সনেট দেব চৌধুরী, শ্রীমঙ্গল | ২৮ এপ্রিল, ২০১৫
লোকসানের মুখে পড়েছে মৌলভীবাজার জেলার দ্বিতীয় সম্ভাবনাময় অর্থকরী ফসল লেবু চাষাবাদ। উৎপাদন হলেও পরিবহন সংকটের কারণে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে লেবু পাঠাতে পারছেন না ২ হাজারের বেশী বাগান মালিক ও পাইকাররা। কাজ না থাকায় বাগানে কর্মরত শত শত শ্রমিক বেকার হতে চলেছেন।
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল লেবু চাষের জন্য বিখ্যাত। কাক ডাকা ভোর থেকে দিনভর জীপ, টেম্পো, ট্রাক ও ঠেলা গাড়ীতে করে পাহাড়ী এলাকা থেকে বিপুল পরিমান লেবু শ্রীমঙ্গলের বাজারে আসে। এখান থেকে প্রতিদিন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শত শত টন লেবু পাইকারী ব্যবসায়ীরা নিয়ে যান। দেশের অভ্যন্তরে চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশ লেবু উৎপাদিত হয় জেলার শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জের বিভিন্ন পাহাড়ী টিলায়। এখানে প্রায় ১৫‘শ ৬০ হেক্টর জমিতে লেবু চাষাবাদ হয়। এসব জমিতে প্রতি হেক্টরে গড়ে ৩ মেট্রিকটন লেবু উৎপাদন হয়। ব্যাপক চাহিদা থাকায় এসব এলাকায় গড়ে উঠা ২ হাজারের বেশী লেবু বাগানে প্রতি মাসে প্রায় ৫‘শ মেট্রিকটন লেবু দেশের বাজারে চাহিদা মিটিয়ে যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়ে থাকে। আর শ্রীমঙ্গলের বাজারে বছরে কমপক্ষে ৭০ কোটি টাকার লেবু বেচা-কেনা হয়ে থাকে।
এখানে ব্যাপক হারে কাগজি লেবু ছাড়াও উৎপাদিত হয় উন্নত মানের চায়না, জারা, এলাচি, সিডলেস লেবু। দেশের প্রসাধনী ও কেমিক্যাল কোম্পানিগুলো এখান থেকে লেবু ক্রয় করে তাকে। তাছাড়া বেভারেজ কোম্পানিগুলোর কোমল পানীয় তৈরীর জন্য প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ লেবু ঢাকা ও চট্টগ্রামে সরবরাহ করা হয়।
এদিকে টানা দুই মাস ধরে চলা বিএনপি জামায়াত জোটের অবরোধ ও হরতালের নামে নাশকতার সৃষ্টির কারণে জেলার দ্বিতীয় সম্ভানাময় অর্থকরী ফসল লেবু উৎপাদিত হলেও সময়মত নিদিষ্ট স্থানে পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। মৌসুম না হলেও চাহিদার কারণে এই সময়ে প্রতিটি উন্নত মানের লেবুর উৎপাদন খরচ পড়ে গড়ে ৪ থেকে ৫ টাকা। আর তা বিক্রি করা হয় ৭ থেকে ৮ টাকায়।
বাগান মালিকরা জানান, হরতাল-অবরোধের পূর্বে প্রতি মাসে গড়ে ৫‘শ টন লেবু দেশের অভ্যন্তরে চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানী হত। কিন্তু চলমান রাজনৈতিক সংকটের কারণে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গত দেড় মাসে ১‘শ টন লেবুও পাঠানো সম্ভব হয়নি। ফলে লেবু সরবরাহ ও দেশের বাইরে রফতানি করতে পারছে না হতাশ হয়ে পড়েছেন জেলার লেবু ব্যবসায়ীরা।
এসব লেবু বাগানে কর্মরত চাষি ও বাজারে কাজ করা শ্রমিকরা জানান, বর্তমানে উৎপাদিত প্রতিটি লেবু বিক্রি করতে হচ্ছে দেড় থেকে দুই টাকায়। হরতাল অবরোধের কারণে আগের মত নেই বাজারের বেচাকেনা। আর উৎপাদন খরচ কুলিয়ে উঠতে না পারায় অনেক বাগান মালিক আপাতত লেবু চাষাবাদ ও উৎপাদন বন্ধ করে দেয়ায় তারা পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
সম্ভাবনাময় অর্থকরী ফসল লেবুর চাহিদা থাকলেও দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় লেবু চাষের জন্য সেচ ব্যবস্থা খুবই ব্যয়বহুল। ডিজেলচালিত পাম্প দিয়ে গভীর নলকূপ থেকে পানি উঠিয়ে সেচ কাজ চালানো হয়। যে কারণে খরচ বহুগুণে বেড়ে যায়। অন্যদিকে শ্রীমঙ্গলে লেবু সংরক্ষনের জন্য আজ অবধি কোন কোল্ডষ্টোরেজ গড়ে না উঠায় আরও বেশী বিপাকে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। এটি কাঁচামাল হওয়ায় গাছ থেকে লেবু সংগ্রহের পর খুব বেশী হলে ২/৩ দিন পর্যন্ত খোলা স্থানে রাখা যায়।
এদিকে টানা অবরোধ ও হরতালের কারনে পরিবহন সঙ্কট দেখা দেয়ায় গত দেড় মাস লেবুর অর্ডার থাকলেও বাহিরে পাঠানো যাচ্ছে না। আর যে সব ব্যবসায়ী লেবু পাঠাচ্ছেন তাদেরকে গুনতে হচ্ছে অধিক ভাড়া। ফলে প্রতিদিনি লক্ষ লক্ষ টাকার লোকসান গুণতে হচ্ছে বাগান মালিকদের।
এদিকে দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় লেবু চাষের জন্য বৈদ্যুতিক নলকুপের মাধ্যমে সেচ কার্য চালানো এবং লেবু প্রক্রিয়াজাতের জন্য কোন ধরনের ফ্যাক্টরী ও সজীব রাখার জন্য কোল্ড স্টোরিজ নির্মান করা হলে এখানকার উৎপাদিত লেবু দেশের চাহিদা মিটিয়ে বহিঃর্বিশ্বে ব্যাপক হারে রপ্তানি করা সম্ভব এমনটাই প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের।