Sylhet Today 24 PRINT

বার্লিন প্রাচীরের পতনের ৩০তম বার্ষিকী

মোনাজ হক, বার্লিন |  ০৯ নভেম্বর, ২০১৯

আজ বার্লিন প্রাচীরের পতনের ৩০তম বার্ষিকী পালন করেছে জার্মানরা। শান্তিপূর্ণ বিপ্লব করেছিল জার্মানি সেদিন। তাই আজ বিশেষ জায়গাগুলিতে প্রায় ২০০ ইভেন্টসহ হাইলাইটটি শনিবার (৯ নভেম্বর) রাতে ব্র্যান্ডেনবুর্গ গেটের একটি বড় মঞ্চ শো'তে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

রক্তপাতহীন বিপ্লব করেছে পূর্ব জার্মানি, পশ্চিম জার্মানি তাতে সহায়তা করেছে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে। রাজনৈতিক সমাধান হতে যদিও আরও একটি বছর লেগেছিল কিন্তু বার্লিন দেওয়াল ভাঙার মাধ্যমে দুই দেশের একত্রীকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয় আজকের এই দিনে।

কখনো কখনো বিশ্বের চাঞ্চল্যকর ঘটনাগুলো খুব দ্রুত বদলাতে থাকে। কিন্তু যেভাবে ১৯৮৯ সালে ঘটনা এবং ক্ষমতার পরিবর্তন হয়েছে, তার সঙ্গে তাল মেলানো কঠিন ছিল। আর জার্মানদের কাছে এই চাঞ্চল্যকর ঘটনার একটি হলো বার্লিন দেয়ালের পতন, যা সাড়া জাগিয়েছিল সারা পৃথিবীতে।

বার্লিন দেয়াল কীভাবে তৈরি হয় (১৯৬১ সালে), তা আমি দেখিনি, কিন্তু কিভাবে ভাঙা হয় তা সম্পূর্ণভাবে দেখেছি, সাক্ষী হয়েছি ও ভাঙায় অংশও নিয়েছি।

দেয়ালটি ২৮ বছর দাঁড়িয়ে ছিলো দুই বার্লিনের মাঝে আর এভাবেই জার্মান জাতিকে বিভক্ত করে রেখেছিলো ধনতান্ত্রিক বিশ্ব আর সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের মাঝে। সোভিয়েত নেতা গর্বাচভের নেতৃত্বে পেরেস্ত্রোইকার ও গাসনস আন্দোলন শুরু হয় ১৯৮৫ সালেই, সেই আন্দোলনের জোয়ার পূর্ব জার্মানিতে আসতে লেগেছিল আরও ৪ বছর।

বার্লিনের দেয়াল আংশিক ভেঙে পরে পূর্ব বার্লিনের আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের চাপে , কিন্তু এটির পুরোপুরি পতন হয় বিপ্লবীদের এক বিশাল জনস্রোতের কারণে। এর মাধ্যমে সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট ব্লকের পতনের শুরু হয় পূর্ব জার্মানিতে, এবং নতুন এক বিশ্বের সূচনা করে। এর মাঝেই পোল্যান্ড, চেকোস্লোভাকিয়া, বুলগেরিয়া এক এক করে সোভিয়েত ওরার্শ জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয় শুধু রোমানিয়াতে চাওচেস্কো গুলিবর্ষণ করে যাচ্ছে নিজদেশের জনগণের ওপর। সে কী বীভৎসতা, যা আমাকে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকে মনে করিয়ে দিয়েছিলো। পূর্ব জার্মানির কমিউনিস্ট নেতারা সেদিক থেকে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে গোলাবর্ষণ না করে ৯ নভেম্বরের জনগণের বিপ্লবকে তরান্বিত করেছিলো।

কীভাবে দেয়ালটি ভেঙে ফেলা হয়?

ঘটনাটি যদিও ছিল ১৯৮৯ সালের ৯ নভেম্বর, কিন্তু এর পাঁচ দিন আগে থেকে বিশাল এক প্রতিবাদ সমাবেশের অংশ হিসাবে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ দেয়ালের পূর্ব দিকে জড়ো হয়েছিল, যে দেয়ালটি পশ্চিম জার্মানি থেকে কমিউনিস্ট শাসিত পূর্ব জার্মানিকে আলাদা করে রেখেছিল।

