Sylhet Today 24 PRINT

সিলেটি ভাষার অস্তিত্ব নাগরি বর্ণমালা

শাকিলা ববি |  ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪

নাগরি লিপি

সিলেট নগরীর মদিনা মার্কেট এলাকার বাসিন্দা খুদেজা বিবি (৬৯)। নাগরি লিপি নিয়ে তার অনেক স্মৃতি। তিনি বলেন, ‘ আমার বাড়ি হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে। হাওর এলাকা, এর লাগি বর্ষার সময় কোনো কাজ থাকতো না। তখন আমরার বাড়িত পুতি পাঠ হইতো। আমি তখন অনেক ছোট। আমার মামা আবদুল আহাদ পুতি পাঠ করতা। ইতা পুতি আছিল নাগরি অক্ষরে লেখা। হালতুননবী নামে আরেকটা পুতি আছিল নবীজির জীবনী নিয়া। ইটাও নাগরি লেখা। ইতা পুতি পইড়া রাইতে পর রাইত পার হইতো। কিন্তু এখন পুতিও নাই নাগরি লেখাও নাই।’

যেকোনো দেশের ভাষার যেমন নিজস্ব বর্ণমালা আছে ঠিক তেমনি সিলেটি ভাষারও আছে নিজস্ব বর্ণমালা। এই বর্ণমালার নাম নাগরি। মূলত সিলেটি ভাষার লিপি বা অক্ষর হল নাগরি। একসময় বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছিল নাগরি বর্ণমালা। কয়েকশ বছর আগে নাগরি লিপিতে রচিত হয়েছে শত শত সাহিত্য, গ্রন্থ, দলিল। তখন মানুষজন চিঠিপত্রও লিখতেন নাগরি বর্ণমালায়।

নাগরি লিপির উদ্ভব নিয়ে গবেষকদের মধ্যে বেশ মতপার্থক্য রয়েছে। নাগরি গবেষকদের এক পক্ষের মতে চতুর্দশ শতকে ৩৬০ সফরসঙ্গী নিয়ে সিলেটে আসেন হজরত শাহজালাল (রহ.)। তখন তার সফরসঙ্গীদের মাধ্যমে সিলেটে নাগরি লিপির প্রচলন ঘটে। তখন সিলেট অঞ্চলের মানুষজন লেখাপড়া, সাহিত্যচর্চায় বেশি উদ্বুদ্ধ হন। আরেকপক্ষ মনে করেন ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে এ অঞ্চলে আফগান উপনিবেশের সময় নাগরি লিপির উৎপত্তি হয়। আবার আরেকটি পক্ষ মনে করেন, ব্রিটিশ শাসনের শুরুর দিকে এ লিপির উদ্ভব। তবে উদ্ভব নিয়ে মতপার্থক্য থাকলেও বেশির ভাগ গবেষকই মনে করেন, হজরত শাহজালাল ও তার সফরসঙ্গীদের মাধ্যমে সিলেটে নাগরি লিপির প্রচলন ঘটে। তৎকালীন ইসলামি নানা কাহিনী, সুফিবাদ ও ফকিরি গান নাগরিলিপিতে পুঁথি রূপে বের করা হয়।

নাগরি লিপির অবিচ্ছেদ্য অংশ হল হজরত মোহাম্মদের (সা.) জীবনীভিত্তিক কোনও গ্রন্থ ‘কেতাব হালতুননবী’। কথিত আছে তখনকার সময় সিলেটিদের ঘরে ঘরে পবিত্র কোরআন শরিফের পর ‘কেতাব হালতুননবী’ গ্রন্থকে শ্রদ্ধা করা হতো। ১৮৬০ সালে কেতাব হালতুননবী গ্রন্থ আকারে প্রকাশ হয়। নাগরি সাহিত্যের জনপ্রিয় সাহিত্যিক মুন্সী ছাদেক আলী এই গ্রন্থটি রচনা করেন। তাই মুন্সী ছাদেক আলী, সিলেটি ভাষা ও সিলেটি সাহিত্যের প্রাণপুরুষ বলা হয়।

নাগরি লিপির বিশাল সাহিত্য ভাণ্ডার রয়েছে। নাগরি সিলেটিদের অস্তিত্ব তাই নাগরি সম্পর্কে সকলকে জানাতে সিলেট নগরীতে করা হয়েছে নাগরি চত্বর। সিলেট নগরের প্রবেশদ্বার কিনব্রিজের উত্তর পাড়ের চত্বরের নামকরণ করা হয়েছে নাগরি চত্বর। ২০১৪ সালে নাগরি বর্ণমালা দিয়ে এই চত্বরে একটি নান্দনিক স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে অনেক সিলেটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে নাগরি বর্ণমালার ব্যবহার করছেন। বাড়ির নেইমপ্লেইট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম, নিজের প্রিয় মানুষের কাঠে বা পাথরে খোদাই করে লিখে রাখছেন। অনেকেই নাগরি বর্ণমালার বই নিয়ে সন্তানদের পরিচিত করাচ্ছেন।

