Sylhet Today 24 PRINT

‘হকতই’: জৈন্তিয়াদের প্রাণের উৎসব

আবদুল হাই আল-হাদী |  ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯

বাংলাদেশে বসবাসরত জৈন্তিয়া বা সিন্টেংদের প্রধান ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব হচ্ছে ’হকতই’। প্রতিবছর অত্যন্ত জাঁকজমকের সাথে উৎসবটি পালন করা হয়। প্রধানত: ধর্মীয় অনুষ্ঠান হলেও এটি জৈন্তিয়াদের সামাজিক জীবনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। প্রথাগত পদ্ধতিতে কিছু আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রয়াত পূর্ব-পুরুষদের বিদেহী আত্মার প্রশান্তি কামনা এবং কর্ম ও কীর্তি স্মরণ করা হয় ’হকতই’ অনুষ্ঠানে। একই সাথে এর মাধ্যমে নিজেদের অনাগত ভবিষ্যতের মঙ্গল ও প্রশান্তিও কামনা হয় । সিলেটের জৈন্তাপুরের নিজপাটে বসবাসরত জৈন্তিয়ারা (যারা খাসিয়া হিসেবে পরিচিত)  অত্যন্ত আড়ম্বরে উৎসবটি পালন করে।

বাংলা মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের সপ্তমী তিথিতে ‘হকতই’ উদযাপন করা হয়। এর দুটি দিক রয়েছে-একটি সামাজিক অন্যটি ধর্মীয়। ধর্মীয় দিকটি প্রধান হলেও এর সাথে সংস্কৃতির অন্যান্য দিকের সমন্বয় ঘটার কারণে এটি জৈন্তিয়াদের প্রধান উৎসবে রূপ লাভ করেছে। জৈন্তিয়ারা সাধারণত: ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো নিজেদের পছন্দসই দিনে পালন করে থাকে। কিন্তু ‘হকতই’ ই একমাত্র উৎসব যা মাঘের শুক্লপক্ষের সপ্তমী তিথিতে পালনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আশীর্বাদ, প্রার্থনা, পূর্ব-পুরুষদের উদ্দেশ্যে নৈবেদ্য নিবেদন আর ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠানের ভেতর দিয়ে ব্যাপক উৎসাহের সাথে দিনটি পালন করা হয়।

‘হকতই’ এর দিনে সকাল থেকেই পূর্ব-পুরুষদের আত্মার শান্তি ও নিজেদের অনাগত দিনের মঙ্গল কামনায় বিশেষ ধর্মীয় কার্যাদি সম্পাদন করা হয় যা ‘সিয়াংজা’ নামে পরিচিত। ‘হকতই’ এর দিনে ‘সিয়াংজা’ অবশ্য পালনীয়। এজন্য প্রথমে ফল-মূল, পিঠা, বিভিন্ন পদের উন্নতমানের খাবার রান্না করা হয়। মৃত পূর্বসূরিরা যে খাবারগুলো পছন্দ করতেন, সেগুলোর প্রতিও বিশেষ নজর দেয়া হয়। অত:পর রান্না করা সকল খাবারের একটি অংশ ধর্মীয় কাজের জন্য আলাদা করা হয়। খাবারের সবচেয়ে ভালো অংশ যাতে সেখানে থাকে, সেটির প্রতি গুরুত্ব প্রদান করা হয়। এরপর কলাপাতার সামনের অংশ কেটে এনে ধুয়ে মুছে সাফ করা হয়। ধর্মীয় কার্যাদি সম্পাদনের জন্য ঘরের নির্ধারিত জায়গায় পাতাগুলো পূর্ব-দিকে মুখ করে সাজিয়ে রাখা হয়। সেখানে ফল-মূল, পিঠা-পায়েসসহ প্রস্তুত প্রত্যেকটি খাবারের পৃথক করা অংশ সে কলাপাতায় সাজিয়ে রাখা হয়। এমনকি নিজের সম্মানিত আত্মীয়রা যা পছন্দ করতেন, তা ও কলাপাতায় রাখা হয়। যেমন-কারও নানী যদি জীবিত থাকার সময় সিগারেট পছন্দ করতেন, তবে এদিন নৈবেদ্যেও তালিকায় সিগারেটও দেওয়া হয়।  আবার অনেক-জনের জন্যও একটি পাতায় খাবার সাজানো হতে পারে। এরপর নিবেদনের জন্য প্রয়োজনীয় ধর্মীয় কার্যাদি শুরু হয়। মাতৃপ্রধান জৈন্তিয়া সমাজে বাড়ীর বয়স্ক মহিলাই এ কাজ করে থাকেন। তবে পরিবারের সবচেয়ে ছোট মেয়ে যদি কাজটি সম্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও পরিপক্বতা অর্জন করে, তবে সে কাজটি সম্পাদনের জন্য অগ্রাধিকার পায়।

