Sylhet Today 24 PRINT

মো. মাহবুবুর রহমান: এক সফল শিক্ষকের প্রতিকৃতি

ফয়সল আহমদ রুহেল |  ২৩ আগস্ট, ২০২২

মো. মাহবুবুর রহমান; মাহবুব স্যার নামে সমধিক পরিচিত ছিলেন। বর্ণাঢ্য জীবন সংগ্রামের অধিকারী একজন সফল মানুষ। অসাধারণ প্রতিভাধর ব্যক্তি। নিবেদিত প্রাণ এই শিক্ষক ছিলেন সিলেট জেলার ঢাকাদক্ষিণ হাইস্কুল ও কলেজের প্রাক্তন সহকারী প্রধান শিক্ষক।

জন্ম: কুমিল্লা জেলার বুড়িচং উপজেলার কাবিলাবাজার এর দুর্গাপুর গ্রামে এক মুসলিম সম্ভ্রান্ত পরিবারে তাঁর জন্ম ১৯৫৫ সালের ১ জানুয়ারি। পিতা মো. ছায়েদ আলী মাস্টার এবং মা মিসেস আনোয়ারা বেগম। পিতা ছিলেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক এবং মাতা একজন গৃহিণী। সাত ভাই-বোনের মধ্যে মো. মাহবুবুর রহমান ছিলেন বাবা-মায়ের ৪র্থ সন্তান। শিক্ষাজীবন শেষে মো. মাহবুবুর রহমান শিক্ষকতার মহান পেশায় আত্মনিয়োগ করেন।

শিক্ষকতা: ১৯৭৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর তিনি সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার ভাদেশ্বর সলিমা খানম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক (বিজ্ঞান) পদে যোগদান করেন। তিনি সলিমা খানম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ১ বছর ৭ মাস চাকুরিরত ছিলেন। এরপর তিনি ১৯৮০ সালের ১১ এপ্রিল ঢাকাদক্ষিণ হাইস্কুলে সহকারী (বিজ্ঞান) শিক্ষক পদে যোগদান করেন। এরপর ২০০০ সালে মাহবুবুর রহমানকে বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর মাহবুবুর রহমানের চাকুরির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। কিন্তু বিদ্যালয়ের প্রয়োজনে তাকে পুনঃনিয়োগ দেয়া হয়। ৫ বছর শিক্ষকতা শেষে তিনি অবসরে চলে যান।

শিক্ষাজীবন: মো. মাহবুবুর রহমানের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শুরু হয় নিমসার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। ওই বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৫ সালে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। ১৯৭২ সালে নিমসার হাইস্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে ১ম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯৭৪ সালে নিমসার জুনাব আলী কলেজ থেকে এইচএসসি বিজ্ঞান বিভাগে পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন। এরপর দেবীদ্বার (সরকারি) সুজাত আলী কলেজ থেকে ১৯৭৬ সালে বিএসসি চূড়ান্ত পরীক্ষায় তৃতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন তিনি। ১৯৮৪ সালে কুমিল্লা কোটবাড়ি প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয় থেকে বিএড প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। উক্ত কোর্সে তিনি দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন।

পারিবারিক জীবন: মো. মাহবুবুর রহমানের স্ত্রী মিসেস মেহেরুন নেছা একজন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা ও সু-গৃহিণী। তিনি বিএ পাস এবং পিটিআই ট্রেনিংপ্রাপ্ত। মাহবুবুর রহমান দুই কন্যা সন্তানের জনক। বড় মেয়ে মিসেস সাদিয়া মাহাবুব এমএসসি (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)। বর্তমানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ক্যাপ্টেন পদে মেডিকেল কোরে কর্মরত আছেন এবং তাঁর স্বামী জার্মানিতে পিএইচডি করছেন। ছোট মেয়ে মিসেস নাদিয়া মাহবুব বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার (CSE), এমএসসি ইঞ্জিনিয়ার (CSE) এবং শেষ সেমিস্টারের পরীক্ষার্থী (IUT)। বর্তমানে একটি বিদেশি কোম্পানিতে কর্মরত। তাঁর স্বামী হোসাইন ইশরাক হৃদয় একজন CSE ইঞ্জিনিয়ার। একটি বিদেশি কোম্পানিতে (UNDP) তিনি কর্মরত আছেন। বাবা হিসেবে তিনি ছিলেন দারুণ এক উদাহরণ। বেশিরভাগ সময় সিলেটে থাকার কারণে তিনি তার পরিবারকে খুব একটা সময় দিতে পারতেন না। কিন্তু যখনই ছুটি পেতেন সেই সময় এর সঠিক ব্যবহার ঠিকই করতেন। তিনি ছিলেন গণিতে দক্ষ। মেয়েরা অপেক্ষায় থাকত কবে বাবা আসবে, কবে অংক বই শেষ হবে। মেয়েরা অন্য কারো কাছে অঙ্ক করতে চাইতো না। বাবাই যে তাদের কাছে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। বাবার কাছেও তার মেয়েরাই সেরা। বাবা শুধু গণিতের নাম্বারটাই জানতে চাইতেন মেয়েদের কাছে। যখন শুনতেন মেয়েরা ক্লাসে গণিতে সর্বোচ্চ নাম্বার বরাবর পেয়ে আসছে তার খুশি কে দেখে! ছোট মেয়ের সাথে তার অনেক মধুর স্মৃতিও রয়েছে। মেয়েকে সাতার শেখাতেন, মেয়েকে নিয়ে বাজারে যেতেন, অনেক গল্প শোনাতেন। একজন আদর্শ বাবার উজ্জ্বল উদাহরণ ছিলেন তিনি।