সীমান্তের কড়াকড়ি তুলে দিয়ে এবং পূর্ব জার্মানির বাসিন্দাদের ভ্রমণ সহজ করে দিয়ে বিক্ষোভকারীদের শান্ত করার চেষ্টা করছিলেন পূর্ব জার্মানির কমিউনিস্ট নেতারা। তবে সীমান্ত পুরোপুরি খুলে দেওয়ার কোন উদ্দেশ্য তাদের ছিল না। তারা আপাতত চেকপয়েন্টগুলো খুলে দিয়ে অবাধে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়ে পূর্ব জার্মান বয়সীদেরকে খুশি করাবে কিন্তু এসব ছিল কমিউনিস্টদের ছোটখাটো পরিবর্তন। তারা ভেবেছিলো এভাবেই হয়তো এই শান্তিপূর্ণ বিপ্লব ঠেকাতে পারবে, কিন্তু যেভাবে সেটি বাস্তবায়ন করা হয়, তার পরিণতি হয়েছিল ব্যাপক, জনতা ফুঁসে উঠেছিলো, ৪০ বছরের সমাজতান্ত্রিক শাসকের বিরুদ্ধে। তারই পরিণতি বার্লিন দেয়ালের পতন।

কেন বার্লিনের দেয়ালের পতন হলো?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পটসড্যাম কনফারেন্সের মাধ্যমে, যা ৭ জুলাই থেকে ২ আগস্ট ১৯৪৫ সালে বার্লিনের পাশেই পটসড্যাম শহরে অনুষ্ঠিত হয় সেখানে সোভিয়েত নেতা স্টালিন, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান পটসড্যাম চুক্তির মাধ্যমে পুরো জার্মানিকে চার বৃহৎ শক্তির মাঝে ভাগ করা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং তার সাবেক মিত্র পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে ইউরোপ বিভক্ত হয়ে যায়। পশ্চিম থেকে পূর্বের দেশগুলোর মধ্যে ধীরে-ধীরে অভেদ্য একটি পর্দা তৈরি করে সোভিয়েত ইউনিয়ন।

পরাজিত জার্মানি ভাগ হয়ে যায় দখলদার দেশগুলোর মধ্যে- যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে। দেশটির পূর্ব অংশ নিয়ন্ত্রণ করে সোভিয়েতরা। পূর্ব জার্মানি, যার আনুষ্ঠানিক নাম ছিল জার্মান ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক, তখন পশ্চিম ইউরোপে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব বিস্তারের কেন্দ্রে পরিণত হয়। দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে চলে এই অস্বাভাবিক অবস্থা।

আর বার্লিন ভাগ হয়ে যায় চারটি সেক্টরে। পশ্চিম অংশে ছিল ব্রিটিশ, ফরাসি এবং আমেরিকান দখলকৃত অঞ্চল, আর পূর্ব অংশে ছিল সোভিয়েত এলাকা, যা ছিলো পূর্ব জার্মানির রাজধানী। আর পশ্চিম বার্লিন পরিণত হয় ফ্রিসিটি হিসেবে, চারদিকে কমিউনিস্ট পূর্ব জার্মানি ঘেরা একটি দ্বীপে। তাই আজ ঠিক ৩০ বছর হলো এই শান্তিপূর্ণ বিপ্লব, যা ৯ নভেম্বর, ১৯৮৯ শুরু হয়েছিল বার্লিন ওয়াল ভাঙার ইতিহাস দিয়ে। এই দিনটিই জার্মানরা তাদের শান্তিপূর্ণ বিপ্লব নামে অভিহিত করে।

সহিংসতা ছাড়াই একটি অভ্যুত্থান একটি শান্তিপূর্ণ বিপ্লব ছিলো জার্মানিতে, আমরা ১৯৮৯ সালের শান্তিপূর্ণ বিপ্লবকে বোঝাতে চাইছি সেখানে পূর্ব জার্মানির মানুষ 'মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং অবাধ নির্বাচন' চাইছিলো। এবং তারা আবার পশ্চিম দিকে ভ্রমণ করতে সক্ষম হওয়ার আনন্দ ফিরে পেতে চেয়েছিল। শান্তিপূর্ণ বিপ্লব সফল হয়েছিল, কারণ নভেম্বরে কমিউনিস্ট নেতারা জনগণের ওপর গোলাগুলি থেকে বিরত ছিল এভাবেই "বার্লিন প্রাচীরের পতন" হয়।

৯ নভেম্বর ১৯৮৯-এর এই ঘটনা পরবর্তীতে দুই জার্মানির একীভূত করাকে তরান্বিত করে, এবং পরে অনেক আলোচনা আর চুক্তির মাধ্যমে ৩ অক্টোবর ১৯৯০ সালে দুই জার্মানি একত্র হয়। "আমরা এক জাতি"- এই স্লোগানে আকাশ প্রকম্পিত হয়ে ওঠে সেদিন।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.