Sylhet Today 24 PRINT

একজন হোসেন আহমদ স্যার

ফয়সল আহমদ রুহেল |  ০৫ অক্টোবর, ২০২২

হোসেন আহমদ; এক আদর্শ শিক্ষকের নাম। শিক্ষাগ্রহণ ও শিক্ষকতা জীবনের প্রতিটি ধাপ অতিক্রম করেছেন তিনি সফলতার সঙ্গে; বিভিন্ন জেলা শিক্ষা পরিদর্শকের দায়িত্বেও ছিলেন তিনি। চাকরিকাল শেষে এখন আছেন অবসরযাপনে।

হোসেন আহমদ স্যার সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার মাথিউরা কুড়ারবাজার মডেল স্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক। বর্তমানে এই শিক্ষক আমেরিকার নিউ ইয়র্কে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন।

জন্ম
হোসেন আহমদ ১৯৩৬ সালের ৭ আগস্ট সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার পাতন কোম্পানীবাড়ির এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মাওলানা আরমান আলী, মাতা ফাতেমা বেগম। পিতা ছিলেন মৌলভী শিক্ষক। ২ ভাই ও ৩ বোনের মধ্যে তিনি ২য়।

শিক্ষাজীবন
হোসেন আহমদ প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু হয় তৎকালীন পাতন পাঠশালায়, ১৯৪০-১৯৪৪ সাল পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। এরপর তিনি লাউতা এম.ই স্কুলে ১৯৪৪-৪৮ সাল পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। ওখান থেকে তিনি জলঢুপ হাইস্কুল ৭ম শ্রেণিতে ভর্তি হন। এই বিদ্যালয়ে ১৯৪৯-১৯৫২ সাল পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। তিনি ১৯৫৩ সালে পূর্ব পাকিস্তান বোর্ডের অধীনে জলঢুপ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে ২য় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর ১৯৫৬ সালে পূর্ব পাকিস্তান বোর্ডের অধীনে পরীক্ষার্থী হিসেবে আইএ পরীক্ষা দিয়ে ২য় বিভাগ অর্জন করেন। এছাড়া ১৯৬৯ সালে বিএ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরীক্ষা দিয়ে ২য় বিভাগে পাস করেন। ১৯৭৫ সালে কুমিল্লা টিচার্স ট্রেনিং থেকে বি.এড ১ম শ্রেণিতে সম্পন্ন করেন তিনি।

কর্ম ও পারিবারিক জীবন
১৯৫৪ সালে নিদনপুর প্রাথমিক স্কুলে যোগদান করেন। ১৯৫৫-৫৭ সাল পর্যন্ত (বাধ্যতামূলক প্রধান শিক্ষক) শিক্ষকতা ওই স্কুলে। এরপর ১৯৫৮-১৯৬১ সাল পর্যন্ত মাথিউরা কুড়ারবাজার মডেল স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

তিনি হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের বিভিন্ন ইউনিয়নের সাব ইন্সপেক্টর (স্কুল) ছিলেন ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত। মৌলভীবাজার মহকুমা স্কুল পরিদর্শক ১৯৬৫ সালে। ১৯৭৬ সালে শিক্ষা অফিসে (বয়স্ক শিক্ষা) এরপর পিটিআইতে ১৯৭৮ হতে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পিটিআইতে ১৯৮৬-১৯৮৭ সাল এবং সিলেট পিটিআইতে ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত কর্মরত থাকার পর অবসরে চলে যান। এরপর ১৯৯৫ হতে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত বিশেষ অনুরোধে জালালাবাদ চক্ষু হাসপাতালে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

হোসেন আহমদ স্যার ২ ছেলে ও ৩ মেয়ের জনক। ছেলে শাব্বীর আহমদ-পিএইচডি, ফ্লোরিডা। মেয়ে সাবিহা বেগম বিএ, মেয়ে সেলিনা আক্তার বিএ, বিএড। মেয়ে ফাতেহা শিরিন- এডিশনাল রেজিস্ট্রার, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। ছেলে তানভীর আহমদ বিএসএস (অনার্স) ইকোনমিকস (জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ) একাউন্টিং (ইউএসএ)।