বিশেষ পদ্ধতিতে এ ধর্মীয় কাজ সম্পাদিত হয়। এক্ষেত্রে একটি বিশ্বাস করা হয় যে, মৃত পূর্বপুরুষের আত্মা সিয়াংজা’র সময় বাড়িতে উপস্থিত হয় এবং সবকিছু দেখতে পারে। এজন্য সর্বোচ্চ সম্মান ও ভক্তির মাধ্যমে কাজটি সম্পাদন করা হয়।  এরপর বাড়ীর সবাই সমবেত হয়ে পূর্বসূরিদের আত্মার শান্তি ও মুক্তি কামনা করেন। কখনও বাড়ীর প্রত্যেক সদস্য আলাদাভাবে এটি করে থাকেন। এটি পূর্বপুরুষের প্রতি নিজের ভক্তি ও শ্রদ্ধার বহি:প্রকাশও বটে। তারা স্রষ্ঠা ও পূর্বসূরিদের কাছে নিজেদের মঙ্গলও প্রার্থনা করেন। নৈবদ্য প্রদানের পর সেটি অনেক্ষণ রাখা হয়। পরবর্তীতে এটি বাড়ীর নির্জন কোন স্থানে রেখে আসা হয়।  খাবারের বাকি অংশ নিজেরা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে খেয়ে নেয় এবং আত্মীয়দের মধ্যেও বিতরণ করা হয়। সাধারণত সকালেই ‘সিয়াংজা’ পালন করা হয়। কোন কারণে দেরী হলে সূর্যাস্তের পূর্বেই এটি করা বাধ্যতামূলক।

‘হকতই’ পালনের ক্ষেত্রে কিছু ট্যাবু (Taboo) বা নিষেধাজ্ঞা আছে। অশুচিকালীন সময়ে ‘হকতই’ পালনে সে পরিবার কিংবা ক্ষেত্রবিশেষ পুরো এলাকাবাসীকে এ উৎসব পালন থেকে বিরত থাকতে হয়। কেউ মারা গেলে তার অস্থিদাহের পর পাত্রস্থ করে মৃত্যু পরবর্তী অনুষ্ঠান সম্পন্ন না করা পর্যন্ত সে পরিবার উৎসব পালন করতে পারবেনা। সন্তান প্রসবের পর তার নাম রাখার ধর্মীয় কার্যাদি শেষ না হওয়া পর্যন্ত ‘হকতই’ এর ধর্মীয় কার্যাদি করার উপর ট্যাবু রয়েছে। কারো হাম বা বসন্ত হলে সে পরিবার বা পাড়াবাসীকে ‘হকতই’ এর কার্যাদি থেকে বিরত থাকতে হয়। মহিলাদের অশুচিকালীন অন্যান্য সময়ে এ উৎসব থেকে বিরত থাকতে হয়।

