Sylhet Today 24 PRINT

‘আত্মহত্যার পরিবর্তে তুমি এক কাপ চা খাও’

দেবাশীষ দেবু |  ০৪ জুন, ২০২২

চা যেনো স্বর্গীয় সোমরস, এমনটি মনে হয়েছিলো নজরুলের। লিখেছেন- ‘চায়ের পিয়াসী পিপাসিত চিত্ত আমরা চাতক দল/ দেবতারা কন সোমরস যারে সে এই গরম জল’। আর চায়ের সাথে প্রেয়সীরও সঙ্গ চাওয়া কবির সুমন গেয়েছেন- ‘এক কাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই’।

চা এমনই এক পানীয়- যাতে চুমুক দেয়ার সময় প্রেয়সীর কথা মনে হয়, মনে হয় স্বর্গীয় সোমরসের কথা। পানির পরই যা হয়ে ওঠেছে বিশে^র সবচেয়ে জনপ্রিয় পানীয়। সর্বজনের পানীয়। গ্রামের টং দোকান থেকে পাঁচতারকা হোটেল, ভাঙা কুঠির থেকে আলীশান বাড়ি- সবখানেই চায়ের সরব ও সগর্ব উপস্থিতি। ঘুম থেকে উঠে এক কাপ ধুমায়িত চায়ে চুমুক দেয়া ছাড়া এখন তো দিনশুরুর কথা ভাবাই যায় না। আজ হয়ে ওঠেছে বাঙালির জীবনেরই অংশ।

আজ জনপ্রিয়তম এই পানীয়টির দিন। আজ জাতীয় চা দিবস। দেশে দ্বিতীয়বারের মতো পালিত হচ্ছে এই দিবস। এবারের দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয়- ‘চা দিবসের সংকল্প, সমৃদ্ধ চা শিল্প’। চা নিয়ে বিশ্বব্যাপী আরেকটি দিবসও উদযাপন করা হয়। সেটি ২১ মে- ‘আন্তর্জাতিক চা দিবস’।

১৯৫৭ সালের ৪ জুন প্রথম বাঙালি হিসাবে চা বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই দিনটিকে স্মরণ করে গতবছর থেকে ৪ জুন জাতীয় চা দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে।


চীন থেকে ভারতে চা

‘রসিককৃষ্ণ বললেন, দিস ইজ টি। রাধনাথ, তুমি চায়ের কথা শোন নাই? আগে চিন দেশ থেকে এ বস্তু আসতো। এখন আমাদের আসামেই যথেষ্ট হচ্চে।

...রামগোপাল দ্বিতীয় একটি বাটিতে প্যারিচাঁদের জন্য চা ঢালতে ঢালেতে বললেন, নেশা হয় বৈকি। এর এক চুমুকেই পঞ্চন্দ্রিয়ে একটা এলার্টনেস এসে যায়। লাইক কিসিং এ ড্যামেজল... এন্ড ইউ ওয়ান্ট টু কিসিং এগেইন... এই নাও প্যারী, আজ আমি তোমায় নতুন সুধারসে দীক্ষা দিলাম।

...প্যারিচাঁদ বললেন, আমি বলি কি, এবার থেকে আমরা এই বস্তুই পান করবো। শুধু শুধু সুরা পান করে স্বাস্থ্যের ক্ষতি করা কেন? সর্বনাশী সুরা যে দেশটারে ছারখার করে দিচ্চে।’

এই গল্প সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সেই সময়’ উপন্যাসের।

তখন চীন থেকে ভারতের আসামে চা চাষ শুরু হচ্ছে। বৃটিশদের অনুকরণে বাঙালি অভিজাত সমাজ এই পানীয়ের সাথে পরিচিত হয়ে ওঠছে। নাকসিঁটকানোও আছে অনেকের। আছে বিস্ময়ও। তবু বিস্তার লাভ করছে চা। এই কাহিনী সেই সময়ের। এই গল্পের রাধানাথ মানে রাধানাথ শিকদার। যিনি মাপজোক করে প্রথম জানিয়েছিলেন মাউন্ট এভারেস্টই পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্ঘ।

ঐতিহাসিক মতে, সপ্তদশ শতকে চীন থেকে ভারতবর্ষে চা নিয়ে আসে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এই কোম্পানিটি স্কটিশ উদ্ভিদ বিজ্ঞানী রবার্ট ফরচুনকে নিয়োগ করে চা গাছ সংগ্রহ ও ভারতবর্ষে তা নিয়ে আসার জন্য। নিয়োগ পাওয়ার পর গোপনে চীনে যান রবার্ট ফরচুন। সেখান থেকে তিনি ২০,০০০ চা গাছ দার্জিলিং-এ পাচার করেন। সেবি থেকে ভারতবর্ষে শুরু হয় চায়ের চাষ।

