Sylhet Today 24 PRINT

এদেশে নারীরা এখনো সাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করতে পারেন না: সাবিনা আক্তার

সাক্ষাতকার

অদিতি দাস |  ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮

'ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য কখনো অস্ত যায় না'- ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি বুঝাতে এক সময় এমন কথা প্রচলিত ছিল।  গণতন্ত্র, মানবাধিকারসহ সভ্যতা বিকাশের নানা অগ্রযাত্রায় তাদের অবদান সর্বজনবিদিত।

সেই ব্রিটেনের বুকে অনেক আগেই বাঙ্গালিরা নানাভাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছেন। পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও নানাভাবে অবদান রাখছেন ব্রিটেনের মূলধারায়। যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনের স্থানীয় প্রশাসনিক ইউনিট টাওয়ার হ্যামলেটস বোরো কাউন্সিলের স্পিকার হয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সাবিনা আক্তার। যুক্তরাজ্যে জন্ম ও বেড়ে ওঠা সিলেটের মৌলভীবাজারের এই বিজয়লক্ষ্মী নিজের পথচলার নানা বাঁক, অভিজ্ঞতা নিয়ে সম্প্রতি কথা বলেন। আলাপচারিতার চুম্বক অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।

রাজনীতিতে যুক্ত হলাম যেভাবে
প্রথমে স্থানীয় কমিউনিটির (সম্প্রদায়) সাথে কাজ শুরু করি ২০১২ সালে। এরপর লেবার পার্টির রাজনীতিতে যুক্ত হই। আমার কাছে মনে হয়েছিল লেবার পার্টি স্থানীয় জনগণের জন্য বিভিন্ন কাজ করছে, তাদের সহায়তা করে। যুক্তরাজ্যে ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (এনএইচএস) নামে একটি মেডিক্যাল সার্ভিস আছে। যারা বিনামূল্যে মেডিক্যাল সহায়তা দেয়। এনএইচএস বিষয়ে আমরা কিছু ক্যাম্পেইন করেছিলাম। এভাবেই আসলে আমি সক্রিয় হই। লন্ডনের মতো জায়গাতেও নারীরা রাজনীতিতে আসুক, এটা অনেকেই চান না, নারীরা অগ্রাধিকার (ফার্স্ট প্রেফারেন্স) পায় না।

মানুষের ধারণা, শুধুমাত্র পুরুষরাই তা (রাজনীতি) ঠিকমতো করতে পারে। স্থানীয় অনেক নারী আছেন, যারা তাদের নিজের কথা বলতে সংকোচ বোধ করেন। যখন আমরা ক্যাম্পেইন শুরু করি, তখন বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের সাথে কথা বললাম। তাদের কি কি সমস্যা আছে, দৈনন্দিন তাদের কি ধরণের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়, প্রভৃতি বিষয়ে জানার চেষ্টা করলাম। বিশেষ করে আমাদের টাওয়ার হ্যামলেটস বোরো হচ্ছে বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা, টাওয়ার হ্যামলেটসকে আমরা বলি দ্বিতীয় বাংলাদেশ। এভাবেই শুরু হলো রাজনীতিতে আমার পথচলা।

নির্বাচনে প্রার্থী হলাম
রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার পর দলের লোকজন উৎসাহ দিতে থাকলো। বলল, তুমি কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করো। মনোনয়নও পেলাম, নির্বাচনে দাঁড়ালাম। ২০১৫ সালে আমি টাওয়ার হ্যামলেটস বোরো কাউন্সিলের স্টেফনি ওয়ার্ড থেকে কাউন্সিলর নির্বাচিত হলাম। কোন বাঙালি নারী এর আগে এই জায়গা থেকে কাউন্সিলর পদে নির্বাচিত হননি, আমিই প্রথম।

নির্বাচনের অভিজ্ঞতা
বিরোধী প্রার্থীর সমর্থকরা আমার বিরুদ্ধে নানা নেতিবাচক প্রচারণা চালিয়েছিল। তবে আমি ইতিবাচক ছিলাম, আমি একটা পরিবর্তন এনেছিলাম। কারণ আমি বেশিরভাগ নারীর সমর্থন পেয়েছিলাম। যেসব নারী আমাকে সমর্থন দিয়েছিলেন তাদের স্বামীরা বললেন, আমাদের স্ত্রীদের কারণে আমরাও আপনাকে সমর্থন দিচ্ছি। আমার পরিবারেরও সমর্থন পেয়েছিলাম। নিজের দল এবং স্থানীয়রা আমাকে যথেষ্ট সমর্থন দিয়েছেন। পরের বছর আমি ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হই।

টাওয়ার হ্যামেলটস বোরো কাউন্সিলের স্পিকার হওয়ার অনুভূতি
আমি খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে ডেপুটি স্পিকার থেকে স্পিকার পদে নির্বাচিত হই। এটি একটি বিশাল অর্জন। এই পদে আসতে সাধারণত অনেক সময় লেগে যায়, বয়স হয়ে যায় ৪০-৫০ বছর। যুক্তরাজ্যের মধ্যে আমি সবচেয়ে কম বয়সে (২৫ বছর বয়সে) স্পিকার হতে পেরেছি। আর কাউন্সিলর পদ থেকে স্পিকার পদে নির্বাচিত হতে আমার সময় লেগেছে মাত্র ২ বছর। মানুষের দৃঢ় সমর্থন ছাড়া এই পর্যায়ে আসা সম্ভব নয়।

