষের সাথে নয়। হিউম্যান উইল রিভল্ট।”
দিলীপ রায়: প্রভাষক, গণিত বিভাগ, মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজ, সিলেট।
ই-মেইল: [email protected]