Sylhet Today 24 PRINT

কারবালার বিয়োগান্তক ঘটনা ও জারি

শাকিলা ববি  |  ০১ অক্টোবর, ২০১৭

 

“মহররমের ঐ দশ তারিখে কী ঘটাইলেন রাব্বানা/ মায়ে কান্দে জি-এ কান্দে কান্দে বিবি সকিনা/ একই ঘরে তিন জন গো রাড়ি (বিধবা) খালি সোনার মদিনা”, “ও আল্লাহ কি হইলরে দারুণ ও কারবালায়/ কাশেমের দায় কাইন্দা বাসাইন বিবি সকিনায়/ ও আল্লাহ কি হইলরে দারুণ ও কারবালায়”- এরকম হৃদয়বিদারক কথা উপর সুর দিয়ে পায়রা ছন্দে যা পরিবেশন করা হয় তাই কারবালার জারি বা শোকের জারি হিসেবে পরিচিত।

আজ ১০ মহররম। মুসলিম সম্প্রদায়ের শোকের দিন। আরবি মহররম মাসের ১০ তারিখে কারবালার যুদ্ধে শহীদ হন রাসূল (সা)-এর দৌহিত্র ইমাম হোসেন ও তার পরিবার। কারবালার হৃদয়বিদারক বিয়োগান্তক ঘটনাকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্মরণ করার জন্য মহররম মাসের প্রথম দশ দিন হজরত ইমাম হোসেন ও তার পরিবারের সদস্যদের স্মরণে জারি গান পরিবেশন করা হয়ে থাকে।

জারি শব্দের উৎপত্তি আহাজারি থেকে। জারি মূলত শোক সংগীত। কয়েকজন মিলে যৌথভাবে এ শোক সংগীত পরিবেশন করা হয়। মুসলিম সমাজে জারির উৎপত্তি কারবালার শোকাবহ ঘটনার স্মরণ করার উদ্দেশ্যে। যতদূর জানা যায় ইরাক এবং আশপাশের দেশে শিয়া সম্প্রদায় কারবালার জারির প্রচলন ঘটায়। পরবর্তীতে সারা বিশ্বের শিয়া সম্প্রদায় ১ থেকে ১০ মহররম পর্যন্ত ধারাবাহিক শোক অনুষ্ঠান পালন করা হয়। বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশে শিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন আছেন। কিন্তু ব্যাপক আকারে এ অঞ্চলে কারবালার জারি ও অন্যান্য অনুষ্ঠানমালা পালন করেন মূলত সুন্নি সম্প্রদায়। তবে শিয়া সম্প্রদায়ের যে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস করেন তারা তাদের নিয়মে মহররমের অনুষ্ঠানাদি পালন করে থাকেন। বাংলাদেশের শিয়া সম্প্রদায়ের মূল কেন্দ্র হচ্ছে পুরান ঢাকার হোসনি দালান। তারাই বাংলাদেশে মহররম কেন্দ্রিক অনুষ্ঠান পালনের সূচনা করেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশের সুন্নি সম্প্রদায়ের মধ্যেও মহররমের এ আনুষ্ঠানিক পালন করা হয়।

হবিগঞ্জে শিয়া সম্প্রদায়ের কোন বাসিন্দা না থাকলেও, প্রতি বছরই সুন্নি সম্প্রদায়ের সুফি মতাদর্শের অনুসারীরা কারবালার এই শোকাবহ ঘটনার স্মরণে ১ থেকে ১০ মহররম পর্যন্ত বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদি পালন করেন। ১০দিনের পালনীয় মহররমের অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ধরনের কৃচ্ছতা সাধন করেন তারা। এর মধ্যে রয়েছে বিছানায় না শোয়া, লবণ মুক্ত নিরামিষ আহার ও সকল ধরনের আনন্দ অনুষ্ঠান বর্জন এবং মাতম জারি। প্রতিদিনই মোকাম বাড়িতে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত শতাধিক নারী একত্রিত হয়ে জারি পরিবেশন করেন। জারি গানের মূল শিল্পী হলেন নারীরা। বিশেষ করে বয়স্ক গৃহিণীরা।

