Sylhet Today 24 PRINT

জননেতা মফিজ আলী

অনন্য আদিত্য |  ১১ অক্টোবর, ২০২১

২০০৮ সালের ৩০ আগস্ট সচল অবস্থায় তার জীবনের সর্বশেষ একটি কৃষকসভায় কুলাউড়ায় শেষ করে ফেরার পথে সন্ধ্যাবেলায় নিজবাড়ির সামনের মাঠ সংলগ্ন রাস্তার পাশে জননেতা মফিজ আলীকে পড়ে থাকতে দেখে জনৈক পথচারী ডাকাডাকি করে লোকজন জড়ো করে তাকে উদ্ধার করেন। কিন্তু কিভাবে তিনি রাস্তায় পড়ে থাকলেন তা আজও জানা যায়নি। তাকে উদ্ধারের সময়ে একটি হেডলাইটবিহীন বাস ঐ রাস্তা অতিক্রম করে যাওয়ায় অনেকে ধারণা ঐ বাসের ধাক্কায় তিনি আহত হয়ে রাস্তায় পড়ে ছিলেন। এরপর তিনি দীর্ঘ এক মাস ১০ দিন সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। কিন্তু একটি নয়া-উপনিবেশিক আধাসামন্তবাদী দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা, হাসপাতালের দুরবস্থা, অব্যবস্থাপনা সর্বোপরি গতানুগতিক ও অনান্তরিক চিকিৎসায় এদেশের অন্যতম প্রবীণ বামপন্থী নেতা মফিজ আলীকে বাঁচানো যায়নি। চিকিৎসকরা তার মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণ সুনির্দিষ্ট করে প্রয়োজনীয় ভূমিকা না নেওয়ায় জানা যায়নি তার মৃত্যু কি রক্তচাপজনিত স্ট্রোকে না কি দুর্ঘটনার কারণে হয়েছে। দায়িত্বরত চিকিৎসকদের অনান্তরিকতা ও অবহেলা না হলে একটা প্রবোধ হয়তো দেওয়া যেতো। তবে এটা ঠিক যে, তিনি এভাবে আকস্মিক অসুস্থ না হলে আরও বেশ কিছুদিন বেঁচে থাকতে পারতেন। তাতে উপকৃত হতো বাংলাদেশের চা শ্রমিকসহ শ্রমিক শ্রেণী তথা জনগণ এবং প্রগতিশীল আন্দোলন।

বৃহত্তর সিলেটের ত্যাগী প্রখ্যাত বামপন্থী নেতা মফিজ আলী ২০০৮ সালের ১০ অক্টোবর শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। জননেতা মফিজ আলীর মৃত্যুর পর দেখতে দেখতে ১৩ বছর হয়ে গেল। ১০ অক্টোবর’২১ তার ১৩-তম মৃত্যুবার্ষিকী।

“বিপ্লবের জন্য যাদের প্রাণের টান আছে এবং মনের বল আছে
ইতিহাস কৃষক-শ্রমিকের এই সংগ্রামে তাদের টেনে আনবেই।”-মফিজ আলী

শ্রমিক-কৃষকের সংগ্রামের প্রতি এমন যার আস্থা তিনি এতদ্বাঞ্চল তথা বৃহত্তর সিলেটের প্রগতিশীল রাজনীতির পুরোধা ব্যক্তিত্ব মফিজ আলী। তিনি ১৯২৭ সালের ১০ ডিসেম্বর মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার শ্রীসূর্য ধোপাটিলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সামন্ত পরিবারের সন্তান মফিজ আলী জন্মেই প্রত্যক্ষ করেন ’৩০ এর দশকের মহামন্দা, যার পরিণতি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ১০ অক্টোবর ২০২১ যখন জননেতা মফিজ আলীর মৃত্যুর ১৩ বছর পূর্ণ হলো তখন সমগ্র পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থায় ২০০৮ সালে সূচিত বৈশ্বিক মন্দাও আঁকাবাঁকা গতিপথে ১৩ বছর অতিক্রম করেছে। বিশ্ব অর্থনীতি মহামন্দার দিকে ধাবিত হওয়ার এ সময়ে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব সেই সংকট ও অচলাবস্থাকে আরও ত্বরান্বিত করছে।