শৈশব জীবন: ঢাকা-চট্টগ্রাম বিশ্বরোডের নিমসার বাজার নামক স্থান থেকে দেড় কিলোমিটার উত্তরপূর্ব কোণে মো. মাহবুবুর রহমানদের বাড়ি। অর্থাৎ বাড়ি থেকে রাস্তা দেখা যায়। রাস্তাটি সব সময় যানবাহনের ভিড় লেগেই থাকতো। তাদের বাড়ির সবচেয়ে কাছের বিদ্যালয়টি ছিল নিমসার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। স্কুলের যাওয়ার রাস্তাটি ছিল ঢাকা-চট্টগ্রাম বিশ্বরোডের উপর দিয়ে। তাই মো. ছায়েদ আলী মাস্টার ছেলে মাহবুবকে গাড়ি চাপার ভয়ে ৪/৫ বছর পর্যন্ত স্কুলে ভর্তি না করে বাড়িতে পড়াতেন। তখন লেখাপড়ার হাতেখড়ি ছিল বর্ণমালার বই আর আদর্শ লিপি। তাছাড়া তার বাবা বাড়িতে শতকিয়া, নামতা ও বানান শিখাতেন। অতি অল্প সময়ে উক্ত বিষয়সমূহ তার আয়ত্তে চলে আসে। সালটি ছিল ১৯৬১। বয়স তখন ৫ বছর পেরিয়ে গেছে মাহবুবের। মো. ছায়েদ আলী মাস্টার ছেলেকে স্কুলে ভর্তির সিদ্ধান্ত নিলেন। মাহবুবের বাবা তখন নিমসার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। ওই সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে তার বাবা ১ম শ্রেণিতে ভর্তি না করে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করালেন। ১৯৬৫ সালে বার্ষিক পরীক্ষার মাধ্যমে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লেখাপড়া শেষ হয়ে গেল। পরীক্ষার ফলাফলে মাহবুব ৭০ জন শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২য় স্থান অধিকার করলেন। স্যারের ছেলে এবং ভাল ছাত্র হিসাবে ছাত্রছাত্রীদের সাথে অল্প কয়েক দিনের বন্ধুত্ব ও সখ্য গড়ে উঠে মাহবুবের। স্কুল জীবন শুরু হয়ে গেল। তিনি তার বাবার সাথে স্কুলে যেতেন আবার বাবার সাথে স্কুল থেকে বাড়িতে ফিরতেন। ক্লাসে অন্যান্য ছাত্রদের চেয়ে তার প্রতিক্রিয়া বা উৎসাহ ভাল ছিল। তাই বাবাসহ অন্যান্য শিক্ষকরা তাকে যথেষ্ট আদর করতেন। শিক্ষকদের উৎসাহ ও ভালবাসা পেয়ে তার লেখাপড়ার আগ্রহ অনেক গুণ বেড়ে গেল। বছর শেষে বার্ষিক পরীক্ষা হল। এবার ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তির পালা। তাদের বিদ্যালয়ের পাশেই নিমসার হাইস্কুল ছিল। মো. ছায়েদ আলী মাস্টার ১৯৬৬ সনের জানুয়ারি মাসের ২য় সপ্তাহে নিমসার হাইস্কুলে ছেলেকে ভর্তি করালেন। ষষ্ঠ শ্রেণির ক্লাস শুরু হল। একজন ভাল ছাত্র হিসাবে বেশ সুখ্যাতি ছিল মাহবুবের। তাই অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই অনেক বন্ধুবান্ধব জুটে গেল তার। স্কুল ইউনিফর্ম পরে স্কুলে যেতে হতো। বাবাকে ইউনিফর্ম বানানোর জন্য অনুরোধ করা হল। তাদের পরিবারটি ছিল মধ্যবিত্ত পরিবার। বাবার সামান্য স্কুল বেতন দিয়ে এত বড় পরিবারের খরচ চালানোর ছিল খুব কঠিন ব্যাপার। তাই ইউনিফর্ম বানানো ২/৩ মাস দেরি হয়ে গেল। ইউনিফর্ম না পরে গেলে বিদ্যালয়ে ১০ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার শাস্তির বিধান ছিল। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তখন হাফপ্যান্ট ও বাজারে কেনা হাফশার্ট পরে যেতেন। পায়ে বর্তমানে যুগের মত স্যান্ডেল বা জুতার ব্যবস্থা ছিল না। কাজেই মাহবুব খালি পায়ে স্কুলে যেতেন। বিদ্যালয়ে বা বাড়িতে লেখার জন্য কোন কলমের ব্যবস্থা ছিল না। তিনি পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ছিলট ও পেন্সিল দ্বারা লেখার কাজটা করতেন। আর পরীক্ষার সময় Handle pen অর্থাৎ নিবের কলম কালির দোয়াতে চুবিয়ে লিখতেন। বর্তমান যুগের মত বলপেন ছিল না। ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার পর তাঁর বাবা ৩ টাকা দিয়ে ফাউন্টেন পেন কিনে দিয়েছিলেন। মাত্র ১ মাস লিখার পর কলমের নিব নষ্ট হয়ে যেত। আবার নতুন কলম কিনতে হতো। বাড়িতে কাঠ পেন্সিলের সাহায্যে খাতায় লিখতেন। বাড়িতে লেখাপড়া করার জন্য কোন ভাল টেবিল ছিল না। কাজেই ঘরের মেঝে শুয়ে শুয়ে পড়তেন ও লিখতেন। মাহবুবের পড়া চেয়ে লিখার অভ্যাস ছিল খুব বেশি। তাই সপ্তাহে ২/৩ দিস্তা কাগজ দরকার হত তার। বড় ভাইকে কাগজ কেনার কথা বললে তিনি ১ দিস্তা কিনে আনতেন। তাই কাগজের জন্য কান্নাকাটি করলে বাবা আরও ১ দিস্তা কাগজ কিনে দিতেন তাকে। এককথায় লেখাপড়ার করার জন্য প্রচুর পরিমাণ কাগজ ও কলম পাননি তিনি। তাই এগুলোর অভাবে যতটুকু ভাল রেজাল্ট হওয়ার কথা ছিল ততটুকু ভাল রেজাল্ট হয়নি। অর্থাৎ তিনি ক্লাসে দ্বিতীয় স্থান থেকে ১ম স্থানে যেতে পারেননি। বাড়িতে ঘুমানোর জন্য আলাদা কোন কক্ষ ও আলাদা কোন বিছানা ছিল না তাদের। গাদাগাদি করে ২/৩ ভাই এক সাথে ঘুমাতেন। ঘুমানোর জন্য আজকালের মত খাটপালং ছিল না। ছিল না কোন মশারির ব্যবস্থা। সন্ধ্যাবেলা খেলাধুলা করে বাড়ি ফিরে কাঠের খড়ম বা ফিতাওয়ালা কাঠের স্যান্ডেল দিয়া অজু করে ঘরে আসতেন। জুতা বা স্পঞ্জের স্যান্ডেল তখন বাড়িতে ছিল না।