১৮২৬ সালে আসাম পূর্ণ ব্রিটিশ অধিকারে আসে। এরপর রবার্ট ব্রুসের ভাই চার্লস ব্রুস আসামে চা বাগান গড়ে তুলেন। আর ভারতীয়দের মাঝে প্রথম চা বাগান গড়ে তুলেন মণিরাম দেওয়ান। ১৮৫৮ সালে সিপাহী বিদ্রোহী জড়িত থাকার অভিযোগে যাকে ফাঁসি দেয় ব্রিটিশরা।

দেশে চায়ের উৎপাদন ও  বৈচিত্র্য

চা বোর্ডের হিসেব মতে, গত বছর দেশে ৯৬ দশমিক ৫১ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন হয়েছে। এর মধ্যে দেশের উত্তরাঞ্চলে রেকর্ড ১৪ দশমিক ৫৫ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন করা হয়েছে। দেশে এখন বৃহৎ চা বাগানের সংখ্যা ১৬৭টি এবং ক্ষুদ্রায়তন চা বাগানের সংখ্যা আট হাজারের বেশি।

জাতীয় চা দিবস উদ্যাপন উপলক্ষ্যে গত বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সী বলেন, চায়ের নতুন ও উন্নত জাত উদ্ভাবনে গবেষণা বাড়ানো হয়েছে। কৃষকদের চা চাষে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। এতদিন শুধু দেশের পাহাড়ি অঞ্চল অর্থাৎ চট্টগ্রাম, মৌলভীবাজার ও সিলেটে চা উৎপাদিত হতো, এখন দেশের উত্তরাঞ্চল পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও ও লালমনিরহাটের সমতল ভূমিতেও চা উৎপাদিত হচ্ছে। এতে অন্য ফসল চাষে অনুপযোগী জমিগুলোতে চা উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে ও দেশে চা শিল্পের বিপুল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে আমরা দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে বিপুল পরিমাণ চা রফতানি করতে পারবো।

১৯৫৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ চা গবেষণা কেন্দ্র (বিটিআরআই)।  এখন পর্যন্ত উচ্চফলনশীল ও গুণগত মানসম্পন্ন ২১টি ক্লোন ও পাঁচটি বীজজাত চা উদ্ভাবন করেছে বিটিআরআই।

বিটিআরআইয়ের তথ্যমতে, আর্টিজেন চায়ের মধ্যে রয়েছে প্রিমিয়ার ব্ল্যাক টি, অর্থোডক্স টি, বিশেষায়িত গ্রিন টি, হোয়াইট টি, ইয়েলো টি, হোয়াইট পিওনি টি, ওলং টি। এছাড়া ফ্লেভারযুক্ত চায়ের মধ্যে রয়েছে সাতকড়া টি, লেমন টি, আদা টি, মাসলা টি (জিরা, দারচিনি, লবঙ্গ, এলাচ), আর্লগেরি টি (তুরস্কের সাইপ্রাস ফল), জেসমিন টি, রোজ টি, তুলসী টি, পুদিনা/মিন্ট টি, স্টিভিয়া টি, সজনে টি, পাইনঅ্যাপল টি ও আমলকী টি।

বাংলাদেশ চা গবেষণা ইন্সটিটিউটের প্রাক্তন পরিচালক ড. মাঈনউদ্দিন জানান, ‘আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত ২১টি চা গাছের ভ্যারাইটি বের করা হয়েছে, যেগুলো বিটি-১ (বাংলাদেশ টি), বিটি-২ এমন বিভিন্ন নামে আছে।’

সিলেট ও চা

বাংলাদেশে চায়ের প্রসঙ্গ আসলেই সিলেটের কথা ওঠে আসে। দেশের বেশিরভাগ চা বাগানই এই অঞ্চলে। দেশে বাণিজ্যিকভাবে প্রথম চা চাষও শুরু হয় সিলেটে।

চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ১৮৫৪ সালে সিলেট শহরের অদূরে, বর্তমান বিমানবন্দর সড়কের পাশের টিলাভূমিতে গড়ে ওঠে মালনীছড়া চা বাগান। মালনীছড়ায় ১৫০০ একর জায়গার উপর লর্ড হার্ডসন চা বাগান প্রতিষ্ঠা করেন। তবে ১৯০৫ সালে প্রকাশিত ‘আসাম ডিস্ট্রিক গেজেটিয়ারস, সিলেট’-এ বলা হয়, সিলেটের মালনীছড়ায় প্রথম বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু হয় ১৮৫৭ সালে।