আজ এমন এক সময় তার ১৩-তম মৃত্যুবার্ষিকী পূর্ণ হলো যখন সমগ্র বিশ্ব তীব্রতর মন্দাজনিত পরিস্থিতিতে হাবুডুবু খাচ্ছে। এর ওপর ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’র মত চেপে বসেছে বৈশ্বিক করোনা মহামারি ‘কোভিড-১৯’। সাম্রাজ্যবাদ ও তার দেশীয় দালালরা বিদ্যমান সমস্যা-সংকটের প্রকৃত কারণ যে বৈশ্বিক মন্দা এবং এর জন্য তারাই যে দায়ী সেটাকে আড়াল করে বৈশ্বিক মহামারিকে সামনে তুলে ধরে প্রকৃত সত্যকে আড়াল করে জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। বাংলাদেশ সরকারও সাম্রাজ্যবাদ ও তার বিশ্ব সংস্থার পরিকল্পনা ও নীতি-নির্দেশ বাস্তবায়ন করে চলেছে। করোনার অজুহাতে শিল্প কল-কারখানা, শ্রমিক, শহরের বস্তিবাসী শ্রমজীবী, কর্মজীবী এমনকি মধ্যবিত্ত পেশাজীবীদের লকডাউনের নামে কর্মহীন করে এক নিদারুণ পরিস্থিতির মুখে ঠেলে দিয়ে বেকারত্বের বোঝা বৃদ্ধি করে গ্রামমুখী হতে বাধ্য করেছে। সাথে সাথে কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন কমিয়ে; কাজের সময় বৃদ্ধি করে নির্মম শোষণ করা হচ্ছে।

করোনার কারণে গত এক বছরে আড়াই কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন এবং ৬২ শতাংশ শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন। নিত্যপণ্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির এই সময়ে সরকারের দায়হীন লকডাউন বা শাটডাউন কারণে শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষের জীবন ও জীবিকা বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। করোনা মহামারিতে জনগণের দুর্ভোগ বাড়ার সাথে সাথে লুটপাটকারীদের অর্থবিত্ত বৈভব বেড়ে যাওয়ায় দেশে গত এক বছরে ১০ হাজার ৫১ জন নতুন কোটিপতির সৃষ্টি হয়েছে। গত বছরের ২৬ মার্চ হতে দফায় দফায় হোটেল রেস্টুরেন্ট সরকার বন্ধ করে দিলেও এখাতের প্রায় ৩০ লাখ শ্রমিকের জীবন রক্ষায় সরকার ও মালিক কোনো উদ্যোগ নেয়নি। প্রধানমন্ত্রী ৫০ লাখ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য ২৫০০ টাকা করে এককালীন নগদ আর্থিক সহযোগিতার ঘোষণা দিলেও তা মূলত দলীয় লুটপাট, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির মাধ্যমেই শেষ হয়। এমনকি ৫০ লাখের ঘোষণা দেওয়া হলেও পরবর্তীতে তা মাত্র ৩৬ লাখের নিকট প্রদান করা হয়। করোনা মহামারির সময়েও সরকার ব্যাটারিচালিত রিকশা উচ্ছেদের ঘোষণা দিয়ে লাখ লাখ শ্রমিকদের পথে বসাতে চলেছে। অথচ সরকার ব্যাটারিচালিত এসকল রিকশা, ভ্যান ও ইজিবাইক বিক্রিতে কোন বাধা দেয়নি, এমনকি এখনও শো-রুম খোলে প্রকাশ্যে এসব পরিবহন বিক্রি হচ্ছে। দরিদ্র জনগণ সহায় সম্বল বিক্রি করে, এনজিও থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যান-ইজিবাইক কিনে যখন আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন তখন সরকার যানজট ও দুর্ঘটনার অজুহাত তুলে এই বাহনগুলো উচ্ছেদ করতে চাচ্ছে। শহরের যানজটের মূল কারণ হচ্ছে অপরিকল্পিত সড়ক ব্যবস্থাপনা, অবৈধভাবে রাস্তা দখল, অবৈধ পার্কিং ও সড়কে প্রাইভেট গাড়ির দৌরাত্ম্য। সরকার শ্রেণিস্বার্থে এর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করে গরিব মানুষের উপর খড়গহস্ত হয়েছে।