সন্ধ্যার পর মাহবুবের মা পিঠা বা মুড়ি দিয়ে নাস্তা দিতেন। তারা সকল ভাইবোন নাস্তা করে পড়াশুনায় মনোযোগ দিতেন। ছায়েদ আলী মাস্টার মাঝে মধ্যে লেখাপড়ায় সাহায্য করতেন ছেলেকে। মাহবুবের বড় দুই ভাই উঁচু ক্লাসে পড়তেন। পড়াশুনায় তাদের কোন সাহায্য নিতেন না তিনি। কারণ তারা পড়ায় সাহায্য করার চেয়ে বেশি শাসন করতেন। তিনি ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত মাধ্যমিক নিজে লেখাপড়া করেছেন। তখনকার দিনে স্কুলের বা বোর্ডের পাবলিক পরীক্ষাগুলি দুই বিষয়ে একদিনে পরীক্ষা হতো। অর্থাৎ সকালে ইংরেজি ১ম পত্র হলে বিকালে ২য় পত্র পরীক্ষা হত। কাজেই পরীক্ষার সময় দুই বিষয় রিভিশন দিতে রাত্র পোহানে সকাল হয়ে যেত। মাহবুবের মা মধ্যরাত্রিতে এসে নাস্তা দিয়ে ছেলের পাশে অনেকক্ষণ বসে থাকতেন। তাদের সকল ভাইবোনের লেখাপড়ার জন্য বাবার মত মায়ের ভূমিকাও কম ছিল না। তার মা তেমন লেখাপড়া জানতেন না। কিন্তু লেখাপড়ার দরদ বা কদর বুঝতেন তিনি।

স্বাধীনতা সংগ্রাম: ১৯৭০ সাল; তখন তিনি ১০ম শ্রেণির ছাত্র। দেশের রাজনীতি উত্তপ্ত। নভেম্বর মাসে এসএসসি টেস্ট পরীক্ষার শেষে ফরম ফিল-আপ করা হল। আসন্ন এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার তারিখ ছিল ১৯৭১ সালের ৭ এপ্রিল। কিন্তু ১৯৭১ সালের শুরুতেই দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ ছিল উত্তপ্ত। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমানে বাংলাদেশ) সর্বত্র বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মিটিং মিছিল চলছিল। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (রেসকোর্স ময়দান) বজ্রকন্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা করলেন। মাহবুব পরীক্ষার কথা বাদ দিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। তিনি আরও কয়েকজন সমবয়সী পাড়া প্রতিবেশি আনুমানিক ঐ সালের সেপ্টেম্বর মাঝামাঝি রাত্রিতে প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারতে পাড়ি জমালেন। বাড়িতে বাবা জানতে পারলে যেতে দেবেন তাই বাড়ি থেকে কাউকে না বলে ভারতে চলে গেলেন তিনি। ভারতে যাওয়া এতো সহজ ছিল না। পায়ে হেঁটে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের দুই মাইল উত্তর পাস দিয়ে ভারতে যেতে হয়। তারা শেষ রাত্রের দিকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বক্সনগরে একটি অভ্যর্থনা কেন্দ্রে উঠলেন। সেখানে সকালে নাস্তা খাওয়ার পর তাদেরকে আগরতলায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে রাত্রিযাপনের জন্য কংগ্রেস ভবনে আশ্রয় দেওয়া হয়। রাত্রে সেখানে রেজিস্ট্রেশনভূক্ত করা হয়। লোক সংখ্যা খুব বেশি ছিল তাই তাদেরকে কংগ্রেস ভবনের বারান্দায় থাকার জায়গা পেলেন। মশার কামড়ে রাত্রে ঘুম হয়নি। সকালে নিজের টাকায় নাস্তা করে ওই ভবনে ফিরে আসলেন। দুপুরের খাবারের জন্য ঐ স্থান থেকে ১ মাইল দূরে কদমতলী নামক স্থানে হেঁটে হেঁটে তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয়। তারা লাইনে দাঁড়িয়ে একটি খাওয়ার প্লেট নেন। প্লেটে দেওয়া হল মোটা ভাত চাল কুমড়া সিদ্ধ, সামান্য ডাল ও লবণ। এভাবে থাকা খাওয়ার কষ্ট কি আর সহ্য হয়? কেউ কেউ বাড়িতে ফেরত আসার চিন্তা করে। কিন্তু তা কি তখন সম্ভব ছিল? এভাবে দুইদিন সেখানে থাকার পর তাদেরকে ৪/৫ মাইল দূরে পাহাড়ের উপর এক ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। ক্যাম্পটির নাম ছিল গোমতী ক্যাম্প। তাদের ক্যাম্পের আশেপাশে আরও ৭টি ক্যাম্প ছিল। ক্যাম্পে তাদেরকে দু’বেলা খেতে দেওয়া হত। সকালে নিজের টাকা দিয়ে হোটেলে নাস্তা করতে হত। দুপুরে ভাত দেওয়া হত। আর রাত্রে ২/৩টি রুটি দেওয়া হত। রুটিগুলি চিবিয়ে খাওয়া সম্ভব হত না। কারণ রুটির মধ্যে বালি কচকচ করতো। অতএব তারা রুটিগুলি গিলে খেতেন। তাই অনেকের আমাশয় ও পেটের অসুখ ও নানাবিধ শারীরিক সমস্যা দেখা দিল। তার মধ্যে তাদের কিছু সংখ্যক লোক প্রশিক্ষণের জন্য নিয়োগ করা হল। তাদেরকে পাহাড়ের উপরে নির্জন স্থানে নিয়ে প্রতিদিন প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। প্রশিক্ষক ছিলেন বিশেষ করে ইপিআর এর লোকজন। এভাবে ২ মাস ট্রেনিং শেষ করায় তাদেরকে দেশের ভিতরে পাঠানোর অপেক্ষায় রাখা হল। নভেম্বর মাসের শেষের দিকে ক্যাপ্টেন আব্দুল মান্নানের নেতৃত্বে তাদেরকে ২নং সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টের সন্নিকটে ভারেল্লা ইউনিয়নে পাঠানো হল। তাদের দলে ছিলেন ৩২ জন মুক্তিযোদ্ধা। সবাই গেরিলা ট্রেনিংয়ে পারদর্শী ছিলেন। বিশেষ করে গ্রেনেড নিক্ষেপ, এলএমজি চালানো, পাইপগান চালানো ইত্যাদি ট্রেনিংপ্রাপ্ত ছিলেন। অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে দেশ শত্রুমুক্ত হল। সবচেয়ে মজার ব্যা পার হল, ওনার নামের মুক্তিযোদ্ধা সনদ ব্যবহার করে ওনারই পরিচিত একজন বছরের পর বছর সুযোগ সুবিধা ভোগ করে গেছেন, তিনি তা নিয়েও বিচলিত হননি। বলতেন আল্লাহই সব দেখছেন, কে ভাল করছে কিংবা কে খারাপ কিছু করছে।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসে এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হল। ৩ মাস পর পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হল। মাহবুব ৭৫% নম্বর পেয়ে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ১ম বিভাগে উত্তীর্ণ হলেন। যেহেতু অংকে ভাল সেহেতু বাল্যকাল থেকে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন ছিল তার। তাই একটি ভাল কলেজে ভর্তি হবার প্রবল ইচ্ছাও ছিল। প্রথমে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে ভর্তি হওয়ার আবেদন এবং সাক্ষাৎকার অংশগ্রহণ এবং ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন মাহবুব। কিন্তু বাবার আর্থিক সংকটের কারণে সেখানে ভর্তি হতে পারেননি। পরে স্থানীয় নিমসার জুনাব আলী কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়ে ক্লাস শুরু করেন। বাড়ি থেকে হেঁটে কলেজ যেতেন। নূতন কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কলেজের কার্যক্রম ঠিকমতো চলছিল না। পড়াশোনায় পূর্বের মত আর মনোযোগ দিতে পারছিলেন না। কাজেই পড়াশোনায় কিছুটা ভাটা পড়ে গেল। বাড়ি থেকে গিয়ে কলেজ করতে হত। এইচএসসি চূড়ান্ত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়ে ফলাফল প্রকাশ হল। পরীক্ষায় গড়ে শুধু ৫৮% নম্বর পেয়ে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হলেন তিনি। পরীক্ষার সালটি ছিল ১৯৭৪। পরীক্ষার ফলাফলে পরিবারের কেউ খুশি হতে পারলেন না। সবাই নিরাশ হলেন। তিনি নিজেও অনেকটা ভেঙে পড়লেন। আশা ছিল বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার। কিন্তু ফলাফলে তো সেটা হলো না। তবে ঐ বৎসর দ্বিতীয় বিভাগ পেয়েও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি পরীক্ষার সুযোগ ছিল। কিন্তু আর্থিক সংকটের কারণে ভর্তি পরীক্ষাটাও দেওয়া হয়নি। অবশেষে বিলম্ব ফি দিয়ে দেবীদ্বার (সরকারি) সুজাত আলী কলেজে পাস কোর্সে বিএসসি’তে ভর্তি হন। দেবীদ্বারে থাকার কোন ভাল ব্যবস্থা না থাকায় কলেজ থেকে ৪ মাইল দূরে এক আত্মীয়ের বাড়িতে থাকতেন মাহবুব। আত্মীয়ের ছিল মধ্যবিত্ত পরিবার। কাজেই লেখাপড়া, থাকা খাওয়ার সুব্যবস্থা তেমন ছিল না। তবুও লেখাপড়ার খাতিরে সেখানে থাকতে বাধ্য হন। সকাল ৮টায় কলেজের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হতেন। হেঁটে হেঁটে কলেজে যেতে হত। প্রায় ২ ঘণ্টায় কলেজে গিয়ে পৌঁছাতেন। কলেজ ছুটি হলে আবার হেঁটে হেঁটে আত্মীয় বাড়িতে ফিরে আসতেন। কোন কোন দিন বাড়ি আসতে সন্ধ্যা হয়ে যেত। আসা যাওয়ার ৮ মাইল পথ হেঁটে এসে ক্লান্ত হয়ে যেতেন। এইচএসসি পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগ পেয়েও মাহবুব ঐ বছর বোর্ডের একটা উপবৃত্তি পেয়েছিলেন। মাসে ১৩০ টাকা করে ২ বছর এই উপবৃত্তি পেয়েছিলেন। এই উপবৃত্তির টাকা দিয়েই তিনি কলেজের বেতন ও ব্যক্তিগত খরচ কোনরকমে চালাতেন। ১৯৭৬ সালে বিএসসি চূড়ান্ত পরীক্ষায় তৃতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন তিনি। ওই বছর কলেজ থেকে ৭৫ জন বিজ্ঞান বিভাগে পরীক্ষা দিয়ে শুধু ২ জন ছাত্র কৃতকার্য হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাসের হার তখন ছিল মাত্র ৮%।