‘হকতই’র দিন ভোর থেকেই ঘরদোর পরিষ্কার করা হয়, ছেলে-মেয়েসহ পরিবারের সবাই গোসল করে । এরপর খাবার-দাবার রান্না করা হয়। সাধারণত: ‘হকতই’ এর ২/৩ দিন পূর্ব-থেকেই জৈন্তিয়াদের প্রতিটি পরিবারে নানা ধরণের পিঠা তৈরি করা হয়। ফল-মূলসহ ঐতিহ্যবাহী খাবার তৈরির সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়। ’হকতই’ এর দিন ’সিয়াংজা’ শেষ হওয়ার পরই  প্রতি পরিবার প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ী পিঠা ও ঘরে তৈরি অন্যান্য খাবার পাঠাতে থাকে। বলা যায়, পরিবারগুলোর মধ্যে পিঠা পাঠানোর এক ধরণের প্রতিযোগিতা চলে এ সময়। এ ক্ষেত্রে অবশ্য কিছু রীতি মেনে চলা হয়। যেমন- নিজের স্বামী’র পরিবারে পিঠা ও খাবার-দাবার পাঠাতে হয় । না পাঠালে অপরপক্ষের কাছে এ পরিবারের দুর্বলতা ও অবহেলা প্রকাশ পায় এবং ’খোটা’ শুনতে হয়।

এ উৎসবের সপ্তাহ/ দশদিন আগে থেকেই আত্মীয়-স্বজনরা বাড়ীতে আসতে থাকে। জীবিকার তাগিদে দূর দূরান্তে অবস্থানরতরাও বাড়ী ফিরে আসে। বাড়িঘর ধুয়ে-মুছে সুন্দর করা হয়। বাড়ীতে পরিবার ও পাড়া-পড়শিদের সঙ্গে ‘হকতই’ পালনের জন্য প্রত্যেকেরই প্রচেষ্টা থাকে। কেউ একান্ত কোন কারণে আসতে না পারলে টাকা-পয়সা দিয়ে শামিল হয়।  সবার মিলনে প্রাণ চাঞ্চল্যে ভরে উঠে পুরো জনপদ। দেশি-বিদেশী নানা রকম পিঠার মধ্যে ‘শীতল ’ পিঠাই খাসিয়াদের সবচেয়ে প্রিয়। এটা মাছ, সবজি, মাংস ইত্যাদির সাথে খাওয়া হয়। ‘সিয়াংজা’ এর ক্ষেত্রে এ পিঠা আবশ্যক। সামর্থ্য অনুযায়ী প্রত্যেকেই নতুন জামা ক্রয় ও পরিধান করে। প্রত্যেকে প্রত্যেকের সাথে কুশল বিনিময় করে। এভাবে আনন্দের বন্যায় পুরো জনপদ মুখরিত হয়ে উঠে। জৈন্তিয়ারা অতিথিপরায়ণ এবং এজন্য এদিন পরিচিত বাঙালী বন্ধু-বান্ধবদেরও আমন্ত্রণ করা হয়ে থাকে।

জৈন্তাপুরের নিজপাটে ‘খাসিয়া সেবা সংঘ’এর উদ্যোগে বিগত কয়েক বছর ধরে অত্যন্ত জাঁকজমকের সাথে ‘হকতই’ এর দিনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এ অনুষ্ঠানে ঐতিহ্যবাহী গান, নৃত্য, কৌতুক, কবিতা প্রভৃতির আয়োজন করা হয়। নানা প্রকার ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলারও জমজমাট আয়োজন থাকে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ঐহিত্যবাহী গানের পাশাপাশি বাংলা ও হিন্দিগান পরিবেশিত হয়। শিশু-কিশোর, নারী-পুরুষ সবার অংশগ্রহণে মুখরিত থাকে নিজপাটের জৈন্তিয়াপল্লী। নিজ জাতিসত্ত্বার লোকজন ছাড়াও বাঙালিরা এতে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করে। ভারতের জৈন্তিয়া পার্বত্য জেলা থেকেও আত্মীয় ও পরিচিতজন এতে অংশগ্রহণ করে।