চা বাগান অধ্যুষিত শমসেরনগর এলাকায় বেড়ে উঠা মফিজ আলী শৈশবকাল থেকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে চা শ্রমিকের দুঃখ কষ্ট, নির্যাতন নিপীড়ন প্রত্যক্ষ করেন। তাই যখন তিনি চা শ্রমিকদের মধ্যে কাজ শুরু করেন, তখন ভিন্ন ভাষাভাষী, ভিন্ন জাতপাত; সর্বোপরি ভিন্ন সংস্কৃতির চা শ্রমিকদের নিকট মফিজ আলী খুব সহজেই তাদের একজন হয়ে উঠতে পারেন। ১৯৬৪ সালের ৫ এপ্রিল শমসেরনগরে খেদন ঠাকুরের দালানে বিপুল সংখ্যক চা শ্রমিক প্রতিনিধির উপস্থিতিতে মফিজ আলীর নেতৃত্বে চা শ্রমিকদের সংগ্রামী সংগঠন “পূর্ব-পাকিস্তান চা শ্রমিক সংঘ” গঠিত হয়; যা মফিজ আলীর রাজনৈতিক জীবনে যুক্ত করে নতুন মাত্রা। ইউনিয়ন গঠনের পর প্রথম সর্বাত্মকভাবে ১৯৬৪ সালে চা শ্রমিকরা মে দিবস পালন করে। সে সময় চা শ্রমিকদের মে দিবসের ছুটি ছিল না। ৩রা মে ১৯৬৪ চা শ্রমিকরা মহান মে দিবস উপলক্ষে শমসেরনগরে এক বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেই সমাবেশে অ্যাডভোকেট মনির উদ্দিন আহমদ, আসদ্দর আলী, রাজা সাহেব প্রমুখ নেতৃবর্গ উপস্থিত ছিলেন। মে দিবসের লাল পতাকাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে শুরু হয় ইউনিয়নের কার্যক্রম। তার পর থেকে প্রতি সপ্তাহে অ্যাডভোকেট মনির উদ্দিন আহমদ সিলেট থেকে শমসেরনগর গিয়ে মফিজ আলীর সাথে চা শ্রমিকদের সংগঠিত করতে বাগানে বাগানে ঘুরেছেন। সেই সময় মাইলের পর মাইল পায়ে হেটেই চা বাগানে তাঁদের কাজ করতে হতো।

আপোষহীন নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে চা শ্রমিক সংঘ শ্রমিকদের নিকট ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে, দলে দলে শ্রমিকরা মালিক পক্ষের স্বার্থরক্ষাকারী সোলেমানের নেতৃত্বে আপোষকামী দালাল ইউনিয়ন ত্যাগ করে চা শ্রমিক সংঘের পতাকাতলে সমবেত হতে থাকে। মফিজ আলীর নেতৃত্বে চা শ্রমিক সংঘের দুর্বার অগ্রযাত্রা মালিক পক্ষ ও দালাল ইউনিয়নের ভিত কাঁপিয়ে তোলে। আবারও শুরু হয় মালিক পক্ষ ও দালাল গোষ্ঠীর সমন্বিত ষড়যন্ত্র চক্রান্ত এবং আক্রমণ। সিরাজনগর চা বাগানে মফিজ আলীকে আক্রমণ করার জন্য ভাড়া করা হয় সন্ত্রাসী দই আলী ও তুষান গ্যাংদের আর শমসেরনগর চা বাগানে ইংরেজ ম্যানেজার মফিজ আলীর নামে মিথ্যা মামলা দায়ের করেন। ঐ মামলার হাজিরার দিন বিভিন্ন বাগানের প্রায় ১০ হাজার চা শ্রমিক শমসেরনগরে সমবেত হয়ে পায়ে হেঁটে মিছিল করে মৌলভীবাজার যাত্রা করে এবং কোর্ট প্রাঙ্গণে শিশু পার্কে এক বিক্ষোভ সমাবেশ করে। মিছিলের সংবাদ পেয়ে আদালত অগ্রিম মফিজ আলীর জামিন দেন।