চাকুরির সন্ধান ও কর্মজীবন: বিএসসি পাস করে কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। পরে ঢাকা শহরে মাহবুব এক মামার বাসায় থেকে ৫/৭ মাস চাকুরির সন্ধান করতে লাগলেন। কয়েকটি বেসরকারি ও কয়েকটি সরকারি চাকুরির সাক্ষাৎকারে উপস্থিত হন। কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস চাকুরির মত সোনার হরিণটি তার হাতে ধরা দেয়নি। সেই মামাটি ছিলেন শ্রদ্ধেয় মরহুম বশীর হোসেন, চিত্র সম্পাদক, বাংলাদেশ সিনেমা ফিল্ম। মাহবুবের আরেক মামা জনাব আলী আজগর খান ছিলেন সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ উপজেলার সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক। তিনি মাহবুবকে ঢাকা থেকে খবর দিয়ে সিলেট নিয়ে গেলেন। কয়েকদিন পর তিনি তাকে ভাদেশ্বর সলিমা খানম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক (বিজ্ঞান) পদে যোগদান করতে বলেন। সালটি ছিল ১৯৭৯ সাল; তারিখ ২১ সেপ্টেম্বর। তখন ভাদেশ্বর দক্ষিণ ভাগ মাখন মিয়া চৌধুরীর বাড়িতে তাকে লজিং দেওয়া হয়। সিলেটের আঞ্চলিক ভাষা ও সংস্কৃতি সাথে তাল মেলাতে কিছুটা দেরি হলেও ৩/৪ মাসের মধ্যেই মাহবুব সব কিছু বুঝতে পেরেছিলেন। দক্ষিণভাগ মাখন মিয়া চৌধুরীর বাড়িতে বছরখানেক থাকার পর ভাদেশ্বর শেখপাড়া পোস্ট মাস্টার আশিক মিয়ার বাড়িতে লজিংয়ে চলে আসেন তিনি। সেখানে শেখপাড়া থাকা খাওয়ার সুব্যবস্থা ছিল। ছাত্রছাত্রীসহ বাড়ির লোকজন যথেষ্ট সম্মান করত। শেখপাড়া ৬/৭ মাস থাকার পর ঢাকাদক্ষিণ হাইস্কুলে বিজ্ঞান শিক্ষকের শূন্য পদে শিক্ষক নিয়োগের জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া হল। তিনি ওই পদে আবেদন এবং নির্দিষ্ট দিনে সাক্ষাৎকারে উপস্থিত হলেন। সাক্ষাৎকারের পর তাকে নিয়োগপত্র দেওয়া হল। মাহবুব ১৯৮০ সালের ১১ এপ্রিল ঢাকাদক্ষিণ হাইস্কুলে সহকারী বিজ্ঞান শিক্ষক পদে যোগদান করেন। তিনি সলিমা খানম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ১ বছর ৭ মাস চাকুরিরত ছিলেন।

