Sylhet Today 24 PRINT

হাসির মহামারী: আজব এক রোগ

ফরিদ আহমেদ |  ২৫ এপ্রিল, ২০২৩

আমরা জানি হাসি সংক্রামক। একজন হেসে উঠলে, তার পাশে যে বা যারা আছে, তাদেরও হেসে ওঠার সম্ভাবনা অনেক বেশি। একা একাও যে মানুষ হাসে না, তা নয়। তবে দেখা গেছে যে দলবদ্ধভাবে থাকলেই হাসিটা বেশি পরিমাণে ছড়ায়।

হাসির কিছু না থাকলেও লোকে হাসে। ধরুন, কেউ একজন একটা কৌতুক বলেছে আড্ডার মাঝে। স্থূল ধরনের কৌতুক। কিংবা মহা সেক্সিস্ট কৌতুক। শুনে আপনার বরং রাগই হচ্ছে। হাসি আসার মতো তেমন কোনো উপাদান সেখানে নেই। কিন্তু, কেউ একজন হেসে ফেলছে সেই কৌতুক শুনে। ওই লোকের দেখাদেখি বাকিদের মধ্যেও হাসিটা তখন সংক্রমিত হয়ে যাবে। সেক্সিস্ট কৌতুক শুনে নারীদের যেখানে কৌতুককারীকে পিটানোর কথা নারীদের অবমাননা করার জন্য, দেখা যাবে তারাও সেই কৌতুক শুনে হাসছে। কারণ ওই একটাই। সেই কৌতুক শুনে হয়তো কেউ হেসেছে। ফলে, সংক্রামক হিসাবে তারাও হাসি শুরু করেছে।

কোনো কিছুতে হাসির উপাদান থাকলে মানুষ এমনিতেই হাসে। তবে, দেখা গেছে দলবলে থাকলে সেই হাসির পরিমাণ বেড়ে যায় অনেক গুণ। যে হাসির অনুষ্ঠান দেখে মানুষ একা একা হাসবে পরিমিত পরিমাণে, সেই একই অনুষ্ঠান কয়েকজন মিলে দেখলে হাসির পরিমাণ বেড়ে যাবে কয়েকগুণ পরিমাণে।

হাসি মানুষের আনন্দের বহিঃপ্রকাশ। একজনের আনন্দ অনেক দ্রুত আরেকজনের মাঝে সংক্রমিত হয়ে যায় এর মাধ্যমে। আদি যুগে মানুষ যখন ভাষার আবিষ্কার করেনি, তখন হয়তো হাসিই ছিলো মানুষের যোগাযোগের মাধ্যম। হাসি দিয়ে বোঝানো হতো আমি তোমাকে ভালবাসি, কিংবা আমরা বন্ধু। একপক্ষের হাসিতে তাই অন্যপক্ষ প্রতিক্রিয়া দেখাতো। যেটা এখনো রয়ে গেছে আমাদের মাঝে। রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে বিপরীত দিক থেকে আসা অচেনা কেউও হাসি দিয়ে হাই-হ্যালো বললে, আমরাও হাসি দিয়ে পালটা শুভেচ্ছা জানাই। মুখ গোমড়া করে থাকি না।

হাসির ক্ষেত্রে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা বেশি পটু। বিশেষ করে অল্পবয়সী মেয়েদের মধ্যে সম্পূর্ণ বিনা কারণেও হাসার প্রবণতা রয়েছে। আমার স্ত্রীর সাথে যখন গল্প করি, সে প্রায়ই বলে যে স্কুল বা কলেজে থাকার সময়ে তারা কোনো কারণ ছাড়াই হাসতে হাসতে এক বান্ধবী আরেক বান্ধবীর উপরে ঢলে পড়তো। কেউ একজন একটা কিছু বললো, তা সে মজাদার কিছু হোক বা না হোক, বাকিদের সবার হাসা শুরু হয়ে যেতো। যাদের প্রি-টিন বা টিনেজ মেয়ে আছে, তারা এই বিষয়টা খুব ভালভাবে জানেন। আমি নিজে যখন আমার ওই বয়সে সময়টা স্মরণে আনি, ওই রকম বিনা কারণে হাসির বিষয়টা মনে করতে পারি না। এর মানে অবশ্য এই না যে ছেলেরাও অল্পতেই হাসে না। হাসে, তবে সেটা মেয়েদের তুলনায় কম।

