Sylhet Today 24 PRINT

স্মরণ: ‘একাত্তরের দিনগুলি’-তে শরীফ ইমাম

আবিদ হোসেন |  ৩০ অক্টোবর, ২০১৫

“আমরা যারা বর্ডার ক্রস করে যুদ্ধে অংশ নিতে পারিনি, তাদের কিন্তু দেশে বসেও অনেক কিছু করার আছে।”- শরীফ ইমাম। শুধুমাত্র মৌখিক উক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে শরীফ ইমাম ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ দিনগুলোতে দেশে বসেই তাঁর কর্মক্ষেত্রের অভিজ্ঞতার আলোকে এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থিক ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করেন।

প্রখর ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন, বিনয়ী, মৃদুভাষী ও অমায়িক চরিত্রের অধিকারী শরীফ ইমামের কঠিন দেশপ্রেম প্রস্ফুটিত হয়ে উঠে একাত্তরে অগ্নিঝরা দিনগুলোতে। জাহানারা ইমামের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা ‘একাত্তরের দিনগুলি’-তে প্রকাশ পেয়েছে স্বামী শরীফ ইমামের দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধে অবদান, প্রখর ব্যক্তিত্ব, নির্ভীক মানসিকতা, মুক্তিযোদ্ধা পুত্র শহীদ রুমীর জন্য তীব্র ভালবাসা ।

জাহানারা ইমাম তাঁর স্মৃতিকথায় ষ্পষ্টতঃ তুলে ধরেছেন শরীফ ইমামের স্বাধিকার আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা প্রদানের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকার বিষয়গুলো। ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনীর চলাচল ব্যাহত করার উদ্দেশ্যে ২ নং সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ তাঁর কাছে বাংলাদেশের ব্রিজ ও কালভার্টের তালিকা চেয়ে পাঠান।

সারাদেশের সবগুলো ব্রিজ আর কালভার্টের তালিকা তৈরি করা সহজসাধ্য ছিল না। অত্যন্ত সতর্কতার সাথে তাঁকে এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজটি করতে হয়েছিল। রোডস এন্ড হাইওয়েজ-এর ডিজাইন ডিভিশনে অবাঙালি এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার কর্মরত থাকায় সেখান থেকে ব্রিজের ফাইলগুলো বের করে আনা ছিল অত্যন্ত দুরূহ কাজ।

সুকৌশলে ফাইলগুলো সরানোর পর শরীফ ইমাম এক প্রকার আহার নিদ্রা পরিত্যাগ করে লাগাতার তিনদিন ধরে ৩,৫০০টি ব্রিজ আর কালভার্ট এর তালিকা তৈরি করেন সহকর্মী এস. আর খান বাঁকা এবং সামাদ সাহেবকে নিয়ে। সামাদ সাহেবের বাসায় বসে এস.আর.খান বাঁকা নিজের হাতে ফাইল থেকে তালিকা কপি করেন এবং শরীফ ইমাম বিভিন্ন ধরনের ব্রিজের ড্রয়িং থেকে প্রত্যেকটির স্পেসিফিকেশন লেখেন।

তাঁদের দুজনের হাতের লেখা যাতে চেনা না যায়, সেজন্য দু’জনের হাতের লেখা অংশগুলো অন্য একজনকে দিয়ে আবার কপি করানো হয়। অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে কাজ সম্পন্ন করে শরীফ ইমাম মুক্তিযোদ্ধাদের দেয়ার জন্য তৈরিকৃত তালিকা এবং ড্রইংসমূহ বাড়ি নিয়ে আসেন । ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের অফিসের ওপর আই.বি’র নজরদারিতে থাকায় শরীফ ইমাম মুক্তিযোদ্ধা শাহাদত চৌধুরী আর হাবিবুল আলমকে তাঁর বাসা হতে তালিকাসমূহ নিয়ে যাবার জন্য বলেন।

শরীফ ইমামের বাসভবন ‘কণিকা’ ১৯৭১ সালে গেরিলাযোদ্ধাদের পদচারণায় মুখর ছিল। মুক্তিযোদ্ধা পুত্র রুমীর সহযোদ্ধারা নিরিবিলিতে অপারেশনের প্ল্যান করার জন্য কণিকাতে এলে শরীফ ইমাম নিজে বাজার করে গেরিলা যোদ্ধাদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেন। ২৫ আগস্ট’৭১ এ ধানমন্ডিতে দুর্ধর্ষ অপারেশন সেরে আসা রুমী এবং তাঁর দলের অস্ত্রশস্ত্র নিজ বাসভবনে লুকিয়ে রাখার ব্যাপারে শরীফ ইমাম সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন।

