Sylhet Today 24 PRINT

আজ প্রেমময় পহেলা আষাঢ়

ইয়াকুব শাহরিয়ার |  ১৫ জুন, ২০২২

মানুষ প্রেমে পড়ে কদমের, বরষার এবং বৃষ্টির রিমঝিম মায়াময়ী শব্দের। কারণ আষাঢ় সকলের ভালোবাসার। আকাশে মেঘেদের আনাগোনা থাকুক কিংবা না থাকুক, বৃষ্টির অঝোর ধারা আসমান হতে বেয়ে পড়ুক কিংবা না পড়ুক আজ প্রেমময় পহেলা আষাঢ়। রুপময় বাংলাদেশের ঋতু পরিক্রমায় আজ আগমন ঘটেছে প্রেমের ঋতু বর্ষার। আজ পহেলা আষাঢ়ের প্রথম দিন। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড খরতাপে দাহ্যমান জনজীবনে শীতলতার পরশ ভোলানোর বারতা নিয়ে আগমন ঘটে বর্ষার। এ উপলক্ষে প্রকৃতি সাজে এক অপরূপ সাজে। ফুল-গাছ-লতাপাতায় নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়৷ এককথায় বলতে গেলে আষাঢ়কে কেন্দ্র করে যেন প্রকৃতিতে বেজে উঠে প্রাণের সঞ্জীবনী গান। এ গান সকলের, সকল জীবের।

আষাঢ় মানুষকে প্রেম শেখায়। ভালোবাসতে শেখায়। হাসতে ও কাঁদতে শেখায়। এ আষাঢ়ের প্রেমে পড়েই হয় তো বৈষ্ণব কবি বিদ্যাপতি তাঁর লেখায় আষাঢ় বন্দনা করেছেন। আষাঢ়ের গভীর আষাঢ়ীয় প্রেমে মত্ত হয়ে হয় তো কালিদাস তাঁর ‘মেঘদূত’ কাব্যগ্রন্থে লিখেছেন-

আষাঢ়ষ্য প্রথম দিবসে মেঘমাসৃষ্ট সানুং
বপ্রক্রীড়া পরিণতগজ প্রেক্ষণীয়ং দদর্শ।

আষাঢ়ে থাকে অবিরাম বৃষ্টি। আকাশের থাকে মন খারাপ। কখন কাঁদে আকাশ আর কখন হাঁসে তার হিসাব কষা দূরুহ। গ্রামের উচ্ছ্বলা গৃহবধূ স্নান শেষে ভিজা কাপড় রোদে শুকাতে দিয় ঘরে যাওয়ার আগেই বৃষ্টির হামলা। অথবা ফর্সা আকাশ দেখে ছাতা ছাড়া ঘর হতে বের হওয়া বৃদ্ধের কাক ভেজা হয় ঘরে ফেরা কিংবা বটবৃক্ষের তলে আশ্রয় নেওয়া। এ আমাদের চিরচেনা গ্রামীণ দৃশ্য। এমনটা ঘটে হরহামেশাই।

আষাঢ় কখন আসে, কীভাবে এলো আষাঢ় শব্দ
১৪২৯ বাংলা সন চলছে। আষাঢ় বাংলা সনের তৃতীয় মাস। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে জুন-জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে আষাঢ় মাস। আষাঢ় নামটি এসেছে পূর্বাষাঢ়া ও উত্তরাষাঢ়া নক্ষত্রে সূর্যের অবস্থান থেকে। এমাসে প্রচুর বৃষ্টি হয়। গ্রীষ্মের দাবদাহ শেষে আষাঢ়ে বৃষ্টির ছোঁয়ায় বাংলার প্রকৃতি যেন প্রাণ ফিরে পায়। নতুন আনন্দে জেগে উঠে প্রকৃতি। গ্রীষ্মের রুদ্র প্রকৃতির গ্লানি আর জরাকে ধুয়ে মুছে প্রশান্তি স্নিগ্ধতা আর সবুজে ভরে তোলে বর্ষা।

আষাঢ় যে শুধু মনে আনন্দের সঞ্চার করে তা নয়, আমাদের জেলা সুনামগঞ্জে আষাঢ় অনেকটা দুঃখের নামও। অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে সৃষ্টি হয় বন্যার। বিপর্যস্ত হয় জনজীবন। কাদা-পানির কারণে জনজীবনে আষাঢ়ে ভোগতে হয় নানান প্রতিবন্ধকতায়ও।