মফিজ আলীর মতো নেতৃত্বের শূন্যস্থান সহজে পূরণ হবার নয়। চা-শ্রমিকরা আজ দালাল চা-শ্রমিক ইউনিয়নের কাছে জিম্মি, আর চা-শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা মালিকদের কাছে দাসখত দিয়ে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত। যার কারণে ইউনিয়নের নেতাদের বাড়ি-গাড়ি, অর্থ-বিত্ত বাড়লেও শ্রমিকদের মজুরি বাড়ে না। এমনকি ২০২০ সালেই দৈনিক ১২০ টাকা মজুরির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও তারা মজুরি বৃদ্ধি জন্য পদক্ষেপ না নিয়ে মালিকদের কাছে অনুনয় বিনয় করতে থাকে। এই করোনাকালে যখন সারাদেশের শিল্পাঞ্চল বন্ধ ঘোষণা করা হয় তখনও চা-শ্রমিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উৎপাদনে সক্রিয় ছিলেন। অথচ চা-শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির বেলা মালিকরা করোনাকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করাতে পিছপা হচ্ছে না। দালাল নেতারা ৩০০ টাকা মজুরি করার কথা শ্রমিকদের মধ্যে প্রচার করলেও এখন মালিকদের সাথে আলোচনায় দৈনিক ১২০ টাকা মজুরি করতে পারাকেও তারা সাফল্য বলছে। আবার তারাই মজুরি বোর্ডের প্রস্তাবিত দৈনিক ১২০ টাকার মজুরিতে স্বাক্ষরদানে বিরত থেকে নাটক করেছে। মালিকদের স্বার্থরক্ষাকারী সরকারের গঠিত মজুরি বোর্ড চা-শ্রমিকদের দৈনিক ৬৭০ টাকা মজুরিসহ ১১ দফা দাবি উপেক্ষা করে ১২০ টাকা মজুরির সুপারিশ সরকারের নিকট পেশ করেছে। ১২০ টাকা মজুরির মেয়াদ গত বছরের ডিসেম্বরেই শেষ হয়ে গেছে। অথচ করোনা ঝুঁকি উপেক্ষা করে চা-শ্রমিকদের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের কারণে চা উৎপাদন ক্রমাগত বাড়ছে, স্বাভাবিক কারণে কোম্পানির মুনাফাও হয় অনেক বেশি। মজুরি চুক্তির মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ায়, বর্তমান দ্রব্যমূল্যের মাত্রাতিরিক্ত ঊর্ধ্বগতি ঘটায় এবং কোম্পানির অধিক মুনাফা অর্জনের প্রেক্ষাপটে যখন মজুরি বৃদ্ধির দাবি জোরালোভাবে তুলে ধরে যৌক্তিক মজুরি চুক্তি সম্পন্ন করার কথা তখন চা-শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা ইউনিয়নের আগামী নির্বাচনে কে কিভাবে আখের গোছাবে তা নিয়ে ব্যস্ত। এমনকি চুক্তিতে চা-শ্রমিকদের গ্র্যাচুয়েটি, গ্রুপ বীমা চালু করার সিদ্ধান্ত থাকলে তারা তা বাস্তবায়নে কোন ভূমিকা নেয়নি।