স্মৃতিচারণ: শেখপাড়া যে টঙ্গিঘরে (বৈঠকখানা) মাহবুব থাকতেন সেই ঘরের সিলিংয়ের উপর প্রচুর জালালী কবুতর থাকত এবং প্রতিমাসে প্রতিজোড়া কবুতর ১ জোড়া বাচ্চা দিত। মাহবুব একদিন রাত্রিবেলা সিলিংয়ের উপরে উঠে দেখলেন অনেক খাওয়ার উপযোগী কবুতরের বাচ্চা। সেখান থেকে ৭/৮টি বাচ্চা নিচে নামিয়ে ঘরের এক কোণে রেখে দিলেন। সকালবেলা ছুরি দিয়ে কবুতরের বাচ্চাগুলি জবাই করলেন। ছাত্র আবিদকে (লজিং বাড়ির ছাত্র) ডেকে এনে দুই জোড়া বাচ্চা রান্না করার জন্য পাঠালেন আর বাকিগুলি তার মামার বাসায় নিয়ে গেলেন। এদিকে, ছাত্র আবিদের মা মাহবুবকে ডেকে নিয়ে বললেন স্যার এইগুলো জালালী কবুতরের বাচ্চা। এগুলো খাওয়া নিষেধ। যদি এই কবুতর খাওয়া হয় তবে যে খায় সে মারা যায়। মাহবুব উনাকে রান্না করার জন্য অনুরোধ করলেন। উনি রান্না করে দিলেন। স্কুল থেকে গিয়ে ভাত খাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলেন। আবিদ ভাত খাওয়ার সময় পাশে বসে রইল। মাহবুব যেমনি কবুতরের মাংস মুখে দিলেন। সে হাত চেপে ধরে বলল স্যার খাবেন না। আপনি এক্ষুনি মারা যাবেন। মাহবুব তার কথা না শুনে মাংস দিয়ে পুরো পেট ভরে ভাত গেলেন। ১ দিন/ ২ দিন/ ৩ দিন পার হয়ে গেল। তিনি তো আর মরেন না। বাড়ির সকলেই অবাক। এভাবে প্রতি সপ্তাহে এক জোড়া কবুতরের বাচ্চা মাহবুব স্যারের জন্য রান্না করা হয়। ঢাকাদক্ষিণ বাজারে মাহবুবের মামার বাসায় যেমন সুবিধা ছিল তেমনি অসুবিধা কম ছিল না। বিশেষ করে থাকার সমস্যা। বাসায় কক্ষের সংখ্যা লোকজনের তুলনায় কম ছিল। ৪/৫ মাস মামার বাসায় থাকার পর ঢাকাদক্ষিণ বাজারের পশ্চিম অংশে বাজার সংলগ্ন রায়গড় নিবাসী কালা মিয়ার বাড়িতে মাহবুব স্যার কয়েকজন শিক্ষক মিলে মেস করলেন। সেখানে থাকা খাওয়ার সুবন্দোবস্ত ছিল। মেস থেকে স্কুলে যেতে ৩/৪ মিনিট সময় লাগতো। ঢাকাদক্ষিণ স্কুলে তিনি সাধারণ গণিত পড়াতেন। ছাত্রজীবন থেকে মাহবুব গণিতে পারদর্শী ছিলেন। কাজেই অল্পদিনের মধ্যেই সুখ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল।