এছাড়াও শরীফ ইমাম এবং জাহানারা ইমাম মুক্তিযোদ্ধাদের তাঁদের সাধ্যমত আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করতে থাকেন। কিন্তু তাঁদের কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণ টাকা পয়সা না থাকায় শরীফ ইমাম তাঁর অন্যান্য বন্ধু এবং সহকর্মীদের নিকট হতে টাকা সংগ্রহের দায়িত্ব নেন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, পাকিস্তান কনসালট্যান্টস এর ডিরেক্টর মজিদ সাহেব মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তার জন্য দশ হাজার টাকা শরীফ ইমামকে প্রদান করলে তিনি এ টাকা ক্রমান্বয়ে কিছু কিছু করে বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাঠাবার ব্যবস্থা করেন।

১৯৭১ সালের ২৯ আগস্ট আনুমানিক রাত ১২টার দিকে পাক-সেনাবাহিনী শরীফ ইমামকে তাঁর মুক্তিযোদ্ধা পুত্র রুমী, কনিষ্ঠ পুত্র জামী, রুমীর বন্ধু ও চাচাতো ভাইকে বাড়ি হতে ধরে নিয়ে যায় এবং ২দিন অমানুষিক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন শেষে রুমী ছাড়া তাঁকে এবং অন্যান্যদেরকে ছেড়ে দেয়। বন্দীশিবিরে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ানো নির্ভীক শরীফ ইমামের নিকট হতে পাক-বাহিনী কোন তথ্য বের করতে পারেনি।

রুমীকে কেন্দ্র করে পাক আর্মি অফিসারের সকল প্রশ্নের অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে তিনি উত্তর দেন এবং এহেন পরিস্থিতিতেও এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে তিনি প্রশ্নকারী পাক অফিসারকে পাল্টা প্রশ্ন করেন যার ফলশ্র“তিতে সে বিব্রতকর অবস্থায় উপনীত হয়। পাক-আর্মির বন্দী শিবির থেকে ফিরে আসার পর শরীফ ইমাম স্ত্রীকে সেখানকার অমানুষিক নির্যাতনের বিষয়ে কিছু জানতে না দিয়ে যথাসম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেন। কিন্তু শরীফ ইমামের ভ্রাতুষ্পুত্রের কাছ থেকে জাহানারা ইমাম সবকিছু জেনে যাবার পর শরীফ ইমামের স্বীকার করা ছাড়া উপায় ছিল না। জাহানারা ইমাম তাঁর ‘একাত্তরের দিনগুলি’তে উল্লেখ করেন' যে তিনি জীবনে কখনো শরীফ ইমামকে কাঁদতে দেখেন নি।

এই প্রথম শরীফ ইমাম রুমীর নাম করে কাঁদলেন। বাইরে কঠোর মনোভাব বজায় রাখলেও ভেতরে ভেতরে পুত্রশোকে শরীফ ইমাম বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। রুমীকে উদ্ধার করার জন্য শরীফ ইমামের শুভানুধ্যায়ীগণ মার্সি পিটিশন করার কথা বললেও প্রখর ব্যক্তিসম্পন্ন শরীফ ইমাম তাতে রাজী হননি যদিও জানতেন এর পরিণতি কি হতে পারে। তিনি সিদ্ধান্ত নেন রুমীকে বের করে আনার যত চেষ্টা আছে তিনি করবেন কিন্তু মার্সি পিটিশন করে নয়।

কেননা যে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে রুমী মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে, সেই সরকারের কাছে মার্সি পিটিশন করলে রুমীর আদর্শকে হেয় প্রতিপন্ন করা হবে। তাই প্রখর ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন শরীফ ইমাম মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেও পুত্রের জীবনের চাইতে তিনি দেশ এবং পুত্রের আত্ম-সম্মানকেই প্রাধান্য দেন। রুমীর আদর্শকে সমুন্নত রাখার জন্য তিনি নতি স্বীকার করেননি সামরিক জান্তাদের কাছে। ফলশ্র“তিতে শহীদের তালিকায় লিপিবদ্ধ হয় রুমীর নাম এবং পুত্রশোক ও চরম অত্যাচার, অপমানের বোঝা এক পর্যায়ে সহ্য করতে না পেরে বিজয়ের মাত্র ৩দিন আগে মৃত্যুবরণ করেন শরীফ ইমাম।

মুক্তিযুদ্ধের এই মহান নেপথ্য নায়কের ৮৮তম জন্মবার্ষিকীতে বাঙালি জাতি তাঁকে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছে।

লেখক: সহযোগী তত্ত্বাবধায়ক, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম স্মৃতি জাদুঘর

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.