Sylhet Today 24 PRINT

গোলাপগঞ্জের ‘গোলাপ’!

সালেহ আহমদ খসরু |  ২২ এপ্রিল, ২০২২

‘খান বাড়ির’ মানবিক কর্মের সুনাম এমনিতেই চলমান। ধর্মকর্ম করেন সকলেই, মরহুম কমর উদ্দিন আহমদ খান ও বেগম লুৎফুন্নেছা খান যে শিষ্টাচারে পরিপূর্ণ ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ রেখে গিয়েছিলেন তার অণু-রেণু ছড়িয়ে আছে তাঁদের বহমান অস্থিমজ্জা জুড়ে।

মহান রব আল্লাহ পাকের ইচ্ছেতে কমর উদ্দিন আহমদ খান বেশিদিন পৃথিবীতে ছিলেন না।  কিন্তু বেগম লুৎফুন্নেছা খান তাঁর সাত ছেলে ও এক মেয়েকে আঁচল দিয়ে আগলে রেখে থেমে যাননি, বরং সকলের একাডেমিক শিক্ষা এবং মূল্যবোধ সুনিশ্চিত করতে কদম-কদম নিবিড়ভাবে যেমন চোখের আড়াল করেননি তেমনি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে কালক্ষেপণ করেননি। তাই আজ তাঁরা কেউ ব্যাংকার-ডাক্তার-উকিল-সামরিক বাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তা-ঔষধ ব্যবসায়ী-প্রবাসী; কিন্তু একজনও বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির বাইরে নয়। এমন আলোকিত পরিবারে আলোর ধারা বইবে এটাই মানুষ আশা করে, এবং সেই বিশ্বাসে তারা চলমান ও অবিচল।

প্রবাসী ভাই শরীফ উদ্দিন আহমদ খান যুক্তরাজ্যে হতে এসে ঘুরে গেলেন গত মার্চ মাসে, অবসর কাটানোর সময় যেন তাঁর ছিলো না। গড়ে তোলা 'কমর উদ্দিন খান ও লুৎফুন্নেছা ফাউন্ডেশন' যা পিতামাতার নামে-সেটি সক্রিয় করতে উদ্যমী হয়ে কার্যক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এ লক্ষ্যে ভাই সহযোগী অধ্যাপক ডা. রফিক উদ্দিন আহমদ খান চক্ষু বিশেষজ্ঞ, তিনি তাঁর সহযোগী নিয়ে ব্যাপক আয়োজনে ফ্রি চক্ষু শিবির করেন বিগত ১৭ মার্চ দিনভর। সরকারি ছুটির দিন হওয়াতে চিকিৎসক হতে রোগীর কারোরই মেডিকেল ক্যাম্পে আসতে বেগ পেতে হয়নি। এ আয়োজন যাতে সাধারণের দোরগোড়ায় পৌঁছে সে আয়োজনেও কমতি ছিলো না; মাইকিং করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রচার করা হয় যাতে শেকড়ের সব মানুষের কানে পৌঁছে এ উদ্যোগ। এমন উদ্যোগে শতাধিক নারী-পুরুষ এবং শিশু পর্যন্ত এসে চিকিৎসা নিয়ে যান গোলাপগঞ্জের দাড়িপাতনের খান বাড়িতে। চক্ষু শিবির কার্যক্রম উদ্বোধন করেন গোলাপগঞ্জ পৌরসভার মাননীয় মেয়র আমিনুল ইসলাম রাবেল; শত ব্যস্ততা এড়িয়ে মানবিক কাজে নিজের হাত প্রসারিত করেন। আরও এসেছেন সমাজ কল্যাণ দপ্তরের গোলাপগঞ্জ প্রধানসহ তাঁর সঙ্গীয় অপরাপর কর্মকর্তা।
 
আমি হতে শুরু করে নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেন (অব.) খান বাড়ির আরেক রত্ন গিয়াসউদ্দিন আহমদ খান, মিসেস তাহমিনা সীমা খান। কবি মিসেস নার্গিস জাহান খান আসেননি নাজিমউদ্দীন খান এপ্রিলের ১১ তারিখ ওপেন হার্ট সার্জারি করাবেন সেই প্রস্তুতি নিতে। না হলে কবিতার আড্ডা আরও একটু করে জম্পেশ হতো নিশ্চিত। ছিলেন মিসেস রফিকউদ্দিন আহমদ খান বা শেফা আপা। প্রাঞ্জল মিশুক এবং প্রকৃতি বিলাসী বলেই মনে হলো শেফা বোনকে। আরও ছিলেন ছড়াকার শাহাদাৎ বখত, সাংবাদিক ছড়াকার সাদির মোহাম্মদসহ প্রমুখ গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। জানানো উচিত হবে, ছড়াকার বখত সাহেব খান সাহেবদের মামাতো ভাই।

