Sylhet Today 24 PRINT

বাতিল হয়ে যাওয়া ‘জাতীয় সংবিধান দিবস’ আজ

নিজস্ব প্রতিবেদক |  ০৪ নভেম্বর, ২০২৫

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নির্বাহী আদেশে বাতিল হয়ে যাওয়া জাতীয় সংবিধান দিবস আজ।

গত বছরের ১৬ অক্টোবর সরকারের এক নির্বাহী আদেশে জাতীয় সংবিধান দিবসসহ আটটি দিবসকে বাতিল করা হয়। এ সিদ্ধান্ত যথাযথভাবে প্রতিপালনে প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব, সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিব/সিনিয়র সচিব, প্রধান তথ্য কর্মকর্তা, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক (ডিসি), উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে ১৬ অক্টোবর অফিস আদেশ পাঠানো হয়। ফলে এবার জাতীয়ভাবে পালিত হয়নি জাতীয় সংবিধান দিবস।

১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হয়েছিল। যা কার্যকর হয় ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর (বিজয় দিবস) থেকে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর ২০২২ সালের ৪ নভেম্বর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায় সংবিধান দিবস। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ৪ নভেম্বর 'জাতীয় সংবিধান দিবস' হিসেবে 'ক' ক্রমিকে পালিত হবে বলে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

দেশের মূল আইন সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে ১৯৭২ সালের ১১ এপ্রিল ড. কামাল হোসেনকে সভাপতি করে ৩৪ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। একই বছরের ১৭ এপ্রিল থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত এই কমিটি বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠক করে। জনগণের মতামত সংগ্রহের জন্য সভা আহ্বান করা হয়। সংগৃহীত মতামত থেকে ৯৮টি সুপারিশ নেওয়া হয়। ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশনে তৎকালীন আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন খসড়া সংবিধান বিল আকারে উত্থাপন করেন।

১৯৭২ সালে মূল সংবিধান ইংরেজি ভাষায় রচিত হয় এবং একে বাংলায় অনুবাদ করা হয়। তাই এটি বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় বিদ্যমান। তবে ইংরেজি ও বাংলার মধ্যে অর্থগত বিরোধ দৃশ্যমান হলে বাংলা রূপ অনুসরণীয় হবে বলে সংবিধানে বলা হয়েছে।

গণপরিষদে সংবিধানের ওপর বক্তব্য রাখতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘এই সংবিধান শহিদের রক্তে লিখিত, এ সংবিধান সমগ্র জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক হয়ে বেঁচে থাকবে।’

এ যাবৎকালে বাংলাদেশের সংবিধান সর্বমোট ১৭ বার সংশোধিত হয়েছে।

বাংলাদেশের সংবিধান কেবল বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইনই নয়; সংবিধানে বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের মূল চরিত্র বর্ণিত রয়েছে। এতে বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমারেখা উল্লেখ করা আছে। দেশটি হবে প্রজাতান্ত্রিক, গণতন্ত্র হবে এদেশের প্রশাসনিক ভিত্তি, জনগণ হবে সব ক্ষমতার উৎস এবং বিচার বিভাগ হবে স্বাধীন। জনগণ সব ক্ষমতার উৎস হলেও দেশ আইনের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। সংবিধানে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে নেওয়া হয়েছে।

গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সরকারসমর্থকেরা সংবিধানকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে নতুনভাবে লেখার কথা জানায়। এরপর জাতীয় ঐকমত্য কমিশন নামের একটা কমিশন গঠন করে সরকার। কমিশন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করে ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ নামে একটি দলিল প্রণয়ন করে এবং দেশের কয়েকটি রাজনৈতিক দল সেটা প্রতিপালনে অঙ্গীকারনামায় সই করে এ-বছরের ১৭ অক্টোবর। অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসসহ কমিশনের সদস্য ও বিএনপি-জামায়াত নেতারা উপস্থিত ছিলেন। জুলাই সনদে বাহাত্তরের মূল সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার চার মূলনীতিসহ অনেকগুলো বিষয়ে সংশোধনী আনার প্রস্তাব করা হয়েছে, এবং ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, জাতীয় সংসদ এই সংশোধনী পাস না করলে ২৭০ দিন পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা সংবিধানের সংশ্লিষ্ট ধারায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। রাষ্ট্র সংস্কারে ঐকমত্য কমিশন যে ৮৪ দফা সুপারিশ দিয়েছে, তার ৪৮টিই সংবিধান সংস্কার বিষয়ে। এখন এসব সংস্কার কিভাবে হবে, তা নিয়ে চলছে আলোচনা ও মতবিরোধ।