তবুও আষাঢ় আনন্দের। আষাঢ় বৃষ্টি বিলাসের। আষাঢ় উপভোগের। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় যদি একটু বলি-

‘ঐ আসে ঐ ঘন গৌরবে নবযৌবন বরষা,
শ্যাম গম্ভীর সরসা…’

অথবা ফররুখ আহমদের মতো যদি বলি-

‘ঢাকলো আকাশ মেঘে মেঘে
নদীনালা উঠলো জেগে,
হিজল তলায় উঠলো জমে
নিতল, গভীর পানি।

কে যেতে চায় ডাঙা দিয়ে,
লুকিয়ে দেখে বনের টিয়ে
পুঁটি মাছের বিয়ে হবে
সে হবে রাজ-রানী।’

কবিদ্বয়ের আষাঢ় বন্দনায় প্রেম ভেসে উঠে। জেগে উঠে হৃদয়ের গভীরে থাকা আবেগ-অনুভূতি। স্মৃতির আয়নায় ভেসে উঠে শিশু-কৈশোরের রোমাঞ্চকর সময়ের কথা। ছোট বেলায় পলিব্যাগে করে বই নিয়ে স্কুলে যাওয়ার সেই স্মৃতিকে মনে করিয়ে দেয় আষাঢ়। আবার ভাটির দেশে আষাঢ় মানে নাইওর যাওয়ার কথা বলাই বাহুল্য। আষাঢ়ের প্রেমে পড়ে প্রয়াত বংশীবাদক, গুণী শিল্পী বারী সিদ্দিকী গেয়েছিলেন-

আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি রে
পুবালী বাতাসে-
বাদাম দেইখ্যা, চাইয়া থাকি
আমার নি কেউ আসে রে।।

আষাঢ়ের প্রথম দিনে রিমঝিম রিমঝিম বৃষ্টি না হয় হলো না। তবে কবি কাজি নজরুল ইসলামের ভাষায় তখন বৃষ্টির গান ভেসে উঠে মনে। কবি লিখেন-

রিমঝিম ঘন দেয়া বরষে
কাজরি নাচিয়া চল্ পুর-নারী হরষে।

বাংলাদেশকে কখনোই আষাঢ়হীন ভাবাই যায় না। বর্ষা ঋতুটি সব সময়ই তার নিজস্বতার জন্য আলাদাভাবে ধরা পড়ে সকলের কাছে। আষাঢ়ে যখন প্রবল বর্ষণ হয়, হৃদয়ে দোলা দেয় প্রেম। টিনের চালের অবিরাম বৃষ্টিগান মনে সুখের তাল তোলে। কখনো কখনো অতীতকে সামনে এনে শোকাবহ করে তুলে পরিবেশকে। এ শোকও কত অমলিন। শত জঞ্জাল, ব্যতিব্যস্ততার মধ্যে বরষা একটু হলেও বুকে ছুঁইয়ে দেয় প্রশান্তির পরশ। তুলতুলে নরম কদম, কেয়া ফুলে প্রকৃতি নিজে থেকেই নববধূর মতো সাজে। আকাশ ঢাকা থাকে কালো মেঘে।

সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা এই বাঙলার রূপ, রস আর গন্ধ বরষায় জীবন্ত হয়ে উঠে। ঘাস-লতা-পাতা ধুয়েমুছে হয়ে উঠে চির সবুজ। মাটিতে পরে নতুন মাটির আস্তরণ। গ্রামের প্রতিটি ঘরে আগেকার দিনে বরষায় বিভিন্ন পিঠাপুলির আয়োজন করলেও এখন এই উৎসবটা কমে এসেছে। ছোট ছোট শিশু কিশোর-কিশোরীরা বাড়ির আঙিনায় ‘ফুলগুটি’ আর মার্বেল খেলে না। এখন বরষায় বৃষ্টি ছাড়া আগের রূপ খোঁজে পাওয়াও দুষ্কর।

আজ ১লা আষাঢ়ে দেশের নানান অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার ভিড়ে বর্ষা বয়ে আনুক অনাবিল সুখ। সব ক্লান্তি ভুলে পরিশ্রান্ত নাগরিক মন ভিজে যাক আর দূর হোক সব অশুভ শক্তির জাল, এমনটাই প্রত্যাশা সবার।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.