শত ফুলের খুশবু, আর সকল কাজের মুল ঠিকানা খান পরিবারের অন্যতম দিশারি নাজিমুদ্দিন আহমদ খান। যিনি শারীরিক অসুস্থতা হেতু নিজে উপস্থিত না থেকেও বাকি সকলে যাতে হাজির হন সেজন্য তার হাতের মুঠোফোন সচল রেখেছেন পরম মমতায়। ভাই শফি উদ্দিন আহমদ খান মোহন ও মহিউদ্দিন আহমদ খান মহি ভাই যেন খান বাড়ির এ কোন সে কোন এপার-ওপার করা গোদারা। কখন ঘাটে ভিড়বে তরী, যাত্রী পারাপারে কোথাও কি ব্যত্যয় হলো কি-না তার চুলচেরা নজরদারি করা ফরজ মনে করে যেন ব্যস্ততার রেলগাড়ি। মোহন ভাইয়ের ভোজন গল্প রসের রসিকতায় পৌঁছাতে ব্যস্ত যেমন সকল প্রাণ, তেমনি স্বজন সবে ভাবনার অকুল হয়ে ত্রস্ত হরিণের মতো ঘুরেফিরে একই কথা, পরিমিত খাওয়া দাওয়া করবে বেশ- কিন্তু আজ পরিমিত হতেই হবে তা কে বললো!  এবং সে নিজের জন্যে যতোখানি সকলের জন্যও অতোখানি।  স্ত্রী সন্তানদের তরে তারচেয়ে বেশি কথা হলো—হালাল সব খেতে হবে তবেই তো শক্তিশালী শরীর ভবিষ্যতে স্থিতিশীল জীবন দেবে, এমন হরেক রঙ মাখানো বাতচিত।

মহি ভাই পানের রসে আস্বাদিত ঠোঁট ও চকমকে চোখে ঝিলিক দিয়ে বললেন—হু, কিছু মোটা হয়েছি! কী বলেন! এমন সাবলীল প্রশ্নের উত্তর কী হতে পারে!  হয়, যখন হয় তখন সবটুকু তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বলতেই হয়—হ্যাঁ, একটু তাজা সরস লাগছে বটে! এমন সচলায়তনে মনে পড়ছে খান বাড়ির প্রধান খান সিরাজ উদ্দিন আহমদ খান সাহেবের কথা।  যিনি কোভিড-১৯ এর ভয়ঙ্কর ক্রান্তিলগ্নে যুক্তরাষ্ট্র হতে এসে ঘুরে গেছেন প্রিয় স্বদেশ৷ ছেলের বিয়ে দিয়েছেন, আমন্ত্রণ জানিয়ে খুব করে বলেছিলেন যেতে। কিন্তু আমি তখন করোনা হতে সদ্যস্নাত নতুন জীবন পেয়ে ক্লান্তি ও ভয় মিশ্রিত দিনাতিপাত করছি, যাওয়া হয় নি। আবার আসুন বড় ভাই, নিশ্চয়ই অনেক কথা হবে, ভাব হবে ভাবের রাজ্যে ইনশাআল্লাহ।   

এমন মহতী উদ্যোগে পরিবারের অন্যান্য আত্মীয়স্বজন এবং দেশে থাকা তাদের নতুন প্রজন্মের মেলা বসে। এ যেন সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয়ের সেতুবন্ধন, দিগন্ত হতে দিগন্তে রঙধনুতে আবির রেখা। বলে যায় কয়ে যায় করে যাও সব/ আগামী ঊষা রাঙাবো মোরা নিলাম শপথ। উপস্থিত সব তারুণ্যের আঁখি মাঝে আমি দেখেছি তাদের পূর্বপুরুষের করে দেওয়া পথে হাঁটার দৃপ্ত পদচ্ছাপে এগুনোর ইঙ্গিত।

ইতোমধ্যে খান বাড়ির 'আশার আলো' আশা আপার  হাতের সুস্বাদু দুপুরের  ভোজন পর্ব শেষ করে বাচ্চাদের নিয়ে বিকেলে ছুটে যাই সুরমা নদীর কলতান শুনবো বলে।  নদীর বুকে নৌকায় বসে মিসেস গিয়াসউদ্দিন খান ও মিসেস রফিকউদ্দিন খানসহ ছেলেমেয়েদের নিয়ে গান কবিতায় মোহনীয় বিকেল কাটিয়ে সব পাখি যেমন নীড়ে ফিরে যায় তেমনি আমরাও ঘরে যেতে ফিরে চলি। সন্ধ্যা তাঁরা ফোটার সাথে ঘর হয়ে ওঠে বর, যাকে কেউ ফেরায় না—আমরাও নই।

