সিলেটটুডে ডেস্ক | ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮
সোমবার নর্থ ইস্ট ইউনিভার্সিটিতে বসন্তবরণ অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশন করছেন এক শিল্পী
আমার প্রাণের ‘পরে চলে গেল কে/বসন্তের বাতাসটুকুর মতো...। লাগলো কি প্রাণে সেই বাতাস? বসন্তের বাতাসটুকু প্রাণেই লাগে বেশি! টের পাওয়া যাচ্ছে? চেনা যাচ্ছে হাওয়াটা? না চিনলেও ক্ষতি নেই। কবিগুরু বলছেন- যদি তারে নাই চিনি গো সে কি আমায় নেবে চিনে/এই নব ফাল্গুনের দিনে...। সেই বুক ধুকপুক, সেই শিহরণ জাগানিয়া ফাগুন এসেছে।
ফুলেল, মধুময়, যৌবনের উদ্দামতা বয়ে আনা ও আনন্দ-উচ্ছ্বাস-উদ্বেলতায় মনপ্রাণ কেড়ে নেয়ার বসন্তের আজ প্রথম দিন। ফুল ফোটার, 'ঘুম ভাঙানিয়া মরার কোকিল' ডাকবার, মাতাল হাওয়ায় পুলকিত হওয়ার আর স্বপ্ন জাগানিয়া দখিনা হাওয়ার ঋতু বসন্ত আবার এসেছে ফিরে সব বাঙালির ঘরে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে হাল আমলের বাংলা সাহিত্যের আকাশছোঁয়া জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ পর্যন্ত কবি-সাহিত্যিকরা যে ঋতুর প্রেমিক ছিলেন, ১৪২১ বঙ্গাব্দের সেই বসন্ত ঋতু আজ থেকে শুরু হচ্ছে।
বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ, বসন্ত বাতাসে নিজের বাড়িতে আসার দিন শুরু হচ্ছে আজ থেকে। ফুল ফুটুক, বা না ফুটুক, আজ তাই বসন্ত। আকাশ ঢেকে রাখা উঁচু দালানের ঢাকা শহরের রাজপথ থেকে অলিগলি, শোয়ার ঘর থেকে উদ্যান- সবখানে আজ বসন্তের ছোঁয়া লাগবে। বাঙালির জীবনে এমন রং ফাগুনের মতো আর কোন ঋতু ছড়াতে পারে!
পহেলা ফাগুনে আজ সবাই মিলিত হবে প্রকৃতির সঙ্গে, নিজেকে নতুন করে চিনে নেবে, মিলিয়ে নেবে অসাম্প্রদায়িক প্রীতির বন্ধনে। বসন্ত শুধুু অশোক-পলাশ-শিমুলেই উচ্ছ্বাসের রং ছড়ায় না, আমাদের ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে শহীদদের রক্তরঙিন পুষ্পিত রক্তের স্মৃতির ওপরও রং ছড়ায়। বায়ান্ন সালের আট ফাল্গুন বা একুশের পলাশরাঙা দিনের সঙ্গে তারুণ্যের সাহসী উচ্ছ্বাস আর বাঁধভাঙা আবেগের জোয়ার যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। প্রকৃতিতে পরিবর্তনের সঙ্গে তাই রাজনীতি, রাষ্ট্র ও সমাজ_ সবখানে বেজে উঠবে আশাজাগানিয়া সুর_ এ প্রত্যাশায় তরুণ প্রজন্ম আজ মেতে উঠবে বসন্তকে অভিবাদন জানাতে। প্রাণ খুলে তাই যেন কবির ভাষায় বলা যায়, 'আহা আজি এ বসন্তে এতো ফুল ফোটে/এতো বাঁশি বাজে/এতো পাখি গায়...।'
ষড়ঋতুর দেশে আবহমান গ্রামবাংলার প্রকৃতিতেই মূলত বসন্ত জানান দেয় তার আগমনী বারতা। গ্রামের মেঠোপথ, নদীর পাড়, বৃক্ষরাজি, মাঠভরা ফসলের ক্ষেত বসন্তের রঙে রঙিন হয়ে ওঠে। চোখ বুঝলেও টের পাওয়া যায় তার দৃশ্যপট। ঋতুরাজ বসন্তের ছোঁয়ায় বিবর্ণ প্রকৃতিতে জেগে উঠেছে নতুন জীবনের ঢেউ। নীল আকাশে সোনাঝরা আলোর মতোই আন্দোলিত বাঙালির হৃদয়। চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে মায়াবী এক আবেশ। সুর ছড়াচ্ছে 'একটুকু ছোঁয়া লাগে, একটুকু কথা শুনি/তাই নিয়ে মনে মনে রচি মম ফাল্গুনী...।'
গত কিছুদিন থেকেই প্রকৃতিতে 'বিভ্রান্ত' কোকিলের ডাক জানিয়ে দিচ্ছিল বসন্তের আগমনী বার্তা। ফাগুন হাওয়ার দোল লেগেছে বাংলার নিসর্গ প্রকৃতিতেও। ফুলে ফুলে রঙিন হয়ে উঠছে প্রকৃতির সবুজ অঙ্গন। মাঘের শেষ দিক থেকেই গাছে গাছে ফুটছে আমের মুকুল। শীতে খোলসে ডুুকে থাকা কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, নাগলিঙ্গম এখন অলৌকিক স্পর্শে জেগে উঠেছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে আধুনিককালের বাউল কবির মনকেও বারবার দুলিয়েছে ঋতুরাজ বসন্ত। নীলমণিলতা, বাগানবিলাস ও মাধুরীলতারা রবীন্দ্রনাথকে করে তোলে বসন্তপ্রেমী। বাঙালির জীবনে বসন্তের উপস্থিতি অনাদিকাল থেকেই। কবিতা, গান, নৃত্য আর চিত্রকলায় আছে বসন্তের বন্দনা। তবে, বসন্ত বিরহেরও। এ ঋতু আমাদের উদাসীন করে, করে গৃহত্যাগী। বারবার মনে হতে থাকে কী যেন নেই, কী যেন হারিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, '...এত দিন আমার সুখ ঘুমাইয়াছিল, আমার প্রিয়তম ছিল না; আমার আর কোনো সুখের উপকরণও ছিল না। কিন্তু জ্যোৎস্না, বাতাস ও সুগন্ধে মিলিয়া ষড়যন্ত্র করিয়া আমার সুখকে জাগাইয়া তুলিল; সে জাগিয়া দেখিল তাহার দারুণ অভাব বিদ্যমান। সে কাঁদিতে লাগিল। এই রোদনই বসন্তের বিরহ।'
নগরের মানুষ যতই নিষপ্রাণ, হিসেবি, প্রকৃতিবিচ্ছিন্ন হোক না কেন, বসন্তের দিনে নেচে ওঠে তাদের মনও। বসন্তের আজ প্রথম দিন নানা আয়োজনে আলোড়িত হবে নগরী। প্রকৃতির ছোঁয়া নিতে অনেকেই ঘর থেকে বেরিয়ে পড়বে। তরুণীরা বাসন্তী রঙের শাড়ি পরে খোঁপায় গাঁদা, পলাশসহ নানা ফুল গুঁজে আর তরুণরা বাসন্তী রঙের পাঞ্জাবি ও ফতুয়ায় নতুন করে নিজেদের সাজিয়ে নেমে আসবে পথে পথে। উৎসব আয়োজনে রাঙিয়ে নেবে নিজেকে, প্রকৃতিকে।