কেবল তাই নয় শ্রমআইনের ২৩৪ ধারায় কোম্পানি লভ্যাংশের ৫% অংশগ্রহণ তহবিল ও কল্যাণ তহবিলে প্রদান করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও মালিক গোষ্ঠী শ্রমিকদের বিরত করে চলছে, দালাল নেতৃত্বও নীরবতা পালন করে মালিকের স্বার্থ রক্ষা করে চলেছে। দালালদের এই শ্রমিকস্বার্থ বিরোধী তৎপরতা বিপরীতে শ্রমিকস্বার্থে ভূমিকা গ্রহণকারী নেতৃত্বের উপর মালিকপক্ষ, দালাল নেতৃত্ব ও সরকার সমন্বিত হয়ে আক্রমণ চালায়। সিলেটের মালনীছড়া চা-বাগান, কালাগুল চা-বাগান ও মৌলভীবাজারের সুনছড়া চা-বাগানে শ্রমিক স্বার্থে ভূমিকা নেওয়া নেতৃত্বের উপর আক্রমণ করে বিপর্যস্ত করার প্রচেষ্টা চালিয়েছে। ইতিহাসের অমোঘ সত্য যত আক্রমণই আসুক প্রকৃত শ্রমিক নেতৃত্বকে স্তব্ধ করা যাবে না।

বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী এই জননেতা জীবনে ৭ বার জেল খাটেন। তার মধ্যে ১৯৬৫ সালে ডিসেন্ট রোলস অব পাকিস্তান আইনে তাকে গ্রেপ্তার করে কুমিল্লা পাকিস্তান কারাগারে এক বছর আটকে রাখা হয়। সেসময় প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা, নানকার আন্দোলনের নেতা কমরেড অজয় ভট্টাচার্যের সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠে। কমরেড অজয় ভট্টাচার্যের নিকট হতে তিনি মার্কসবাদ সম্পর্কে আরও গভীর জ্ঞান লাভ করেন এবং ক্রুশ্চেভ সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ হন। যার কারণে মফিজ আলী কমরেড অজয় ভট্টাচার্যকে তার রাজনৈতিক শিক্ষাগুরু বলে স্বীকার করতেন। কমরেড অজয় ভট্টাচার্য তার “কুলিমেম” উপন্যাস মফিজ আলীর নামে উৎসর্গ করেন।

ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তান আমল এবং বাংলাদেশ আমলে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামের ধারাতে ১৯৮৮ সালে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট (এনডিএফ) গঠিত হয়। সে সময় জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট সিলেট জেলা শাখার যুগ্ম-আহবায়ক অ্যাডভোকেট ই ইউ শহিদুল ইসলাম মফিজ আলীকে গণতন্ত্রের নির্ভীক মুখপত্র সাপ্তাহিক সেবা পত্রিকা পাঠাতেন। সময়ের সাথে সাথে সেই সম্পর্ক গভীর হয়ে রাজনৈতিক-সাংগঠনিক সম্পর্কের ধারাতে মফিজ আলী ১৯৭১ সালের যুদ্ধ, সাম্যবাদী দলের সংশোধনবাদী লাইন এবং সাম্রাজ্যবাদের দালাল রাজনৈতিক দল ও সরকারের প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতা সারসংকলন ও পূনঃমূল্যায়নের মাধ্যমে আত্মসমালোচনা ও আত্মশুদ্ধি করে রাজনৈতিক জীবনকে পুনরুদ্ধার এবং আমৃত্যু শ্রমিক কৃষক মেহনতি জনগণের পক্ষে আত্মনিবেদন করার প্রত্যয়ে ১৯৯৩ সালে সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে অগ্রসর করার লক্ষ্যে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট-এ যোগদান করেন। জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের মৌলভীবাজার জেলা শাখার সংগঠক এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে আমৃত্যু তিনি সংগঠন সংগ্রাম বিকাশের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখেন। একই সাথে তিনি ফ্রন্টের শরিক সংগঠন বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি ও মৌলভীবাজার জেলা শাখার সভাপতি হিসাবে চা রাবার, হোটেল, রিকশা, দর্জি শ্রমিকদের সংগঠিত করতে ভূমিকা রাখেন। এ প্রক্রিয়ায় তিনি চা শ্রমিকদেরকে পুনরায় বিপ্লবী ধারায় সংগঠিত করার জন্য চা শ্রমিক সংঘ গড়ে তোলাসহ চা ও রাবার শ্রমিকদের আন্দোলন সংগ্রাম পুনর্গঠিত করায় আত্মনিয়োগ করেন।