সিলেটের প্রবীণ ও ইতিহাসবিদদের মতে, নাগরি লিপি স্বতন্ত্র একটি লিপি। কোনো ভাষার উপভাষা বা আঞ্চলিক ভাষা নয়। নাগরি বর্ণমালা যেন বিলুপ্ত না হয় সেজন্য দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন মৌলভীবাজার জেলার রাজগনগর উপজেলার বাগাজুরা গ্রামের আইনজীবী ও প্রবাসী মো. মমিনুল হক (৬০)। তিনি নাগরি বর্ণমালায় সিলেটে খবর নামে পত্রিকা বের করেছেন। এছাড়ার নাগরি ইতিহাসের বই, নাগরি কবিতার বই, নাগরি বর্ণমালার বই, দেয়াল লিখন, ক্যালেন্ডার তৈরিসহ নানা সচেতনতামূলক কার্যক্রম করছেন।

মো. মমিনুল হক বলেন, আমি গর্ব করি আমার মায়ের ভাষা সিলেটি ভাষা। আমাদের ভাষার নাম সিলেটে আর বর্ণ নাগরি। এরজন্য অনেক মানুষ বিষয়টাকে গুলিয়ে ফেলেন, ভুল করেন। অনেকেই বলেন নাগরি ভাষা। আসলে নাগরি ভাষা না, এটা বর্ণমালা। সিলেট অঞ্চলের ঘরে ঘরে পবিত্র কোরআনের পর যদি দ্বিতীয় কোনো গ্রন্থ সমাদৃত ছিল সেটা হল ‘হালতুননবী’। ‘হালতুননবী’ ছিল নাগরি ভাষায় লিখা। এই বইয়ে লেখন মুন্সী ছাদেক আলী। তিনি সিলেটি ভাষা ও সিলেটি সাহিত্যের প্রাণপুরুষ ছিলেন। নাগরি বর্ণমালায় প্রায় একশত লেখকের দুইশত বই আছে। এরপরও এই বর্ণমালার কথা বাংলা সাহিত্যের কোথাও নেই। স্কুল কলেজের পাঠ্যবইয়ে এই নাগরি বর্ণমালা বা সিলেটি ভাষার কথা উল্লেখ নাই। আমি চাই সিলেটি ভাষার আরও প্রসার হোক। সরকার থেকে স্বীকৃতি দেওয়া হোক। এই স্বীকৃতির মাধ্যমে বাংলাদেশের সংস্কৃতির মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। কারণ নাগরি বর্ণমালা বাংলা সাহিত্যের অংশ।

মো. মমিনুল হক বলেন, যে ভাষার বর্ণ আছে সে ভাষা উপভাষা বা আঞ্চলিক ভাষা হতে পারে না। সিলেটি কোনো ভাষার উপভাষা বা আঞ্চলিক ভাষা নয়। অনেকে মনে করেন সিলেটি ভাষা অশুদ্ধ ভাষা। কিন্তু না প্রতিটি মাতৃভাষা শুদ্ধ ভাষা। তাই সিলেটি ভাষাও শুদ্ধ ভাষা। সারা বিশ্বে প্রায় দুই কোটি মানুষের ভাষা সিলেটি। কিন্তু এই ভাষার স্বীকৃতি না দেওয়ায় বৃহত্তর জনগোষ্ঠী মনে করে সিলেটি ভাষা নয়। একদল লোক মনে করে সিলেটিরা বাংলা ভাষা ভাল করে বলতে না পেরে তার মানে ভাষাকে আহত করেছে। কিন্তু এটা ঠিক নয়। এটা সিলেটি ভাষা নিয়ে ভুল ধারণা। মাতৃভাষার জন্য একুশে ফেব্রুয়ারি শহিদ হন আমাদের ভাইয়েরা। তাই শুধু বাংলা নয় প্রত্যেকের মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। এছাড়া একটি সাহিত্য ভাণ্ডার হারিয়ে যাওয়া মানে নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে যাওয়া। তাই নাগরি লিপিকে স্বীকৃতি দিলে কারো কোনো ক্ষতি হবে না বরং বাংলা সাহিত্য ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হবে।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.