এই বাগানের মাধ্যমে এই অঞ্চলে প্রথমবারের মতো বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু হয়। এর মধ্য দিয়ে দেশে চা শিল্পের যাত্রা শুরু। এই বাগানটি এখনও রয়েছে। বৃটিশ মালিকানা বদলে এখন বাঙালি মালিকানায়ই পরিচালিত হচ্ছে মালনীছড়া চা বাগান। বহু ইংরেজ, পাকিস্তানি ও বাংলাদেশি ব্যবস্থাপকের হাত ঘুরে ১৯৮৮ সাল থেকে এটি ব্যক্তিগত মালিকানায় পরিচালিত হচ্ছে।  মালনীছড়া এখনও দেশের বৃহত্তম চা বাগান।

মালনীছড়ার সাফল্যের পর ১৮৬০ সালে হবিগঞ্জের লালচাঁন্দ চা বাগান ও মৌলভীবাজারের মির্তিঙ্গা চা বাগানে চায়ের বাণিজ্যিক চাষ শুরু হয়। সিলেট বিভাগের এই তিন জেলায়ই রয়েছে চা বাগান। বিভাগের মধ্যে কেবল হাওড়প্রধান সুনামগঞ্জেই কোনো চা বাগান নেই।

বর্তমানে দেশে উৎপাদনে আছে ১৬৭টি চা বাগান। যার মধ্যে ১৩৫টি চা বাগানই সিলেট বিভাগে। বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চা বাগান রয়েছে ম্যেলভীবাজার জেলায়। এই জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলাকে বলা হয় চায়ের রাজধানী। এছাড়া চট্টগ্রামে বাগান রয়েছে ২১টি। এখন উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলার সমতল এলাকায়ও গড়ে তোলা হয়েছে চা বাগান।

‘আত্মহত্যার পরিবর্তে তুমি এক কাপ চা খাও’

সিলেটে হঠাৎ করে বেড়ে গেঝে আত্মহত্যার ঘটনা। শুক্রবার রাতেই সিলেট নগরের উপশহরে দশম শ্রেণীর এক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে। এরআগে গত ২৫ সিলেট এমসি কলেজের ছাত্রী স্মৃতিরানী দাস ও ২৭ মে একই কলেজের ছাত্র সৌরভ দাস রাহুল আত্মহত্যা করেন। এরপর গত ২৯ মে সিলেটের গোলাপগঞ্জে নবম শ্রেণির ছাত্রী আয়েশা সিদ্দিকা ও ৩০ মে সদর উপজেলার মইয়ারচর এলাকার নাজমিন আক্তার নামের এক গৃহবধূ আত্মহত্যা করেন।

সিলেট জেলা পুলিশের তথ্য অনুযায়ি, ২০১৮ থেকে ২০২১ পর্যন্ত সিলেট জেলায় আত্মহত্যা করেছে ৩৯৬ জন। এরমধ্যে ২০২০ সালে ৯৩টি, ২০২১ সালে ৯৯টি ও ২০২২ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত ৩০টি আত্মহত্যা সংগঠিত হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হতাশা, একাকিত্ব, করোনাকালীন বিষাদ, আর্থিক সংকট, প্রেম ভেঙে যাওয়াসহ নানা কারণে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে।

স্বেচ্ছামৃত্যুর প্রসঙ্গ থাক। আজ চা দিবসে চায়ের প্রসঙ্গেই ফেরা যাক। কবি সরকার আমিনের একটি কাব্যগ্রন্থের নাম- ‘আত্মহত্যার পরিবর্তে তুমি এক কাপ চা খাও’। এই নামে একটি কবিতাও আছে বইটিতে। যাতে আত্মহত্যার ইচ্ছে জাগলে এক কাপ চা খেয়ে নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন কবি। এ কবিতায় তিনি আ্রও লিখেছেন- ‘আত্মহত্যার পরিবর্তে তুমি তোমার প্রেমিকাকে কাছে টানো/ বুকে মুখ লুকাও, অদূরবর্তী ঠোঁটে আদর করো লাম্পট্য ভুলে’।

যারা বিষাদে ভূগছেন, যাদের মনে হচ্ছে এ জীবন রেখে আর কী লাভ? যাদের ‘এক এক সময় মনে হয়, বেঁচে থেকে আর লাভ নেই’ –তারা এমন বিষন্ন সময়ে একবার এক কাপ চা খেয়ে ট্রাই করে দেখতেই পারেন।

এমন মাদকতাময় যে পানীয়, সে মৃত্যুইচ্ছা ভুলিয়ে দিতেও তো পারে। জাগিয়ে দিতে পারে বেঁচে থাকার স্বপ্ন।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.