Sylhet Today 24 PRINT

সন্দেহের মেঘ ঠেলে ফাঁসির দণ্ডে বিতর্কের অবসান

যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর আপিলের রায়

নিজস্ব প্রতিবেদক |  ০৮ মার্চ, ২০১৬

শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী ও জামায়াতে ইসলামীর অর্থের মূল যোগানদাতা মীর কাসেম আলীর আপিলের রায় নিয়ে বিতর্ক চাঙ্গা ছিল। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে, রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, সরকারের মন্ত্রীরাও পর্যন্ত এ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কথা বলছিলেন। কিন্তু, সব বিতর্ক আর আলোচনার অবসান হয় আপিলের রায়ে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায় বহালের মাধ্যমে।

আপিল বিভাগ মঙ্গলবার (৮ মার্চ) সকালে মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। এর মাধ্যমে ডালপালা মেলা সব ধরনের সন্দেহের মেঘ দূরীভূত হয়, একই সঙ্গে  সব বিতর্কের অবসান হয়।

আপিল বিভাগের রায় ঘোষণার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত রায় নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল। কারণ আগের দিন আদালতের কার্যতালিকার ১ নম্বরে এ আপিলের রায় থাকলেও মঙ্গলবার সকালে প্রকাশিত সম্পূরক কার্যতালিকায় রায় নিয়ে কিছু উল্লেখ ছিল না। তার ওপর ছিল নানামুখী আলোচনা।

এর আগে সকালে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের ৯ সদস্যের বেঞ্চ প্রধান বিচারপতিকে উদ্দেশ করে সরকারের দুই মন্ত্রীর দেওয়া বক্তব্যের সমালোচনা করে এমন মন্তব্যে বিচারকরা স্তম্ভিত বলে উল্লেখ করেন। এবং খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হককে আগামী ১৫ মার্চ কারণ দর্শানোর নির্দেশ দেন।

এদিকে, মঙ্গলবার রায় ঘোষণার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত অনিশ্চয়তা আর সন্দেহের দোলাচালে দুলছিল যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর রায়। কী হতে পারে পারে রায়? যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সময়ে প্রকাশ্য আদালতে প্রধান বিচারপতি কর্তৃক রাষ্ট্রপক্ষের দায়িত্বে অবহেলাজনিত অভিযোগের প্রেক্ষিতে সরকারের দুই মন্ত্রী এ বিতর্কে জড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে রায় নিয়ে বিতর্কের পাশাপাশি ধোঁয়াশাও ঘনীভূত হয়।

বিতর্কের শুরুটা করেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহা আদালতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থার প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করার মাধ্যমে। রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সময় গত ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রধান বিচারপতি মীর কাসেম আলীর মামলাসহ অন্যান্য মামলা পরিচালনায় থাকা দায়িত্বশীলদের প্রতি গভীর অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, ‘সাঈদীর মামলার শুনানির সময়ও এ রকম অসঙ্গতি ধরা পড়েছিলো।’ উল্লেখ্য, যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসেইন সাঈদীর আপিলের রায়ে মৃত্যুদণ্ড থেকে সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।

প্রধান বিচারপতির প্রকাশ্য আদালতে এমন মন্তব্যের পর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, মীর কাসেমের বিচারে প্রসিকিউশনের গাফিলতির প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

প্রধান বিচারপতির এমন্তব্যের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে গত ৫ মার্চ  রাজধানীতে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আয়োজিত অনুষ্ঠানে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে এসব মন্তব্যের মাধ্যমে 'হাফ রায়' দেওয়া হয়ে গেছে। তারা আপিল শুনানি আবারও নেওয়ার দাবি জানান।

খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেন, প্রধান বিচারপতি প্রকাশ্যে আদালতে যে মন্তব্য করেছেন, তাতে মীর কাশেমের ফাঁসি বহাল থাকা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। মীর কাশেমের আর ফাঁসি বহাল রাখার সুযোগ নেই। হয় তাকে খালাস দেওয়া হবে অথবা শাস্তি কমিয়ে দেওয়া হবে। তিনি প্রধান বিচারপতিকে বাদ দিয়ে বেঞ্চ পুণর্গঠন করে পুনরায় আপিলের শুনানির দাবিও জানান।

অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, প্রসিকিউশন নিয়ে এমন মন্তব্যের পর তাঁর আর প্রধান বিচারপতির পদে আসীন থাকা অনুচিত।

একই অনুষ্ঠানে শাহরিয়ার কবীর একাত্তরে প্রধান বিচারপতি শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন এ অভিযোগ উত্থাপন করে শান্তি কমিটির সদস্যদেরও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান।

প্রধান বিচারপতিকে উদ্দেশ করে খাদ্যমন্ত্রী ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর এমন মন্তব্যের কারণে তাদের বিরুদ্ধে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছেন এক আইনজীবী। ৭ মার্চ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জুলফিকার আলী জুনু এ নোটিশ পাঠিয়েছেন। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দুই মন্ত্রীকে তাদের বক্তব্যের ব্যাপারে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে লিগ্যাল নোটিশে উল্লেখ করা হয়।

দুই মন্ত্রীর এমন মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী। তিনি একে বিচার বিভাগের ওপর নির্বাহি বিভাগের হস্তক্ষেপ অভিযোগ করে সরকারের সমালোচনা করেছেন।

মন্ত্রীদের বক্তব্যের দিনই সুপ্রিম কোর্ট বার আয়োজিত প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে দুই মন্ত্রীর বক্তব্যর প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলনে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, প্রধান বিচারপতি ও মীর কাসেম আলীর রায় নিয়ে সরকারের দুই মন্ত্রী যে মন্তব্য করেছেন তাতে সরকার কী পদক্ষেপ নেয়, সেটাই দেখার বিষয়।