ফেরার পথে ভাবছিলাম তাঁদের কথা, বাচ্চাদের অনুভূতি যা আমার মনকে নাড়িয়েছে সন্দেহ নেই। এবং এজন্যই বলতে পারি মরহুম কমর উদ্দিন খান ও বেগম লুৎফুন্নেসা  ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম এগিয়ে যাচ্ছে, আরও দুর যাবে, রেখে যাবে চিহ্ন। কারণ এমন রত্নগর্ভা যিনি সাত ছেলে এক মেয়েকে একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি মানবতার ধর্মে দীক্ষিত করে যান, তিনি কেবল রত্নগর্ভা নয় বরং ঝলমলে সপ্তর্ষিমণ্ডলের রাণী তারকা—যার আলোয় উদ্ভাসিত দাড়িপাতন।  

জীবন তুমি জীবনই নয় যদি না আদর্শিক কাজের চিহ্ন রেখে যেতে পারো, সারাদিনের সকল কাজ দেখে আমি নিঃশঙ্ক চিত্তে বলে দিতে পারি—এ প্রজন্ম খান বাড়ির সুনামে নতুন নতুন পালক যোগ করে দিয়ে গঠিত ফাউন্ডেশন এ অঞ্চলে নতুন মাইলফলক স্থাপন করবে বলে মন সায় দেয়। এবং তাকালে দেখা যায় পরবর্তী প্রজন্মেও উচ্চ শিক্ষিতদের ধারা বহমান।

যেমন খান বাড়িতে এই প্রজন্মে আছেন মেজর ডা. আহমদ নিবরাস খান। আহমদ শিহাব খান, পিএইচডি অনগোয়িং- সাউথ ক্যারোলাইনা ইউনিভার্সিটি,কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। শারমিন আহমদ খান, ইউ কে; আহমদ ফারহান খান, ইউ কে; আহমদ ফরহাদ খান (জামি) ইউ এস এ; নওশীন জাহান খান এমবিএ, আইবিএ- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বর্তমানে একটি ব্যাংকে নির্বাহী পদে দায়িত্ব পালন করছে; মাইশা তামান্না খান, অর্থনীতিতে মাস্টার্স করছে কেন্ট ইউনিভার্সিটি, ইউএসএ; মাহিয়া তামান্না খান, এমবিএ/ আইবিএ গোল্ড মেডালিস্ট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; আনজুম আন্নি খান, এমবিবিএস, সিলেট ওমেন্স  মেডিকেল কলেজ; আসিফ আহমদ খান অয়ন, শাবি; বখতিয়ার আহমদ খান, পরিসংখ্যান (সম্মান) এমসি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ; নাফিস আহমদ খান, ডেন্টাল, ওসমানী মেডিকেল কলেজ; রামিসা তাসমিয়া খান, এমসি কলেজ হতে এবার এইচএসসি পাস করে ভর্তিযুদ্ধের অপেক্ষায়। এই ধারাবাহিকতায় বাকিসব আরও নতুন তাঁরা ফুটছে, চকমক করবেই রাতের আকাশে এবং এরাই হবে ভোরের সূর্যোদয়। আরও যাদের নাম আনতে আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি এই মুহূর্তে—এমন তারকাদের মেলা বসবে আগামী পূর্ণিমায়, সেই বিশ্বাস ওদের দেখেশুনে মন বলে দিলো।

এই নতুনের কেতন উড়ুক এ প্রত্যাশা যেমন আছে, তেমনি ওড়ানোর সব সক্ষমতা অর্জন করবেই এঁরা। তাই মনে হয়, মন বলে এবং সায় দেয় পঞ্চইন্দ্রিয়। হ্যাঁ সর্বোপরি এজন্যই করবে, কারণ দেয়ার বাসনায় উদ্দীপ্ত এই পরিবার দিতে চায় বেশি এবং নিতে চায় কেবল মহান রবের করুণা। খান সাহেবদের সাথে আলাপচারিতায় জানা গেল কেবল চক্ষুশিবির নয়, অপরাপর বিষয় নিয়েও মেডিকেল ক্যাম্প এবং আর্তমানবতার কাজ করতেই এই ফাউন্ডেশন, কিন্তু কোন রাজনৈতিক অভিলাষ একেবারেই নয়, না নয়। তাই মন সায় দেয় এই ফাউন্ডেশন গোলাপগঞ্জের গোলাপ হয়ে সৌরভ ছড়াবেই। আল্লাহ পাক দুই পরহেজগার প্রয়াত আত্মার জান্নাতুল ফেরদৌস নসীব করুন আ-মিন।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.