Sylhet Today 24 PRINT

যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর আপিল কার্যতালিকায়

নিউজ ডেস্ক  |  ২১ এপ্রিল, ২০১৫

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আল বদর কমান্ডার জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলীর আপিল মামলা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় এসেছে। বুধবারের (২২ এপ্রিল) কার্যতালিকায় এ মামলা ২ নম্বরে রয়েছে।

মঙ্গলবার (২১ এপ্রিল) বিকেলে এ কার্যতালিকা প্রকাশিত হয়েছে।

প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার (এসকে সিনহা) নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ এ শুনানি গ্রহণ করবেন। বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর দেওয়া ফাঁসির রায়ের বিরুদ্ধে গত বছরের ৩০ নভেম্বর আপিল করেন মীর কাসেম আলী। দেড়শ’ পৃষ্ঠার মূল আপিলসহ ১ হাজার ৭৫০ পৃষ্ঠার আপিলে ফাঁসির আদেশ বাতিল করে খালাস চেয়েছেন তিনি। আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় আপিল আবেদনটি দাখিল করেন তার আইনজীবীরা।

মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মীর কাসেম আলীকে গত বছরের ২ নভেম্বর ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, বিচারপতি শাহীনুর ইসলাম ও বিচারপতি মো. মুজিবুর রহমান মিয়ার সমন্বয়ে গঠিত ট্রাইব্যুনাল-২।

আটজনকে নির্যাতনের পর হত্যা ও মরদেহ গুম এবং ২৪ জনকে অপহরণের পর চট্টগ্রামের বিভিন্ন নির্যাতনকেন্দ্রে আটকে রেখে নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী ১৪টি অভিযোগে অভিযুক্ত হন মুক্তিযুদ্ধকালে জামায়াতের কিলিং স্কোয়াড আলবদর বাহিনীর তৃতীয় শীর্ষ নেতা মীর কাসেম আলী। এ ১৪টি অভিযোগের মধ্যে ১০টি প্রমাণিত হয়েছে। বাকি ৪টি অভিযোগ প্রসিকিউশন সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পারেননি।

১৪টি অভিযোগের মধ্যে ১০টি অর্থাৎ ২, ৩, ৪, ৬, ৭, ৯, ১০, ১১, ১২ ও ১৪ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে এবং ৪টি অর্থাৎ ১, ৫, ৮ ও ১৩ নম্বর অভিযোগ প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে পারেননি বলে ট্রাইব্যুনালের রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে।

১১ ও ১২ নম্বর অভিযোগে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিনসহ মোট ৮ জনকে হত্যার দায়ে কাসেমের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে ১১ নম্বর অভিযোগে শহীদ কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিনসহ ছয়জনকে ও ১২তম অভিযোগে রঞ্জিত দাস লাতু ও টুন্টু সেন রাজুকে হত্যার অভিযোগ আনা হয়। ১১ নম্বর অভিযোগে সর্বসম্মত ও ১২ নম্বর অভিযোগে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে ফাঁসির রায় দেন বিচারপতিরা।

ফাঁসি ছাড়াও প্রমাণিত অন্য ৮টি অভিযোগে আরও ৭২ বছরের কারাদণ্ডাদেশ পেয়েছেন চট্টগ্রাম অঞ্চলে মানবতাবিরোধী অপরাধের মূল হোতা মীর কাসেম আলী।
এর মধ্যে প্রমাণিত ফারুককে অপহরণ-নির্যাতনে (২ নম্বর অভিযোগ) ২০ বছর ও নাসির উদ্দিন চৌধুরীকে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতনের (১৪ নম্বর অভিযোগ) দায়ে ১০ বছরের কারাদণ্ড পান তিনি।

এছাড়া অপহরণ, আটক ও নির্যাতন সংক্রান্ত ৩, ৪, ৬, ৭, ৯ ও ১০ নম্বর অভিযোগে ৭ বছর করে কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে। প্রমাণিত না হওয়া ১, ৫, ৮ ও ১৩ নম্বর অভিযোগে খালাস পেয়েছেন মীর কাসেম আলী। এগুলোও ছিল অপহরণ, আটক ও নির্যাতন সংক্রান্ত অভিযোগ।