প্রধান বিচারপতি কর্তৃক রাষ্ট্রপক্ষের মামলা পরিচালনায় অবহেলার অভিযোগ নাকচ করে দিলেও রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম দুই মন্ত্রীর অভিযোগকে অসাংবিধানিক উল্লেখ করেন।

রায় ঘোষণার আগে আদালতে প্রধান বিচারপতির মন্তব্য সম্পর্কে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে গণজাগরণ মঞ্চ। মঞ্চের অভিযোগ শীর্ষ এ যুদ্ধাপরাধীকে বাঁচানোর ষড়যন্ত্র চলছে। গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষ থেকে সপ্তাহব্যাপী গণ-অবস্থান কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। এ রায় নিয়ে যে কোন ধরনের ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে প্রয়োজনে আবারও শাহবাগ অবরোধ করে রাখার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয় গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষ থেকে।

মামলার যুক্তিতর্ক উপস্থাপনকালীন সময়ে প্রধান বিচারপতির মন্তব্যের রেশ ধরে দেশব্যাপী নানামুখী আলোচনা ও সরকারের দুই মন্ত্রীর তীব্র প্রতিক্রিয়ায় মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। তিনি দুই মন্ত্রীর এমন মন্তব্যকে সরকারের মন্তব্য বলে জানান।

সোমবার (৭ মার্চ) মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে নিয়ে দুই মন্ত্রীর বক্তব্য সরকারের নয়। মন্ত্রীদের এ ধরনের বক্তব্যে তিনি বিব্রত হয়েছেন, তাঁর সরকারও বিব্রত।

অবশেষে সব বিতর্ক, সমালোচনা আর আশঙ্কাকে অমূলক প্রমাণ করে দিয়ে আপিল বিভাগ তাদের চূড়ান্ত রায়ে যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখেন।

প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ মঙ্গলবার (৮ মার্চ) এই রায় ঘোষণা করেন।

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাসেমকে ফাঁসির আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।

ট্রাইব্যুনালের ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ৩০ নভেম্বর আপিল করেন মীর কাসেম। গত ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে প্রধান বিচারপতির বেঞ্চে ওই আপিলের শুনানি শুরু হয়, শেষ হয় ২৪ ফেব্রুয়ারি। পরে রায় ঘোষণার জন্য ৮ মার্চ তারিখ ধার্য করেন আদালত।

২০১২ সালের ১৭ জুন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মীর কাসেমকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ২০১৩ সালের ১৬ মে রাষ্ট্রপক্ষ তাঁর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে। ওই বছরের ৫ সেপ্টেম্বর তাঁর বিরুদ্ধে ১৪টি অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ট্রাইব্যুনালে বিচার শুরু হয়। এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে তদন্ত কর্মকর্তাসহ ২৪ জন ও আসামিপক্ষে তিনজন সাক্ষ্য দেন। চূড়ান্ত যুক্তি উপস্থাপন শেষে ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর রায় ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনাল।

মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে গঠন করা ১৪টি অভিযোগের মধ্যে ট্রাইব্যুনালে ১০টি প্রমাণিত হয়। ১০ টির মধ্যে ১১ ও ১২ নম্বর অভিযোগে আটজনকে নির্যাতনের পর হত্যার দায়ে তাঁকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। বাকি আটটি (২,৩, ৪,৬, ৭,৯, ১০ ও ১৪ নম্বর) অভিযোগে ১৭ জনকে নির্যাতনের দায়ে তাঁকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

এর মধ্যে ছয়টি অভিযোগে সাত বছর করে কারাদণ্ড, একটিতে ২০ বছর ও একটিতে ১০ বছর কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল।ট্রাইব্যুনালে ফাঁসির আদেশ পাওয়া ১১ নম্বর অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরে পবিত্র ঈদুল ফিতরের পর কোনো এক দিন মীর কাসেমের নির্দেশে আলবদররা মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে অপহরণ করে। এরপর তাঁকে ডালিম হোটেলে বন্দী রেখে নির্যাতন ও ২৮ নভেম্বর হত্যা করা হয়। পরে ডালিম হোটেলে নির্যাতনে নিহত আরও পাঁচজনের সঙ্গে জসিমের লাশ কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।

১২ নম্বর অভিযোগ অনুসারে, একাত্তরের নভেম্বরে মীর কাসেমের নির্দেশে আলবদররা চট্টগ্রামের হাজারী গলি থেকে রঞ্জিত দাস ও টুন্টু সেনকে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে নিয়ে যায়। পরে তাঁদের হত্যা করে লাশ গুম করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দল জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতা মীর কাসেম একাত্তরে ছিলেন দলটির ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের চট্টগ্রাম শহর শাখার সভাপতি। মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭৭ সালে ইসলামী ছাত্র সংঘ নাম বদল করে ছাত্রশিবির নামে রাজনীতি শুরু করে। মীর কাসেম ছিলেন ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।

ওই সময় থেকে তিনি জামায়াতের রাজনীতিকে শক্তিশালী করতে দলটির অর্থনৈতিক ভিত্তি শক্ত করার জন্য উদ্যোগ নিতে শুরু করেন।

১৯৮০ সালে তিনি রাবেতা আল-আলম আল-ইসলামী নামের একটি বিদেশি বেসরকারি সংস্থার এদেশীয় পরিচালক হন। এ ছাড়া তিনি দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের চেয়ারম্যান, ইবনে সিনা ট্রাস্টের অন্যতম সদস্য। ধীরে ধীরে তিনি জামায়াতের অর্থের অন্যতম জোগানদাতায় পরিণত হন।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.