হোসেন আহমদ স্যার শৈশবে কারী মোস্তফার সঙ্গে মাঠে গরু চরাতেন। পরবর্তী পর্যায়ে বেকার কারীর সাথে বেকার ঘুরানো ছিল তার কাজ। আবার হোসেন আহমদ স্যারের বাবা আসামের হোজাই থানায় আলীনগরে দাদীর এক বাড়িতে তাদের অবস্থান ছিল। হোসেন আহমদকে তার পিতা পশ্চিম আলীনগরের একটি স্কুলে ২য় শ্রেণিতে ভর্তি করান। আসামের ভাষায় বাংলা ২য় ও ১ম শ্রেণিতে পুনরায় পাঠদান করেন। তিনি তার চাচাতো ভাই এর সাথে এক সঙ্গে বাংলা পঠন সম্পন্ন করেন। এরপরই যুদ্ধাবস্থায় সম্পন্ন হওয়ার সময় ট্রেনে বাবার সাথে বাড়িতে প্রত্যাবর্তন এবং পুনরায় পাঠশালায় মামার অধীনে ৩য় শ্রেণিতে ভর্তি। আর কারী মোস্তফার কারীর কোরআন পঠনে কোনাগ্রামের বশির উদ্দিন কারীর তত্ত্বাবধানে পঠনে এবং হোসেন স্যার এম.ই স্কুলে ৩য় শ্রেণিতে ১৯৪৫, ৪৬, ৪৭, ৪৮ সালে তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণিতে এমই ফাইনাল পরীক্ষায় পাস করেন।

ছেলেবেলার বন্ধুদের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে হোসেন আহমদ স্যার বলেন, “বাল্যবন্ধু আমির উদ্দিন যিনি তৃতীয় শ্রেণি হতে একসাথে ক্লাসে পড়ালেখা করেও পাস করেন নাই। পরবর্তীতে লাউতা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে দীর্ঘ দিন কৃতিত্বের সহিত ইউনিয়ন পরিচালনা করেন। অপর বাল্যবন্ধু আব্দুল্লাপুর গ্রামের আব্দুল হাছিব এক সাথে পরীক্ষা দিয়ে আইএ পাস করেন। সেই সময় আব্দুল হাছিব কিছুদিন জুট মিলে চাকরি করেন। পরবর্তীতে লেখাপড়া শেষে জলঢুপ উচ্চ বিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন সুনামের সাথে শিক্ষকতার পর প্রধান শিক্ষক হয়ে অবসরে চলে যান।

হোসেন আহমদ প্রাইভেট পড়াশোনা চালান এবং তখন ১৯৭০ সাল। চট্টগ্রামে ২/৩ বার সবেতনে ভর্তির চেষ্টা করেন। কিন্তু অবশেষে তিনি সরাসরি ডাইরেক্টর জেনারেলের সাথে ঢাকায় নিজে দেখা করে এবং ডিজি তাকে ১৯৭০ এর জুলাই প্রথম সপ্তাহ হতে পরবর্তী এপ্রিল পর্যন্ত বিধিমত রীতিমত কোর্স করতে দেয়া হয় এবং এই কোর্সে চট্টগ্রামের মনোবিজ্ঞান, বাংলা, অংক, গণিত, শিক্ষাদান ও শিক্ষারীতি প্রভৃতি বিষয়ে পরীক্ষা দিয়ে প্রত্যেক বিষয়ে লেটার মার্ক পান এবং ১৯৭৫ সালে বিএড সার্টিফিকেট পান। পরীক্ষা হওয়ার পর ময়মনসিংহ, ঢাকার পাঠ্যগ্রন্থ আলোচনা করেন।

তিনি ১৯৯৫ সালে শহরতলীর মেজরটিলাস্থ একটি ভাড়া বাসায় স্থানান্তরিত হন । ১৯৯৫ সালের ফেব্রুয়ারি ৩য় দিবসে প্রায় ৮০ বৎসর বয়সে পীড়িত অবস্থায় হোসেন আহমদ এর গর্ভধারিণী মা পরকালে চলে যান এবং হযরত শাহজালাল (রহ.) দরগায়ে তাকে দাফন করা হয়।

ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপন করা হোসেন আহমদ শিক্ষার মহান ব্রত নিয়ে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেন। সাফল্য কিংবা খ্যাতি তাকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি সাধারণ জীবন থেকে, বিচ্যুত করতে পারেনি আদর্শ থেকে। শ্রদ্ধেয় হোসেন আহমদ স্যারের মধ্যে সততা ছিল, চেষ্টা ছিল এবং ভালো কিছু করার সুতীব্র ইচ্ছে শক্তি ছিল বলেই তিনি এত দূর আসতে পেরেছেন। 

শিক্ষক দিবসে এমন একজন গুণী প্রবীণ শিক্ষক হোসেন আহমদ স্যারের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করি।

 

ফয়সল আহমদ রুহেল: সাউথ লন্ডন প্রতিনিধি, চ্যানেল এস টেলিভিশন। 

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.