১৯৮৩ সালে বিএড প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার জন্য (১০ মাস ব্যাপী) কুমিল্লা কোটবাড়ি প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয়ে চলে যান মাহবুব স্যার। ১০ মাস প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে পুনরায় বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। উক্ত কোর্সে তিনি দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন। ২০০০ সালে মাহবুবুর রহমানকে বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৯৫ সন থেকে স্কুলে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণি খোলা হয়। প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে ঢাকাদক্ষিণ হাইস্কুল ও কলেজ নামে পরিচিত। বর্তমানে অত্র প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৪২ জন শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং প্রায় ২৫০০ জন শিক্ষার্থী আছে। মাহবুবুর রহমানের প্রাক্তন ছাত্র মো. রেজাউল আমীন বর্তমানে স্কুল ও কলেজটির অধ্যক্ষ পদে নিয়োজিত আছেন।

মাহবুবুর রহমান যখন স্কুলে যোগদান করেন তখন আব্দুল কুদ্দুছ ছিলেন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। তিনি অনেক কর্মঠ ও পরিশ্রমী লোক ছিলেন। কাজের মূল্যায়ন তিনি করতেন। কর্মঠ ও পরিশ্রমী শিক্ষকদেরকে তিনি বেশি পছন্দ করতেন। স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক ছিলেন ভাদেশ্বর গ্রামের লতিফ আহমদ চৌধুরী। তাদের প্রেরণায় ও উৎসাহে মাহবুব রহমানের কর্মের গতি বেড়ে যায়। দীর্ঘ ৪০ বছর এই স্কুলে শিক্ষকতার কারণে মাহবুবুর রহমান ঢাকাদক্ষিণ ইউনিয়নের দত্তরাইল গ্রামের একজন ভোটার ছিলেন। তার জাতীয় পরিচয়পত্রটি দত্তরাইল গ্রামের ঠিকানায় হয়েছে। দীর্ঘদিন সিলেটে থাকার কারণে সিলেটের শিক্ষা সংস্কৃতি, আঞ্চলিক ভাষাসহ সবকিছু তার আয়ত্তে ছিল। তাই এলাকাটির অনেকেই তাকে ‘সিলেটী পোয়া’ বলে ডাকত। ২২ বছর বছর বয়সে তিনি সিলেট আসেন। বাবা খুব অল্প বয়সে মারা যাওয়ার কারণে পরিবারের অনেক দায়িত্ব তার কাঁধে ছিল, তার আরেক ভাই ও শিক্ষক ছিলেন। দুই ভাই মিলে পরিবারের সবার দায়িত্ব পালন করতেন।