যাইহোক, হাসি যে সংক্রামক, এ নিয়ে কারোরই তেমন কোনো সন্দেহ নেই। হাসি সংক্রামক, কিন্তু এই সংক্রমণ কি মহামারীর দিকে ঠেলে দিতে পারে? হ্যাঁ পারে। তাঞ্জানিয়াতে এমন একটা ঘটনা ঘটেছিলো।১৯৬২ সালে। 'লাফটার এপিডেমিক' নামে সেটা এখনো বিখ্যাত হয়ে আছে।

আমি আগেই বলেছি যে মেয়েদের মধ্যে হাসার প্রবণতা ছেলেদের তুলনায় বেশি। তাঞ্জানিয়ার এই লাফটার এপিডেমিকও শুরু হয়েছিলো মেয়েদের মাধ্যমেই।

কাশাশা নামের একটা গ্রামে একটা বোর্ডিং স্কুল ছিলো। ওই স্কুলের তিন ছাত্রী প্রথম হেসে ওঠে। এদের মধ্যে কেউ একজন হয়তো অন্য দুজনকে কৌতুক শুনিয়েছিলো, বা হাসির কিছু বলেছিলো। সেটা শুনে বাকি দুইজনও তার সাথে হেসে উঠেছিলো। এটা খুবই স্বাভাবিক একটা বিষয়। ওই বয়সী মেয়েরা নানা বিষয় নিয়ে হাসাহাসি করবেই।

এই হাসাহাসি এখানেই সীমাবদ্ধ থাকলে সমস্যা ছিলো না। অল্পক্ষণের মধ্যেই দেখা গেলো যে ওই স্কুলের সব ছাত্রীর মধ্যেই সেই হাসি সংক্রমিত হয়ে গেলো। শুধু সেখানেই হাসি আটকে থাকলো না, সেটা ছড়িয়ে পড়লো আশেপাশের গ্রামেও। অন্য স্কুলের বাচ্চারাও সেই হাসিতে যোগ দিলো। এই হাসি শুধু একদিনে ঘটলেও না হয় মানা যেতো। এই হাসির ঘটনা ঘটতে থাকলো দিনের পর দিন ধরে, মাসের পর মাস ধরে। বছরেরও বেশ সময় ধরে।

হাসি আটকাতে কর্তৃপক্ষ অনেক স্কুল বন্ধ করে দিয়েছিলো। তাতেও কোনো লাভ হয়নি। স্কুল খোলার পরে বাচ্চারা স্কুলে ফেরত আসার পরে আবারও সে গণ হাসি শুরু হয়। শুধু হাসি না, হাসির সাথে কান্নাও যুক্ত হয়েছিলো। অনেকটা হিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত রোগীর মতো অবস্থা ছিলো তাদের। তাঞ্জানিয়ার সেই লাফটার এপিডেমিকের ভিডিও পাওয়া যায়। সেই ভিডিও দেখলেই বাচ্চাদের উন্মত্ত অবস্থা বুঝতে পারা যায়।

বাচ্চাদের এই হাসির পিছনে কি আসলে আনন্দময় কোনো বিষয় ছিলো? এতোই আনন্দের বিষয় যে এক বছরের বেশি সময় ধরে হেসেও সেই আনন্দ শেষ হচ্ছিলো না তাদের? না, এই হাসির সাথে আনন্দের কোনো উপাদান যুক্ত ছিলো না, যুক্ত ছিলো বরং উদ্বেগ সংশ্লিষ্ট বিষয়।

তাঞ্জানিয়া তখন সদ্য স্বাধীন হয়েছে। স্কুলগুলোতে বাচ্চাদের যখন নতুন প্রত্যাশার মান ঠিক করা হয়েছে। এই চাপ বাচ্চারা নিতে অক্ষম ছিলো। এই চাপকে প্রতিরোধ করার মতো সক্ষমতাও তাদের ছিলো না। ফলে, তারা মাস হিস্টিরিয়ার মাধ্যমে সেই চাপকে মোকাবেলা করতে চেষ্টা করেছে নিজেদের অজান্তেই। প্রকাশ করার চেষ্টা করেছে নিজেদের কষ্টকে। বলার চেষ্টা করেছে, আমরা ভালো নেই।

হাসি শুধু তাই আনন্দেরই প্রতিফলন না, কষ্টেরও। চাপা কষ্টেও মানুষ হাসে।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.