Sylhet Today 24 PRINT

হারিয়ে যাওয়ার ৭০ বছর পর দেশে আসা নেকড়েকে পিটিয়ে হত্যা

রিপন দে, মৌলভীবাজার |  ০৯ ডিসেম্বর, ২০১৯

এদের উচ্চতা আড়াই ফুটের কাছাকাছি। লম্বায় তিন থেকে সাড়ে তিনফুট হয়। ওজন ১৮ থেকে ২৭ কেজি। দেখতে প্রায় কুকুরের মতো। এদের চোখ হলুদাভ। জংলি হলেও খোলা প্রান্তরে ঘুরে বেড়ায়। শিকারের জন্য সময়ের বাছ বিচার করে না।

ছয় থেকে দশটি প্রাণী মিলে একটি দল গঠন করে। সারাদিনে প্রায় ১২ মাইল এলাকা ঘুরে বেড়ায়। এরা সবাই একসাথেই শিকার ধরে। সাধারণত বড় কোন প্রাণী যেমন হরিণ ধরতে দলের সবাই একসাথে কাজ করে। শিকার ধরার পর এক বসায় তারা প্রায় ২০ পাউন্ড মাংস খেয়ে ফেলতে পারে। এছাড়াও অন্যান্য ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখি, মাছ, সরীসৃপ ও ফলমূলও খেয়ে থাকে। পরিবেশের জন্য উপকারী এই প্রাণীর নাম নেকড়ে।

কুকুর গোষ্ঠীর সবচেয়ে বড় প্রাণী নেকড়ে। নেকড়ের ইংরেজী নাম wolf এদের বৈজ্ঞানিক নাম Canis lupus। নেকড়ে সামাজিক জীব। নেকড়ে দল খুব কঠোরভাবে নেতৃত্ব মেনে চলে। শিকার ধরার পর দলপতি এবং তার সঙ্গী প্রথমে খায়। তারপরে ক্রমান্বয়ে বাকিরা খাবারের ভাগ পায়।

একা থাকলে তার বাকি সঙ্গীদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এবং দলের সাথে থাকলে অন্য দলকে তাদের সীমানা সম্পর্কে সাবধান করতে গর্জন করে।

নেকড়েকে আমরা সাধারণত বিভিন্ন সেট্যালাইট চ্যানেলের কল্যানে দেখে আসছি। এক সময় বাংলাদেশে নেকড়ে থাকলেও বর্তমানে বাংলাদেশে নেকড়ে নেই। ৭০ বছর আগে সর্বশেষ নোয়াখালীরতে নেকড়ে দেখা যায়। ১৯৫৭ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত মিত্র, এস. এন –এর লেখা “বাংলার শিকার প্রাণী” বইতে উল্লেখ করা হয়েছে ১৯৪০ সালে নোয়াখালির চরাচঞ্চলে সর্বশেষ নেকড়ে দেখা যায় ।

বাংলাদেশ থেকে বিপন্ন হওয়ার কারণ ছিল নির্বিচারে হত্যা। নেকড়ে মারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই দেশে পুরস্কার পর্যন্ত ঘোষণা করেছিল।।

কিন্তু বিলুপ্তির ৭০ বছর বাংলাদেশে একটি নেকড়ের দেখা মিলেছে যদিও বিলুপ্ত এই প্রাণীটিকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। মৃত দেহ থেকে জানা গেছে এর পরিচয়।