সংবিধান বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, প্রতিটি দেশেরই সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, এটা কাটাছেড়া বা সংশোধন করা যায়। প্রয়োজন অনুযায়ী সংবিধান সংশোধনের পদ্ধতি সংবিধানের মধ্যেই দেওয়া আছে। সংবিধানের বাইরে গিয়ে কোন পরিবর্তনের সুযোগ নেই। কেউ করতে চাইলে, সেটা অসাংবিধানিক হবে। তিনি বলেন, আবার এই সংশোধনের মাধ্যমে মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হলো কি না, এ গুলো দেখার ক্ষমতা আমাদের সুপ্রিম কোর্টকে দেওয়া আছে।

তিনি বলেন, বর্তমান অন্তবর্তী সরকারের সময়ে দেখা যাচ্ছে, সাংবিধানিক বিভিন্ন বিষয় শুধু একটা অধ্যাদেশের মাধ্যমে বদলে দেওয়া হচ্ছে। এটা একটা অবৈধ প্রক্রিয়া। একটা কাগজ দিয়ে আপনি অধ্যাদেশ জারি করে দিলেন, তাতে কিছু যায় আসে না। সংবিধান তার জায়গায় থেকে যাবে। আজকে না হোক, সময়ের আলোকে সেগুলো অবৈধই ঘোষণা হবে। কোনদিন সেটা বৈধ হবে না।

তিনি বলেন, কিছু লোক সংবিধান বাতিল চায়। সংবিধানকে ছুড়ে ফেলতে চায়। এটার একটাই কারণ, এই সংবিধান মুক্তিযুদ্ধের ওপর ভিত্তি করে প্রণয়ন করা। ৩০ লক্ষ শহিদের রক্তের বিনিময়ে তৈরি করা। যারা মুক্তিযুদ্ধ বিশ্বাস করেন না, তারাই সংবিধান ছুড়ে ফেলতে চায়।

সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনের দেওয়া সুপারিশকে অসাংবিধানিক ও অবাস্তব বলে মন্তব্য করেছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত তার এক নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, ঐকমত্য কমিশন তাদের ৮৪টি সুপারিশ সম্পর্কিত একটি দলিল প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দিয়েছেন এবং এতে তারা সবাই স্বাক্ষর করেছেন। জানতে পেরেছি, ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে ৪৮টিই সংবিধানসংক্রান্ত। বলা হয়েছে, এ প্রস্তাবগুলোর ওপরে গণভোট হবে। গণভোট কবে হবে, সেটি নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। কেউ চাচ্ছে আগে, কেউ চাচ্ছে পরে, কেউ চাচ্ছে একই দিনে। এ বিতর্ক কীভাবে সমাধান হবে, সেটিতে আমরা যাব না। তিনি আরও লিখেন, ৪৮টি সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে যতগুলো সংবাদমাধ্যমে আসছে, তাতে দেখছি, সবই বর্তমান সংবিধানের পরিপন্থি বা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

তিনি আরও লিখেছেন, প্রশ্ন হলো, এ ৪৮টি সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাবগুলো-দেখে, পড়ে, বুঝে মতামত দিতে পারবেন কয়জন লোকে? সংবিধানের চর্চা কিন্তু জেলা আদালতে হয় না। জেলা আদালতে হয় দেওয়ানি মামলা আর ফৌজদারি মামলা। সংবিধানের চর্চা হয় শুধু সুপ্রিম কোর্টে। এটি জেলা আদালতের বিচারক এবং আইনজীবীদের সাধারণত করতে হয় না। যেখানে দুই-চার-পাঁচ হাজার আইনজীবীর মধ্যেই সংবিধানটা সীমাবদ্ধ, সেখানে দেশের সাধারণ জনগণ, এমনকি সুপ্রিম কোর্টের বাইরে থাকা অন্যান্য আদালতের আইনজীবীরাও যেহেতু এটা চর্চা করেন না, অতএব তাদের পক্ষেও এটি পড়ে বুঝে মতামত তৈরি করা বা সিদ্ধান্তে আসা খুবই দুষ্কর হবে।

সংবিধান দিবসের কর্মসূচি
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নির্বাহী আদেশে জাতীয় সংবিধান দিবস বাতিল হয়ে যাওয়ার পর এবার জাতীয়ভাবে উদযাপিত হচ্ছে না দিবসটি। তবে আগামী ৬ নভেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবে গণফোরাম সংবিধান দিবসের অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ড. কামাল হোসেন।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
✉ sylhettoday24@gmail.com ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.