এই তারুণ্যের প্রতীক, জ্ঞানদ্রষ্টা ১৯৭৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত তার শিক্ষকতা পেশায় ব্রত ছিলেন। ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর মাহবুবুর রহমানের চাকুরির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। কিন্তু বিদ্যালয়ের প্রয়োজনে তাকে পুনঃনিয়োগ দিয়ে আরও ৫ বছর বিদ্যালয়ে রাখা হয়। ২০২০ সালের ২৮ জানুয়ারি বিদ্যালয় থেকে আনুষ্ঠানিক বিদায় সংবর্ধনা দেওয়া হয় শ্রদ্ধেয় এ শিক্ষককে। ২০২০ সালের ৩০ জানুয়ারি সর্বজন শ্রদ্ধেয় মো. মাহবুবুর রহমান স্যার দেশের বাড়িতে চলে যান। বাড়িতে এসে ৩/৪ দিন পর কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের বাসায় উঠেন। ওইখানে থাকাবস্থায় ২০২০ সালের ১ নভেম্বর মাহবুব রহমান স্যার মাইল্ড স্ট্রোক করেন। ডান হাত এবং ডান পা কিছুটা অবশ হয়ে যায়। অতি দ্রুত তাকে কুমিল্লা সিএমএইচ-এ ভর্তি করা হয়, যেখানে ওনার বড় মেয়ে কর্মরত ছিলেন। সেখানে ১০/১২ দিন চিকিৎসার পর রিলিজ করা হয়। পরে বাসায় চলে যান তিনি। অনেকটাই সুস্থ হয়ে ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকা ডিএমএইচ থেকে ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করেন। তখনো পুরোপুরি হাত ও পা নাড়াচাড়া করতে পারেন না তিনি।

সর্বজন শ্রদ্ধেয় মো. মাহবুবুর রহমান শিক্ষক হিসাবে ছিলেন শিক্ষার্থীদের ভরসাস্থল। ছাত্রদের প্রতি তার মমতাবোধ অনুকরণীয়। যারা এই মহান শিক্ষকের আদর্শ লালন করেছেন, অনুকরণ করতে পেরেছেন, তাদের প্রত্যেকেই আজ স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু আদর্শের প্রতিকৃতি মো. মাহবুবুর রহমান কৃতিত্বের অধিকারী হয়ে আত্মপ্রকাশ করতে চাননি, আত্মপ্রচার করেননি। ২২ বছর বয়সে তিনি শিক্ষকতা শুরু করে জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় যৌবন কাটান এ পেশায়। মাহবুব স্যার আর্থিক সংকটের কারণে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি পরীক্ষাটাও দেওয়া হয়নি। নিজে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে হতে পারেননি বলে আক্ষেপ নেই। তবে নিজের হাতে গড়া অসংখ্য শিক্ষার্থী প্রত্যেকেই আজ স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। এমনকি তার সন্তানেরা আজ উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত। সন্তানদেরকে তিনি কোন অভাব বুঝতে দে নি। ভালবাসা দিয়ে আগলে রাখতেন সব সময়। কত মানুষ কত কথা বলতেন তিনি সেগুলো কানেও নিতেন না। মেয়েদের কেন পড়াচ্ছেন, কেন বিয়ে দিচ্ছেন না কত শত কথা। মেয়েদের নিয়ে কোন বাজে কথা কেউ বলতে সাহস পেত না। বাবা হিসেবেও তিনি সমানভাবে সফল। সিলেট থাকতেন বেশিরভাগ সময়। মানুষ গড়ার কারিগর এ মহান ব্যক্তিত্ব পারিবারিক জীবনে দুই কন্যা সন্তানের জনক।

কীর্তিমান এই শিক্ষাবিদ ২০২১ সালের ১৪ অক্টোবর রাত ৮.১০ মিনিটে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৬ বছর।

ফয়সল আহমদ রুহেল: সাউথ লন্ডন করেসপনডেন্ট, চ্যানেল এস।
ইমেইল: [email protected]

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.