শহরতলীর বড় বহুলা মোকাম বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় প্রায় ২ শতাধিক বিভিন্ন বয়সের নারীরা মিলে জারি পরিবেশন করছেন। মধ্য বয়স্ক এবং বয়স্ক নারীরই সংখ্যায় বেশি ছিলেন।

৬০ ঊর্ধ্ব বয়সী ফয়জুন্নেছা বলেন, ‘বুঝ (প্রাপ্ত বয়স্ক) হওয়ার পর থেইক্কা জারি গাই। প্রথমে মা-চাচীর সাথে আইতাম মোকাম বাড়ি। সেই টানে এখন পর্যন্ত আই।’

মধ্য বয়সী মমতা বেগম জানান, কারবালা যুদ্ধের ইতিহাস স্মরণে এনে শোক প্রকাশ করতে ও ওই সময় বিবি সকিনার কষ্ট উপলব্ধি করতে তিনি জারি পরিবেশন করতে আসেন।

জারির মূল বিষয়বস্তুতে থাকে বিবি সকিনার বিলাপ। বাংলাদেশের কিছু লোককবি কারবালার এই বিয়োগান্তক কাহিনী নিয়ে জারি গানগুলো লিখে গেছেন। কিন্তু এগুলো প্রকাশিত নয়। মোকাম বাড়িগুলোতে এই জারি গানগুলো হাতে লিখা পাণ্ডুলিপি আকারে সংরক্ষিত আছে।

কেন শিয়া সম্প্রদায়ের পালন করা এ আনুষ্ঠানিকতা সুন্নি সম্প্রদায় পালন করেন? এ বিষয়ে সাহিত্যিক ও গবেষক সিদ্দিকী হারুন বলেন, বাংলাদেশের সুন্নি সম্প্রদায় (তাবলিগ জামাত ও এই মতের সমর্থকরা বাদে) সুফি মতের দ্বারা অনেকখানি প্রভাবিত। আর শিয়া মতের সঙ্গে সুফি মতের অনেক মিল আছে। সে সাদৃশ্যের কারণেই শিয়া মতে এ অনুষ্ঠানটি সুন্নি সম্প্রদায়ের মধ্যেও চালু হয়েছে বলে গবেষকগণ মনে করেন।

সিদ্দিকী হারুন আরও বলেন, কোন কোন এলাকায় কারবালার ঘটনার অনুকরণে চলমান নাট্যপালা অভিনীত হওয়ার কথাও জানা যায়। সব কিছুই হচ্ছে শোকের ঘটনাকে স্মরণ করা সেই সাথে নবী করিম (সা) ও তার বংশধরদের প্রতি ভালবাসার প্রকাশ ঘটানো। এছাড়াও মহররমের আরেকটি মূল আদর্শিক বিশ্বাস হচ্ছে মুসলমানদের মধ্যে মূল ধারা ও ভ্রান্ত ধারার দ্বন্দ্ব। কারবালার ঘটনা ও এর আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে হোসনি ইসলাম ও এজিদী এসলামের লড়াইটাও স্পষ্ট করে তোলা হয়।

জারি গানের বিষয়বস্তু নিয়ে সিদ্দীকি হারুন বলেন, মূলত নব বিবাহিতা সকিনা বিবির স্বামী হারানোর বিরহ এবং বিলাপই থাকে জারি গানে। এছাড়াও ১০ মহররম কারবালার যুদ্ধে পানির কষ্টে মারা যাওয়ার কথা ও সর্বশেষে ইমাম হোসেনের শহীদ হওয়ার কথাগুলো থাকে জারির বিষয়বস্তু।

মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষজন বিশ্বাস করেন, নবীজিকে ভালবাসলে খোদাকে পাওয়া যায়। জারির মাধ্যমে নবী করিম (সা)-এর উত্তরাধিকারীদের প্রতি ভালবাসা প্রকাশ ও সর্বশেষে নবীর প্রতি ভালবাসা প্রকাশ করাই হচ্ছে মূল উদ্দেশ্য।

 

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.