রায়ে উল্লেখ করা হয়, মীর কাসেম আলী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় চট্টগ্রাম কলেজে পদার্থ বিজ্ঞানের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন। তিনি ওই সময় চট্টগ্রাম কলেজ শাখা ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি ছিলেন। একইসঙ্গে তিনি চট্টগ্রাম শহর শাখারও সভাপতি ছিলেন।

পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের ৬ নভেম্বর পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের প্রাদেশিক কার্যকরী পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত হন।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মীর কাসেম আলী জামায়াতসহ অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতায় ইসলামী ছাত্রসংঘের বাছাই করা সদস্যদের সমন্বয়ে সশস্ত্র আলবদর বাহিনী গঠন করেন। সেই আলবদর বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে মীর কাসেম আলী স্বাধীনতাবিরোধী মূল ধারার সঙ্গে একাত্ম হয়ে সারা বাংলাদেশ বিশেষ করে চট্টগ্রাম অঞ্চলে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেন।

চট্টগ্রাম শহরের দোস্ত মোহাম্মদ পাঞ্জাবি বিল্ডিং (চামড়ার গুদাম), সালমা মঞ্জিল, ডালিম হোটেলসহ শহরের বিভিন্ন স্থানে মীর কাশেম আলী তার সহযোগীদের নিয়ে আলবদর বাহিনীর নির্যাতন কেন্দ্র গড়ে তোলেন। এসব নির্যাতন কেন্দ্রগুলোতে বহু মানুষকে ধরে নিয়ে তিনি দিনের পর দিন নির্যাতন এবং অনেক লোককে হত্যা করেন।

মীর কাশেমের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ:
অভিযোগ-১: মীর কাশেমের নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী ১৯৭১ সালের ৮ নভেম্বর ওমরুল ইসলাম চৌধুরীকে অপহরণ করে। পরে কয়েক দফায় চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লার ডালিম হোটেল, পাঁচলাইশ থানার সালমা মঞ্জিল এবং একটি চামড়ার গুদামে নিয়ে নির্যাতন করা হয় তাকে। ১২ নভেম্বর তাকে সালমা মঞ্জিল নির্যাতন কেন্দ্রে ধরে নিয়ে যায় এবং কিছু কাগজপত্রে জোর করে স্বাক্ষর করে নেন। পরে আন্দরকিল্লার ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়।

অভিযোগ-২: মীর কাশেমের নেতৃত্বে ১৯ নভেম্বর চাকতাই থেকে লুত্ফর রহমান ফারুককে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মীর কাশেমের উপস্থিতিতে তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়। লুত্ফর রহমান একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে সক্রিয় কর্মী ছিলেন।

অভিযোগ-৩: একাত্তরের ২২ অথবা ২৩ নভেম্বর সকালবেলা আসামির নেতৃত্বে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে তার কদমতলার ভাড়া করা বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। মীর কাশেমের উপস্থিতিতে ডালিম হোটেলে তার ওপর অত্যাচার চালানো হয়। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার মুহূর্তে জাহাঙ্গীর আলমের আত্মীয়-স্বজন তাকে ডালিম হোটেল থেকে উদ্ধার করেন।

অভিযোগ-৪: একাত্তরের ২৪ নভেম্বর সাইফুদ্দিন খানকে মীর কাশেমের নেতৃত্বে ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতাকর্মীরা সালাহউদ্দিন খানকে ধরে নিয়ে যায়। তাকে ডালিম হোটেলে নির্যাতন করে আলবদর বাহিনী। পরে তাকে জেলে দেয়া হয়। তাকে জেল থেকে ১৬ ডিসেম্বর ভোরবেলা উদ্ধার করে তার আত্মীয়-স্বজন।

অভিযোগ-৫: ২৫ নভেম্বর আনোয়ারা থানার আবদুল জব্বারকে বাসা থেকে মীর কাশেমের নির্দেশে রাজাকার কমান্ডার জালাল চৌধুরী ধরে নিয়ে যায়। ডালিম হোটেলে মীর কাশেমের সামনে হাজির করা হয়। সেখানে নির্যাতন করা হয় তাকে। ১৩ ডিসেম্বর তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করা হয়।