‘হকতই’ উৎসবের উৎপত্তি কখন, কোথায় এবং কিভাবে হয়েছিলো তার ইতিহাস জানা যায়না। বাংলাদেশে বসবাসরত জৈন্তিয়াদের মধ্যে একমাত্র জৈন্তাপুরের নিজপাটে বসবাসরত জৈন্তিয়ারা এ উৎসব পালন করে থাকে। প্রাচীন জৈন্তারাজ্যে জৈন্তিয়া সভ্যতা বিকাশের সাথে এ উৎসব বিকশিত হয়েছে বলে অনুমান করা হয়। খাসিয়া ভাষায় ‘হক’ শব্দের অর্থ হচ্ছে অধিকার বা পাওয়া। এ ‘হক’ শব্দের অর্থ থেকে ‘হকতই’ শব্দের উদ্ভব বলে অনেকেই মনে করেন। প্রয়াত পূর্ব পুরুষদের আত্মার শান্তি কামনা উত্তর পুরুষদের দায়িত্ব এবং পূর্ব পুরুষদের ‘হক’ বা অধিকার। সম্ভবত এ থেকেই ‘হকতই’ শব্দের প্রচলন হয়ে থাকতে পারে। আবার, অনেকে ‘হকতই’ এর সাথে হিন্দুদের ‘সপ্তই’ বা ‘হপ্তই’ এবং ‘হপ্তই’ এর সাদৃশ্য খোঁজার চেষ্টা করেন। মাঘের সপ্তমীতে হিন্দুদের অনেকে ‘সপ্তই’ বা ‘হপ্তই’ পূজা করে থাকেন। আসামীরা ‘স’ কে ‘হ’ বলে থাকেন। সপ্তমী থেকে হপ্তমী বা হপ্তই এবং ‘হপ্তই’ থেকে ‘হকতই’ শব্দের উদ্ভব হয়ে থাকতে পারে। তবে দিনের মিল ছাড়া এ দুটির (উদ্দেশ্য ও রীতিনীতির) মধ্যে কোন সাদৃশ্য নেই। এক্ষেত্রে আরেকটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায় অনেকের কাছে। সে মতে, প্রাচীন জৈন্তিয়া রাজারা হিন্দুধর্মের সংস্পর্শে আসার পর তাদের মধ্যে অনেক পূজা-পার্বণের প্রচলন শুরু হয়। কিন্তু নিজের জাতির বেশিরভাগ অংশ হিন্দু ধর্ম থেকে বিরত থেকে নিজেদের লোকায়ত ধর্ম ’নিয়ামথ্রে’ পালন করতে থাকে। তখন তাদেরকে আনন্দের অংশীদার করার জন্য মাঘের ’পঞ্চমী’র একদিন পর ’সপ্তমী’র দিন পূর্ব-পুরুষের আত্মার শান্তি ও নিজেদের মঙ্গলের জন্য এ উৎসবের প্রচলন করে। তখন থেকেই এটি প্রতিবছর চলে আসছে। তবে বেশিরভাগই একমত যে, জৈন্তিয়া জাতির ইতিহাস ও ধর্মের সাথে সর্বদাই এটি জড়িত ছিল ও এটি জাতির ইতিহাসের মতোই প্রাচীন একটি উৎসব।

জৈন্তিয়ারা একটি সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও সভ্যতার অধিকারী জাতি। একদা নিজেদের সুসভ্য রাষ্ট্রব্যবস্থায় তারা নিজেদের সভ্যতার মুনশিয়ানা দেখিয়েছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নিজেদের সংস্কৃতির উপাদান দ্বারা তারা অন্যদেরও আলোকিত করেছে। জৈন্তিয়া রাজাদের অনেকেই হিন্দুধর্মের সংস্পর্শে আসলেও বেশিরভাগ জৈন্তিয়াই নিজেদের প্রথাগত ’নিয়ামথ্রে’ ধর্ম পালন করে যাচ্ছেন। গৌরবময় সেসব পূর্ব-পুরুষদের স্মরণ ও আশীর্বাদ প্রার্থনার উৎসব ‘হকতই’ তাদেরকে পুনরায় আত্ম মহিমায় জাগ্রত করবে বলে অনেকেই মনে করেন।

  • আব্দুল হাই আল-হাদী, লেখক ও পরিবেশকর্মী।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.