স্পিকারের ভূমিকায় আমার কাজ
স্পিকার পদে অধিষ্ঠিত হওয়া মানে পুরো একটি বোরো’র প্রতিনিধিত্ব করা। এ পদে যেতে ৫১টি ভোট পেতে হয়েছে। স্পিকার হলেন টাওয়ার হ্যামলেটস বোরো কাউন্সিলের প্রথম শ্রেণির নাগরিক। তাকে একজন রোল মডেল ধরা হয়। কারণ জনগণ স্পিকারের কাজের সমালোচনা করে এবং তার উপর নজর রাখে। স্পিকার হিসেবে আমার মূল কাজ  হলো, কাউন্সিলের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করা এবং অধিবেশন পরিচালনা করা, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে কাউন্সিলের প্রতিনিধিত্ব করা। সেই সঙ্গে  ‘স্পিকার্স ডিনার’ আয়োজনের মধ্য দিয়ে আমি নিজের পছন্দমতো দাতব্য সংস্থার জন্য তহবিলের জোগান দেই। ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ আমাদের ওয়ার্ডে আসলে আমি তাকে অভ্যর্থনা করি। আমি যদিও লেবার পার্টির কাউন্সিলর কিন্তু একজন স্পিকার হিসেবে কাউন্সিলের অধিবেশনে আমাকে নিরপেক্ষ থাকা লাগে। লেবার, কনজারভেটিভ বা ইন্ডিপেন্ডেন্ট, প্রত্যেকটি দলের নির্বাচিত সদস্যদেরকে সমান সুযোগ করে দিতে হয় আমার। যাতে তারা তাদের মূল্যবান বক্তব্য তুলে ধরতে পারেন। কখনো কখনো এসব অধিবেশনের ব্যাপ্তি হয় ৩-৪ ঘন্টা। টাওয়ার হ্যামলেটস এর লোকজন রাজনীতির সাথে বেশি মাত্রায় সম্পৃক্ত। তারা ভোট দিয়ে প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন। তাই সতর্কতার সাথে আমাকে এই দায়িত্ব পালন করতে হয়।

আমি বলতে চাই যে, এখন পর্যন্ত আমি সঠিকভাবে আমার দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি। আমার এলাকার লোকজনের যেকোন প্রাপ্তিকে স্বীকার করা, তাদেরকে সফল হতে সাহায্য করা, স্কুল, স্বেচ্ছাসেবী ও দাতব্য সংস্থার কাজে সহায়তা করা- এগুলো আমার দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে।

নারীদের জন্য যে ধরণের কাজ করি
একজন নারী প্রতিনিধি হিসেবে বিভিন্ন নারী বিষয়ক সংগঠনকে আমি সাহায্য বা সমর্থন দেই। টাওয়ার হ্যামলেটস এলাকার নারী এবং শিশুরা যাতে পারিবারিক নির্যাতন থেকে সুরক্ষিত থাকতে পারে বা নির্যাতনের শিকার হলে জানাতে পারে, সেই বিষয়ে আমি কাজ করি। নারীরা বিভিন্ন সময়ে আমার কাছ থেকে পরামর্শ নেন। বাঙালি অধ্যুষিত হওয়ায় অনেক লোকজনই রক্ষণশীল মনমানসিকতা লালন করেন। তাই নারীদের নানা ধরণের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় এখানে।

বাংলাদেশের নারীদের উদ্দেশ্যে
বাংলাদেশের ক্ষমতাধর তিনজন মানুষ হলেন প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা এবং জাতীয় সংসদের স্পিকার, এদের প্রত্যেকেই নারী। কিন্তু তারপরেও আমি নারীর আরও বেশি অংশগ্রহণ চাই, নারী অধিকার চাই। সেই অর্থে আমরা উন্নত হতে পারিনি। যুক্তরাজ্যের তুলনায় বাংলাদেশ হচ্ছে রক্ষণশীল দেশ। এদেশের মেয়েরা অনেক সাফল্য অর্জন করেছে, বিশেষ করে শিক্ষায়। সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার হলো এখানে মেয়েদের জোরপূর্বক বিয়ে বা বাল্য বিবাহ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু মেয়েদেরকে অধিক হারে শিক্ষাগ্রহণ করতে দেয়া উচিত, তাদের স্বপ্ন সফল হতে দেয়া উচিত। এক্ষেত্রে শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। মেয়েরা চাকরি করতে চায়, স্বাবলম্বী হতে চায়। নারীদের জন্য চাকরির সুযোগ বাড়ানো উচিত। বেশিরভাগ মেয়েরা স্কুলে শিক্ষকতা করছেন। তবে অন্যান্য ক্ষেত্রে যেমন ব্যবসা, উদ্যোক্তা, আইনজীবী, চিকিৎসক বা বড় কোন ফার্মে তাদের বেশি করে কাজ করা উচিত, শীর্ষ পর্যায়ে নারীদের অবস্থান সুনিশ্চিত করা উচিত।

বাংলাদেশে নারীদের প্রতি যৌন সহিংসতার হার দিন দিন বাড়ছে, এই বিষয় নিয়ে আপনার মতামত

এদেশে নারীরা স্বাচ্ছন্দে চলাফেরা করতে পারেন না এখনও, তাদের কোন নিরাপত্তা নাই। দিনের যেকোন সময়, সন্ধ্যায় বা রাতে জরুরী কোন প্রয়োজনে বাসার বাইরে তারা যাতে নিরাপদে যেতে পারেন, স্থানীয় বাজারে বা বাচ্চাকে স্কুলে আনা নেওয়া করতে পারেন- এরকম পরিবেশ হওয়া উচিত। যৌন সহিংসতা এবং পারিবারিক নির্যাতন বেড়েই চলেছে। নারীদের সব কাজে পুরুষদের আরও সহায়ক ভূমিকা পালন করা উচিত। নারী-পুরুষ ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করলে সব ধরণের নির্যাতন মোকাবিলা করা সহজ হবে।
অদিতি দাস:: সম্পাদক, উইমেন ওয়ার্ডস

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.