বৃদ্ধ বয়সে তার এই নব উদ্যোগ চা শিল্পে আপোষহীন সংগঠন সংগ্রামের নতুন যাত্রা শুরু হয়। এ প্রেক্ষিতে ২০০৮ সালের জুলাই মাসে জরুরি অবস্থায় চা শ্রমিকদের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে তিনি আশান্বিত হয়েছিলেন। তার আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং অসমাপ্ত কাজ প্রগতিশীল শ্রমিক সংগঠন, চা শ্রমিক, শ্রমিক শ্রেণিকে অগ্রসর করে সফল করার মহান দায়িত্ব পালন করতে হবে। তার এই দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের পরিক্রমায় ঘাত-প্রতিঘাত, চড়াই-উৎরাই, উত্থান-পতন থাকলেও শেষ পর্যন্ত তিনি এদেশের শ্রমিক কৃষক মেহনতি জনগণের একজন অকৃত্রিম বন্ধু হিসাবে বিপ্লবী বিকাশ ধারাতে সম্পৃক্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। যখন তার আত্মউপলব্ধি হয়েছে তখন তিনি তার সংশোধনবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থান ত্যাগ করেছেন। এক্ষেত্রে তার মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল না। এদেশের জনগণের মূল শত্রু হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও আমলা মুৎসুদ্দি পুঁজি। তিনি বিশ্বাস করতেন শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে শ্রমিক-কৃষকের মৈত্রীর ভিত্তিতে বল প্রয়োগের মাধ্যমে এদেশ থেকে সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ, আমলা মুৎসুদ্দি পুঁজিবাদকে উচ্ছেদ করে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করতে হবে। সে লক্ষ্যে তিনি মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত শ্রমিক কৃষককে সংগঠিত করতে আত্মনিয়োগ করেন।

মফিজ আলীর জীবনের আরও একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি শ্রমিক কৃষকের বিভিন্ন সমস্যা ও দাবি দাওয়া নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী লেখনীর মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করার চেষ্টা চালান। তিনি ইংরেজি ডন, বহুল প্রচারিত সংবাদ, ইত্তেফাক, সাপ্তাহিক জনতা, লালবার্তা প্রভৃতি পত্রিকায় লেখালেখি করতেন। তিনি গণতন্ত্রের নির্ভীক মুখপত্র সাপ্তাহিক সেবার একজন নিয়মিত লেখক ছিলেন। এছাড়াও তার প্রবন্ধ, লেখা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ম্যাগাজিন, স্মারকগ্রন্থ ইত্যাদিতে প্রকাশিত হয়েছে। এখনও তার অনেক লেখা অপ্রকাশিত আছে।

মফিজ আলী আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তার মতাদর্শ, রাজনীতি, সংগঠন সংগ্রাম আমাদের পাথেয়। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক বিপ্লবী বিকল্প ধারার সংগঠন ও তার নেতাকর্মী এবং জনগণকে এই মহান নেতার অসমাপ্ত দায়িত্ব পালনের শপথ নিয়ে অকুতোভয়ে অগ্রসর হতে হবে। জাতীয় ও জনজীবনের বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতিতে মফিজ আলীর জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালাল শাসক শোষক শ্রেণির বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তুলে মফিজ আলীর অসমাপ্ত কাজ অর্থাৎ জাতীয় গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে বেগবান করার মাধ্যমেই তার প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা নিবেদন সম্ভব।

অনন্য আদিত্য: রাজনৈতিক কর্মী। ইমেইল: [email protected]

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.