Sylhet Today 24 PRINT

ইনু : অন্ধকার থেকে ফিরে আলোর ফেরিওয়ালা

নিজস্ব প্রতিবেদক |  ২৬ জুন, ২০১৫

নিজে ছিলেন মাদকাসক্ত। মদ্যপ হয়ে পড়ে থাকতেন রাস্তাঘাটে। পরিবারের কাছে ছিলেন দুশ্চিন্তার কারণ; পাড়া প্রতিবেশীর কাছে নিন্দের পাত্র।

ইনুর কাছে সে সব এখন অতীত, অন্ধকার অতীত। ইনু এখন আলোরপথযাত্রী। আলো বিলি করে বেড়ান সর্বত্র। রাস্তার হেঁটে হেঁটে স্বেচ্ছাশ্রমে মাদকাসক্তদের পরামর্শ দেন, অন্ধকার ছেড়ে আলোর পথে আসতে উদ্বুদ্ধ করেন। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে স্কুল চালান, দরিদ্র নারীদের নিয়ে সেলাই প্রশিক্ষণসহ নানা প্রশিক্ষণের আয়োজন করেন, আরও কত কী! এ যেনো আলোর ফেরিওয়ালা।

আজ সারা দেশজুড়ে মাদকবিরোধী দিবস পালিত হচ্ছে। একজন ইনু হতে পারেন মাদক থেকে ফিরে আসার এক প্রতীক।

পুরো নাম ইমতিয়াজ রহমান ইনু। নিবাস সিলেট নগরীর কুশিঘাটে। দরিদ্র পরিবারের ৩ ভাই ২ বোনের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। দারিদ্রতার কারণে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দৌড় প্রাথমিকেই আটকে যায়। সেই ছোট্ট বয়সেই কাজ নেন একটি দোকানে। ২০০০ সালের দিকে বন্ধুদের খপ্পড়ে পড়ে মাদকে ঝুঁকে পড়েন ইনু, হয়ে পড়েন মাদকসেবী।

মাদকে ঝুঁকে পড়া প্রসঙ্গে ইনু বলেন, ’পূর্বশক্রতার জের ধরে এক প্রতিবেশী চুরির অপবাদ দিয়ে আমাকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেয়। পুলিশের কাছ থেকে ছাড়া পাওয়ার পর চরম হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। তখন কিছু বন্ধুদের পাল্লায় পড়েই মাদক গ্রহণ শুরু করি।’



আলোকিত মানুষ ইনু

২০০০ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ইনুর অন্ধকার যুগ। এই পুরো সময়কাল মাদকে অতিমাত্রায় আসক্ত হয়ে পড়েন তিনি। দরিদ্র সংসারের জন্য অর্থ উপার্জন করা দূরে থাক তার মাদকের টাকা সংগ্রহের জন্য একপর্যায়ে ঘরের আসবাব বিক্রি শুরু করেন। ইনুর যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেন মা জায়েদা বেগমসহ পরিবারের সকল সদস্যই।

২০০৫ সালের শুরুর দিকে একদিন মাদকাসক্ত হয়ে সিলেট পুরনো রেলস্টেশনের কাছে পড়ে যান ইনু। রাস্তা থেকে অচেতন অবস্থায় তাকে উদ্ধার করেন বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা মেরিস্টোপের দু’জন মাঠকর্মী। তারপর পরিবারের ইচ্ছায় মেরিস্টোপের তত্ত্বাবধানে ইনুকে ভর্তি করা হয় রাজশাহীর একটি মাদক নিরাময় কেন্দ্রে। সেখানে ছয় মাস চিকিৎসা চলে ইনুর। এরপর থেকেই শুরু তাঁর বদলে যাওয়ার গল্প। অন্ধকার থেকে আলোর পথে ফেরার গল্প।

নিজে মাদকাসক্তি থেকে মুক্তি লাভের পর অন্যান্য দরিদ্র মাদকাসক্তদের এই ভয়ঙ্কর পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগী হন ইনু। একেবারে স্বপ্রণোদিত হয়ে কীনব্রিজ, রেলস্টেশন এলাকাসহ সিলেট নগরের মাদকস্পটগুলো ঘুরে ঘুরে মাদকসেবীদের নিজের জীবনের গল্প বলে বেড়াতে শুরু করেন ইনু। তার মাদকাগ্রস্ত অন্ধকার সময়ের গল্প, ফিরে আসার গল্প শোনান মাদকসেবীদের। মাদক ছেড়ে সুস্থ জীবনে ফিরে আসার আহ্বান জানান সকলকে।

ইনু বলেন, ‘দরিদ্র পরিবারের যেসব শিশু কিশোররা মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে তারা পূণর্বাসন কেন্দ্রে যাওয়ার মতো আর্থিক সঙ্গতি না থাকায় আর ফিরতে পারে না। এই চিন্তা থেকেই আমি দরিদ্র মাদকসেবীদের উদ্বুদ্ধ করতে উদ্যোগী হই।’

কেবল এখানেই থেমে থাকেন না ইনু। মাদকসেবীদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে একসময় উপলব্ধি করেন, শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকার ফলে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের একটি বড় অংশ ঝুঁকে পড়ছে মাদকে। এই উপলব্ধি থেকেই সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানের উদ্যোগ নেন ইনু। গড়ে তুলেন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যা ‘ইনুর ইশকুল’ নামে এখন পুরো সিলেটে পরিচিত।

প্রথমে বাড়ির পাশ্ববর্তী সুরমা নদীর তীরে চলতো পাঠদান। এরপর নিজের বাড়ির একটি কক্ষকেই শ্রেণীকক্ষে পরিণত করেন ইনু। এখন এখানেই চলে ইনুর ইশকুলের কার্যক্রম। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের প্রদান করা হয় শিক্ষার হাতেখড়ি। বিনামূল্যে এদের বই খাতাও প্রদান করা হয়। এছাড়া নিজ হাতে দেশের বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থাপনার রেপ্লিকা নির্মাণ করে শিশুদের দেশের ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কেও অবহিত করে করছেন ইনু।

এখানেই শেষ নয়। ইনু জানেন, মাদকসেবী হয়ে পড়ার পেছনে দারিদ্রতা আর বেকারত্বও অনেকাংশে দায়ী। এই দুই অভিশাপ ঘোচাতেও উদ্যোগী হয়েছেন তিনি। এলাকার দরিদ্র নারীদের সেলাই প্রশিক্ষণ প্রদান করা, বিভিন্ন সংস্থার সহযোগীতায় প্রশিক্ষিতদের মধ্যে বিনামূল্যে সেলাই মেশিন বিতরণেরও কাজ করছেন ইনু।

পেশাগত জীবনে ইনু একটি বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থায় এইচআইভি প্রজেক্টে মাঠকর্মীর কাজ করেন। চাকরী, দারিদ্রতা কিছুই বাধা হতে পারেনি তার এই বিশাল কর্মযজ্ঞ। কিছুতেই যেনো ক্লান্তিও নেই ইনুর।

ইনু বলেন, আমার জীবনের একটি উজ্জ্বল সময় মাদকে ধ্বংস হয়ে গেছে। আমি বুঝেছি মাদকের যন্ত্রণা। আর কারো জীবন যেনো নষ্ট না হয়, সবাই যেনো সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে সে লক্ষ্যেই কাজ করছি আমি।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.