জানা যায়, চলতি বছরের মে'র শুরুর দিকে ঘূর্ণিঝড় ফনী পর বরগুনার তালতলিতে বাঘ আতঙ্ক ছড়িয়ে পরে। রাতের আধারে গৃহপালিত পশুদের উপর আক্রমণ করতে থাকে। এরই মধ্যে একটি বাছুরকে খেয়ে ফেলে। গ্রামবাসী রাত জেগে পাহারা দেওয়া শুরু করে বাঘ আতংকে এরই মধ্যে কুকুরের মত একটা প্রাণির দেখা মিলে তবে তা অনেক দূর থেকে দেখায় কেউ নিশ্চিত করতে পারেনি কুকুর নাকি বাঘ। অবশেষে গ্রামবাসীর হাতে ধরা পরে প্রাণিটি। তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। তখন অনেকেই মনে করেছিল এটা সোনালী শিয়াল (Canis aureus)। যদিও সোনালী শিয়াল বাংলাদেশে নেই। পরে মৃতদেহ থেকে নমুনা সংগ্রহের পর প্রকাশিত ডিএনএ পরীক্ষায় জানা যায় এটি নেকড়ে।

ধারণা করা হয় ঘুর্ণিঝড় ফনিতে ভারত থেকে নেকড়েটি বানের পানিতে চলে আসতে পারে।

বরগুনার তালতলিতে পিটিয়ে হত্যা করা নেকড়েটির পরিচয় আবিষ্কারের পেছনের গল্প জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক ও প্রাণি গবেষক মুনতাসির আকাশ। তিনি জানান, যখন এটি লোকালয়ে এসে বিভিন্ন গৃহপালিত প্রাণীর উপর হামলা করতে থাকে এবং সর্বশেষ একটি বাছুরকে হত্যা করে অংশ বিশেষ খেয়ে ফেলে স্বাভাবিক ভাবে সাধারণ মানুষ এবং গ্রামবাসী ক্ষিপ্ত হয়। পরে পিটিয়ে হত্যা করে। কিন্তু কেউই বলতে পারছিলনা এটা কি প্রাণী। আমার নেকড়ে হিসেবে সন্দেহ হলে আন্তর্জাতিক কয়েকজন মাংসাশী প্রাণী বিশেষজ্ঞকে জানাই এবং এই এলাকায় পাঠাই তারা হলেন ড. জাদবেন্দ্র দেব, ড. উইল ডাকওয়ার্থ, ড. জান কামলার। এবং আমি নিজেও এই এলাকায় গিয়ে আশেপাশের লোকজনের সাথে কথা বলি তারা জানান, এমন প্রাণী তারা এর আগে এই এলাকায় দেখেনি এবং পার্শ্ববর্তী টেংরাগিরি সংরক্ষিত বনেও এমন কিছু তারা দেখেনি। মৃত প্রাণীটির ডিএনও সংগ্রহ করে নিয়ে আসি এবং প্রয়োজনীয় ছবি। ডিএনও নিয়ে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োলজি বিভাগের ল্যাবে পরীক্ষা করে জানতে পারি এটি নেকড়ে।

কিন্তু কিভাবে এই নেকড়েটি বাংলাদেশের ভেতর আসল সে তথ্য জানাতে গিয়ে এই গবেষক বলেন, ধারণা করা হচ্ছে ফনির তান্ডবে এটি ভারত থেকে আসতে পারে বানের পানিতে ভেসে অথবা যদি বাংলাদেশে থেকে থাকে তাহলে সুন্দর বনের গভীরে থাকতে পারে যদিও এর পক্ষে কোন প্রমাণ নেই।

তিনি জানান, বাংলাদেশের নোয়াখালী জেলায়, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল, রাজশাহী, রংপুর ও দিনাজপুর অঞ্চলেও নেকড়েদের অবাধ বিচরণ ছিল।

বর্তমানে নেকড়ে আছে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, কাশ্মীর, পাকিস্তান, ইরান, ইরাক, তিব্বত উত্তর আররে।

একসময় পুরো উত্তর গোলার্ধে বিচরণ করত। নেকড়ের সাথে মানুষের সংঘর্ষের ইতিহাস দীর্ঘদিনের। যদিও নেকড়ে সাধারণত মানুষকে আক্রমণ করে না, তবুও গবাদি পশু আক্রমণের কারণে তারা মানুষের কাছে হিংস্র হিসেবে পরিচিত।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.