অভিযোগ-৬: ২৮ নভেম্বর চট্টগ্রামের একটি চায়ের দোকান থেকে হারুনুর রশিদকে ধরে নিয়ে ডালিম হোটেল এবং সালমা মঞ্জিলে নির্যাতন করা হয়। মীর কাশেমের নির্দেশে তাকে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। তার চোখ উত্পাটন করা হয়। তাকে সালমা মঞ্জিল থেকে ১৬ ডিসেম্বর সকালে উদ্ধার করা হয়।

অভিযোগ-৭: মীর কাশেমের নেতৃত্বে সাত-আট যুবক ডবলমুরিং থানা থেকে সানাউল্লাহ চৌধুরী ও হাবিবুর রহমানকে ২৭ নভেম্বর ধরে নিয়ে যায়। তাকে ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের সময় তারা শুনতে পেয়েছেন যে, হোটেল থেকে অনেককে নিয়ে গেছে এবং তাদের হত্যা করা হয়েছে। তারা মুক্তি পায় ৬ ও ৯ ডিসেম্বর।

অভিযোগ-৮: ২৯ নভেম্বর রাতে নুরুল কুদ্দুস, মোহাম্মদ নাসির, নুরুল হাসেমসহ আরও কয়েকজনকে এনএমসি উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে অপহরণ করা হয়। তাদের ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। তাদের ১৬ ডিসেম্বর উদ্ধার করা হয়।

অভিযোগ-৯: ২৯ নভেম্বর সৈয়দ মো. এমরান, সৈয়দ কামাল, সৈয়দ ওসমান, সৈয়দ কামালসহ ছয়জনকে অপহরণ করা হয়। ডালিম হোটেলে ধরে নিয়ে তাদের ওপর অত্যাচার করা হয়। ১৬ ডিসেম্বর তারা মুক্ত হয়।

অভিযোগ-১০: ২৯ নভেম্বর মীর কাশেমের নির্দেশে মো. জাকারিয়া, মো. সালাউদ্দিন ওরফে ছুট্টু মিয়া ও নাজিমউদ্দিনকে এনএমসি হাইস্কুলের সামনে থেকে অপহরণ করা হয়। বয়স কম হওয়ায় ৩০ নভেম্বর নাজিমউদ্দিনকে ছেড়ে দেয়া হয়। জাকারিয়া এর সাত-আট দিন পর, ছুট্টু মিয়া ১১ বা ১২ ডিসেম্বর মুক্তি পায়।

অভিযোগ-১১: মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে ২৮ নভেম্বর ঈদুল ফিতরের দিন মীর কাশেমের নির্দেশে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। ডালিম হোটেলে তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়। সেখানে তার ওপর এত অত্যাচার চালানো হয় যে, সে মারা যায়। তাকেসহ আরও ছয়জনকে হতা করে তাদের লাশ কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দেয়া হয়।

অভিযোগ-১২: মীর কাশেমের নির্দেশে আলবদর বাহিনী জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে নভেম্বরের কোনো এক সময় ধরে নিয়ে যায়। তাকেসহ রঞ্জিত দাশ ওরফে লাথু এবং তন্তু সেন ওরফে রাজুকে ডালিম হোটেলে ধরে নিয়ে নির্যাতন করা হয়।

অভিযোগ-১৩: মীর কাশেমের নির্দেশে নভেম্বর কোনো একদিন সুনীল কান্তি বর্ধন ওরফে দুলালকে ধরে নিয়ে চাকতাই দোস্ত মোহাম্মদ পাঞ্জাবি বিল্ডিংয়ে নির্যাতন চালানো হয়। ১৬ তারিখ সে মুক্তি পায়।

অভিযোগ-১৪: নভেম্বর কোনো একদিন মীর কাশেমের নির্দেশে এজেএম নাসির উদ্দিন চৌধুরীকে ধরে নিয়ে নির্যাতন চালানো হয়।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.